যশোর সরকারি সিটি কলেজে কর্মরত বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে চাকরি দেওয়ার নামে লাখ লাখ টাকা হাতানোর অভিযোগ উঠেছে। ইংরেজি কোচিং করতে আসা অসংখ্য শিক্ষার্থীর সঙ্গে জাকির হোসেন এসব প্রতারণা করেছেন বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া সহকর্মীকে জিম্মাদার দেখিয়ে বেসরকারি একটি ব্যাংক থেকে ১০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। সেই টাকাও এখন ব্যাংকে পরিশোধ করছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে।
জাকির হোসেন সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার হিজলদী গ্রামের বাসিন্দা। বর্তমানে তিনি সপরিবার যশোর শহরে বসবাস করেন। প্রতারণার টাকায় তিনি ব্যক্তিগত গাড়ি কিনেছেন বলেও তাঁর সহকর্মীরা জানিয়েছেন। সেই গাড়ি করে তিনি কলেজে যাতায়াত করেন। তিনি কলেজটির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক।
যশোর সদর উপজেলার নুরপুর গ্রামের পিকুল হোসেনের অভিযোগ, কাস্টমস অফিসে চাকরি দেওয়ার কথা বলে তাঁর কাছ থেকে দুই দফায় পাঁচ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন জাকির হোসেন। কিন্তু চার বছরেও পিকুলকে চাকরি দিতে পারেননি। টাকাও ফেরত দিচ্ছেন না। উল্টো প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছেন।
এ ঘটনায় পিকুল হোসেন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালকের (কলেজ-১) বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন।
শুধু পিকুল হোসেন নয়; ইংরেজি কোচিং করতে আসা অসংখ্য শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরি দেওয়ার কথা বলে এভাবেই লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার লিখিত অভিযোগ রয়েছে জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে।
এদিকে সরকারি সিটি কলেজের ইংরেজি বিভাগের সহকর্মী ও সহকারী অধ্যাপক হাবিবুর রহমানকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তাঁর কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র, ছবি ও কাগজে স্বাক্ষর নেন জাকির হোসেন। এসব নথি দেখিয়ে হাবিবুর রহমানকে পার্সোনাল গ্রান্টার (ব্যক্তিগত জিম্মাদার) দেখিয়ে সিটি ব্যাংকের যশোর শাখা থেকে ১০ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। সেই টাকা এখন আর পরিশোধ করছেন না। ব্যাংক থেকে হাবিবুর রহমানকে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে অর্থ ঋণ আদালতে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে সহকারী অধ্যাপক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমি সিটি কলেজে প্রভাষক হিসেবে নতুন যোগদান করেছি। তখন আমার সিনিয়র সহকর্মী জাকির হোসেন বেসরকারি একটি ব্যাংক থেকে ক্রেডিট কার্ড উত্তোলনের কথা বলে আমার জাতীয় পরিচয়পত্র, ছবি ও স্বাক্ষর নেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি আমার স্বাক্ষর জাল করে আমাকে পার্সনাল গ্রান্টার হিসেবে দেখিয়ে সিটি ব্যাংক থেকে ১০ লাখ টাকা ঋণ নেন। এখন তিনি ওই ঋণের টাকা পরিশোধ করছেন না। এদিকে ওই ব্যাংক থেকে আমাকে প্রতিনিয়ত ফোন দিচ্ছে। যা আমার জন্য খুবই বিব্রতকর।’
এ ঘটনায় জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে হাবিবুর রহমান মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপপরিচালক অধ্যাপক ওয়াহিদুজ্জামানের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
এদিকে চাকরি দেওয়ার নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা নেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে অধিদপ্তর থেকে উপপরিচালক অধ্যাপক ওহেদুজ্জামান ও সহকারী পরিচালক (কলেজ-২) তানভির হাসানকে সরেজমিন তদন্ত পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। গত ৭ মে অভিযোগের বিষয়ে সরেজমিন তদন্ত করেন অধিদপ্তরের প্রতিনিধি দল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধিদপ্তরের উপপরিচালক অধ্যাপক ওহেদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা সরেজমিনের তদন্ত পরিচালনা করেছি। অভিযুক্ত ব্যক্তি, অভিযোগকারী ও সাক্ষীদের বক্তব্য শুনেছি ও লিখিত নিয়েছি। আগামী সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে জমা দেওয়া হবে।’
তদন্তের তিন মাসের মধ্যেও প্রতিবেদন দাখিল হলো না কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ওহেদুজ্জামান বলেন, ‘কত দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে সেটা চিঠিতে বলা নেই। তবে সরেজমিনে তদন্ত শেষে আমি হজব্রত পালনের জন্য সৌদি আরবে ছিলাম। এ জন্য তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে দেরি হচ্ছে।’
অভিযোগকারী পিকুল হোসেন বলেন, ‘২০১৮ সালে যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজে পড়ার সময়ে ইংরেজির কোচিং করতে গিয়ে জাকির হোসেন স্যারের সঙ্গে পরিচয়। তখন তিনি জানান, ওপর মহলে তাঁর যোগাযোগ আছে, ৫ লাখ টাকা দিলে যশোর কাস্টমস চাকরি দেওয়া যাবে।
ওই সময় অনেক কষ্ট করে দুই দফায় ব্যাংক চেকের মাধ্যমে জাকির স্যারকে পাঁচ লাখ টাকা দেই। কিন্তু চার বছরের মধ্যেও স্যার আমার চাকরি দিতে পারেননি। এরপর টাকা চাইতে গেলে জাকির স্যার হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। খারাপ আচরণ করছেন। এ বিষয়ে অভিযোগ করার পর অধিদপ্তরের তদন্ত দল আমাকে ডেকে বক্তব্য নিয়ে গেছে।’
জাকির হোসেনের প্রতারণা স্বীকার হয়েছেন আরও অনেকে। তাদের মধ্যে যশোরের কেশবপুর উপজেলার বরণডালি গ্রামের শওকত হোসেন একজন। তিনি প্রতারণার শিকার হয়ে ২০২২ সালের ৩ জুন জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে সিটি কলেজের অধ্যক্ষ বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন।
ওই অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ‘আমার তিন মেয়ে সরকারি সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজে পড়ার সময়ে জাকির হোসেনের কাছে ইংরেজি পড়ত। তখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি দেওয়ার প্রলোভন দিতেন জাকির হোসেন। এরপর ২০১৮ সালে জাকির হোসেনকে নগদ ছয় লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিনি কারও চাকরি দিতে পারেননি। টাকাও ফেরত দিচ্ছে না।’
স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা আবদুল মালেকের কাছ থেকেও জাকির হোসেন সাত লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আবদুল মালেক এ বিষয়ে ২০২১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর যশোর সিটি কলেজের অধ্যক্ষ বরাবর লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন।
ওই অভিযোগপত্রে বলা আছে, ‘স্থানীয় সরকার, পল্লি উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে পূর্ণ সচিব পদমর্যাদার এক কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করতে জাকির হোসেন প্রায় আসতেন। ওই কর্মকর্তা আমার স্যার ছিলেন। এ জন্য জাকির হোসেনের সঙ্গে পরিচয় ও সম্পর্ক হয়। তিনি আমাকে জানান, সামনে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরে নিয়োগ পরীক্ষা আছে। আপনার কোনো লোক থাকলে নিয়োগ করা যাবে। তখন আমি তার ওপর বিশ্বাস রেখে আমার আত্মীয়-স্বজনদের জানাই। আত্মীয়রা জমি বন্ধক রেখে ধার-দেনা করে সাত লাখ টাকা দেন। ওই নগদ টাকা তার কাছে দিয়েছি। চাকরি তো হয়নি বরং ঋণের বোঝা নিয়ে ভুক্তোভুগিরা হতাশায় দিন দিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।’
এ সব অভিযোগের বিষয়ে জানতে আজ রোববার কয়েক দফা যশোর সরকারি সিটি কলেজের সহকারী অধ্যাপক জাকির হোসেনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। এমনকি এই প্রতিবেদকের নাম ও পরিচয় দিয়ে তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে খুদেবার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।
এ বিষয়ে সরকারি সিটি কলেজের অধ্যক্ষ মো. জামশেদ আলী বলেন, ‘জাকিরের প্রতারণার শত শত ভুক্তভোগীরা আমাকেসহ বিভিন্ন দপ্তরে শত শত অভিযোগ দিয়েছে। যা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবরাও তদন্ত করেছে।’
অধ্যক্ষ জামশেদ আলী আরও জানান, ‘প্রতিদিনই কোনো না ভুক্তভোগী আমার কলেজে আসে তার খোঁজ নিতে। নিঃস্ব হওয়া অনেক ব্যক্তিকে ক্যাম্পাসে তার কাছে আকুতি-মিনতি করতেও দেখা গেছে।’
সূত্র : আজকের পত্রিকা