শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীকে সুশিক্ষিত, সুনাগরিক ও আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানকে তার প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, অভিভাবক, স্থানীয় লোকজন ও গভর্নিং বডির সাথে কাজের সমন্বয়, নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার মাধ্যমে সফলতা অর্জন করতে হয়। প্রতিষ্ঠানের নীতি বাস্তবায়ন ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য যিনি পরিকল্পনা গ্রহণ, পরিচালনা, নিয়ন্ত্রণ, সমন্বয় ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেন তিনিই প্রতিষ্ঠান প্রধান বা প্রশাসক। প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে যিনি বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলা করে বিপর্যয় এড়িয়ে সততার সাথে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেন তিনি সফল ও আদর্শ প্রশাসক বা প্রতিষ্ঠান প্রধান বা অধ্যক্ষ।
মনোবিজ্ঞান মানুষের আচরণ পর্যালোচনা করে। মানুষের আচরণ পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ, ব্যাখ্যা প্রদান এবং ভবিষ্যত আচরণ সম্পর্কে পূর্বোক্তি করে মনোবিজ্ঞান। মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান প্রয়োগের মাধ্যমে একজন প্রতিষ্ঠান প্রধান সফল প্রশাসক হিসেবে কর্মজীবন শেষ করতে পারেন। তাই বলা যায়, মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান অর্জন ও তার প্রয়োগ একজন প্রশাসককে সফল হতে অনেকখানি সহায়তা করে।
প্রতিষ্ঠান প্রধানের গুণাবলি
একজন প্রশাসক বা প্রতিষ্ঠান প্রধানের নিম্নবর্ণিত গুণাবলি থাকা প্রয়োজন। যথা-
শারীরিক গুণাবলি: একজন সফল প্রশাসক শারীরিকভাবে সক্ষম ও সুস্থ হবেন।
মানসিক স্বাস্থ্য: বাইরের জগতের সাথে এবং সমাজের অন্য ব্যক্তিবর্গের সাথে কার্যকরভাবে অভিযোজন করা ও সুখী বোধ করাই হলো মানসিক স্বাস্থ্য। মানসিক স্বাস্থ্যের অধিকারী প্রতিষ্ঠান প্রধান সহজেই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম। সামাজিক: পরিবারের বাইরের মানুষ অর্থাৎ সমাজের মানুষের সুখ-দু:খে তিনি এগিয়ে যাবেন, তাদের সমস্যা সমাধানে সহায়তা দেবেন।
ব্যক্তিত্ব: ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য এবং দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনেন। ব্যক্তিত্ব হলো ব্যক্তির সব বৈশিষ্ট্যের রূপ যা এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিকে পৃথক করে। সফল প্রশাসক অন্যের সাথে মিশতে পছন্দ করে, সামাজিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকে এবং যেকোনো পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন।
বুদ্ধি: মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। আর এর মূলে রয়েছে বুদ্ধি। প্রতিষ্ঠান প্রধানকে অবশ্যই বুদ্ধির অধিকারী হতে হয়। বুদ্ধি হলো ব্যক্তির এক ধরনের ক্ষমতা যা দ্বারা তিনি পরিবেশ উপযোগী আচরণ প্রদর্শন করে এবং সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেন। বুদ্ধির বলেই প্রতিষ্ঠান প্রধান তার অর্জিত জ্ঞান প্রয়োগ করে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে ভূমিকা রাখেন।
শিক্ষা: প্রতিষ্ঠান প্রধানের অবশ্যই প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকবে। সাথে সাথে তার মধ্যে অন্ত:দৃষ্টিমূলক শিক্ষার গুণ থাকতে হয়। অন্ত:দৃষ্টিমূলক শিক্ষণে ব্যক্তির প্রত্যক্ষণ জগতে হঠাৎ পরিবর্তন আসে এবং সমস্যার সমাধান পায় এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে যা তাকে সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যান।
প্রেষণা: সফল প্রশাসকের মধ্যে কাজ করার যেমন অভ্যন্তরীণ তাগিদ থাকে তেমনি তিনি তার অধীনস্থ সবাইকে কাজে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। প্রেষণা হলো এমন ক্ষমতা যা ব্যক্তিকে কাজ করতে চালিত করে। প্রতিষ্ঠান প্রধান এমনভাবে সবাইকে উদ্দীপিত করেন যাতে নিজ থেকেই সবাই প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে কাজ করে।
চিন্তন ক্ষমতা: প্রতিষ্ঠান প্রধান প্রতিদিন বিভিন্ন কাজ করেন ও সমস্যার সমাধন করেন। প্রতিটি কাজেই কমবেশি চিন্তনের প্রয়োজন হয়। চিন্তনে মস্তিস্কে কিছু ধারণা বা সংকেত এর বিন্যাস ঘটে। অত:পর ব্যক্তি সঠিক সিদ্ধান্তে আসে।
মনোভাব: মনোভাব হলো কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা অবস্থার প্রতি অনুকূল বা প্রতিকূল প্রতিক্রিয়ার প্রবণতা। প্রতিষ্ঠান প্রধান ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে সবার সাথে কাজ করেন প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে।
নৈতিক আচরণ: যেসব নিয়ম-কানুন ও আইন সমাজ অনুমোদন করে সেগুলো শিক্ষা করা এবং যেসব নিয়ম ও আচরণ অনুমোদন করে না সেগুলো বর্জন করাই হলো নৈতিক আচরণ। প্রতিষ্ঠান প্রধান প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে নৈতিকতা দ্বারাই চালিত হয়ে থাকেন।
আবেগ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা: আবেগ হলো উত্তেজিত বা আলোড়িত অবস্থা। প্রতিষ্ঠান প্রধানের যেমন আবেগ থাকবে তেমনি আবার আবেগের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাও থাকতে হয়।
সমস্যা সমাধান ক্ষমতা: প্রতিষ্ঠান প্রদান সমস্যা দেখে ভয় পাবেন না। সমস্যা তাকেই বলে যার সমাধান যোগ্যতা আছে। সমাধানের লক্ষ্যে তিনি কাজ করে যাবেন তবেই তিনি সফল।
সিদ্ধান্ত গ্রহণ: প্রতিষ্ঠান প্রধান তার প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষম হবেন।
প্রতিষ্ঠান প্রধানের কার্যাবলি
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান আহরণ করতে আসেন। এখানে তাদেরকে সমাজের উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা হয়। প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা সুশিক্ষা পাবে কিনা এটি কারো ব্যক্তিগত চেষ্টার বিষয় নয়- বরং এটি সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে অর্জিত হয়। সমষ্টিগত প্রচেষ্টা তখনই সফল হয় যখন তাদের পেছনে থাকেন একজন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন প্রতিষ্ঠান প্রধান। কোনো কল কারখানার ম্যানেজারের মনোভাব নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করা যায় না। প্রতিষ্ঠান প্রধানের স্বৈরাচারী মনোভাব থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। তাঁর ব্যক্তিত্ব, নিরপেক্ষতা, কর্তব্যপরায়নতা, সাহস, মানসিক শক্তি এসবের দ্বারা শিক্ষকদের মধ্যে প্রেষণা সৃষ্টি করে প্রতিষ্ঠানকে তিনি সামনে এগিয়ে নিয়ে যান। প্রতিষ্ঠান প্রধান যখন শিক্ষক ও কর্মচারীদের মধ্যে আমরা মনোভাব সৃষ্টি করতে পারেন তখন প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জন সহজ হয়। প্রতিষ্ঠান কারও ব্যক্তিগত সম্পদ নয়, এটি আমাদের, প্রতিষ্ঠানের সমস্যা আমাদের সমস্যা, এর দুর্নাম আমাদের দুর্নাম, এর সাফল্য আমাদের সাফল্য- এরূপ মনোভাব সব শিক্ষক ও কর্মচারীদের মধ্যে সৃষ্টি করতে হবে তবেই প্রতিষ্ঠান প্রধান প্রকৃত সফলতা পাবেন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের প্রধান কাজগুলো
(১) তত্ত্বাবধান: প্রতিষ্ঠান প্রধান শিক্ষা কার্যক্রমের তত্ত্বাবধান করেন। রুটিন অনুযায়ী ক্লাস হচ্ছে কিনা তার তদারকি করেন। সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে শিক্ষকদের দায়িত্ব পালনে প্রেষিত করেন। শিক্ষকদের নিয়ে প্রায়ই সভা করেন এবং তাদের মতামতের আলোকে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করেন। প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয় হিসাব তদারকি করেন এবং কলেজের সাধারণ তহবিল ও সংরক্ষিত তহবিল সমৃদ্ধ করার বিষয়ে সচেষ্ট থাকেন। শিক্ষক-কর্মচারীদের মাসিক বেতন সময়মতো পরিশোধের বিষয়ে তিনি খুবই সচেতন থাকেন। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সহপাঠক্রমিক কার্যাবলিও তত্ত্বাবধান করেন প্রতিষ্ঠান প্রধান।
(২) প্রশাসন: জমির দলিল, রেকর্ডপত্র, বিভিন্ন রেজিস্টার, ক্যাশবই এসব অধ্যক্ষের হেফাজতে থাকে। অফিস কক্ষ তাঁর নির্দেশে সাজানো হয়। কলেজের অভ্যন্তরীণ ও বহি:পরীক্ষা পরিচালনা কমিটি তাঁর নির্দেশে গঠিত হয়। তিনি পরীক্ষার গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। কলেজের লাইব্রেরি, হোস্টেল, ল্যাবরেটরি এসব তাঁর নির্দেশেই পরিচালিত হয়।
(৩) যোগাযোগ: প্রতিষ্ঠান প্রধানের অন্যতম কাজ হলো সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা। শিক্ষার্থী, কলেজের শিক্ষক এবং অভিভাবকের সাথে তিনি সার্বিক যোগাযোগ রাখেন। মাঝে মাঝে তাঁদের সাথে প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সভায় মিলিত হয়ে তাদের মতামতের আলোকে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন। প্রতিষ্ঠান প্রধান স্থানীয় জনগণ, সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে সুসম্পর্ক রাখেন এবং প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে তাদেরকে সম্পৃক্ত করেন।
(৪) শিক্ষা: প্রতিষ্ঠান প্রধানকে তার প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কাজে সার্বক্ষণিক ব্যস্ততায় থাকতে হয়। তাই সাধারণত তিনি শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নেন না। তবে মাঝে মধ্যে ক্লাস নিলে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হয়।
বাইরের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে মানুষকে দিয়ে সব কাজ করানো যায় না। কাজ করাতে হলে তাকে আত্মনিয়ন্ত্রণের সুযোগ দিতে হয়। মানুষ দায়িত্বশীল। সে বুদ্ধি প্রয়োগের মাধ্যমে কাজ করতে চায় এবং কাজ করে আনন্দ পায়। তাই মানুষকে ভয় দেখিয়ে সবসময় কাজ করানো যায় না। ব্যক্তির কাছ থেকে কাজ আদায় করতে হলে তার ভেতরে প্রেষণা, উদ্যম ও স্পৃহা সৃষ্টি করতে হয়, তাকে মর্যাদা দিতে হয়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্যতম উপাদান হলো শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এরা সবাই মানুষ। এদেরকে যন্ত্রপাতির মতো করে পরিচালনা করা যাবে না। সবার মানবিক দিক বিবেচনা করে প্রতিষ্ঠান প্রধান তার প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করলে ইতিবাচক ফল পাবেন। গবেষণায় দেখা গেছে, উন্নত সমাজিক ও মানসিক পরিবেশ- যেমন, ভালো মানবিক সম্পর্ক, সুষ্ঠু তত্ত্বাবধান, বন্ধুসুলভ সহকর্মী, কর্মের প্রতি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব, সুষ্ঠু নেতৃত্ব- এসব প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হয়।
শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারী, অভিভাবক, স্থানীয় জনগণ, জনপ্রতিনিধি, গভর্নিং বডি ও সংশ্লিষ্ট সবার সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে তাদের সহায়তায় প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে ভূমিকা পালন করতে পারেন কেবল প্রতিষ্ঠান প্রধান। আর প্রতিষ্ঠান প্রধানের সফলতার নেপথ্য ভূমিকা পালন করে মনোবিজ্ঞানের জ্ঞান।
লেখক : অধ্যক্ষ, মোহাম্মদপুর মহিলা কলেজ, ঢাকা