একটি পরিবার মাসে কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনির পেছনে কী পরিমাণ টাকা খরচ করে কিংবা একজন শিক্ষার্থী এক বছরে তার শিক্ষা ব্যয়ের কত শতাংশ প্রাইভেট ও কোচিংয়ের পেছনে খরচ করে— বাংলাদেশে সরকারের কাছে এ-সংক্রান্ত কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। কোচিং ও প্রাইভেট বাণিজ্যের হিসাব জানতে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে দেশে প্রথমবারের মতো একটি জরিপ করে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
জরিপে দেখা যায়, একজন শিক্ষার্থী বছরে তার শিক্ষার পেছনে যে টাকা ব্যয় করে, তার মধ্যে ৩০ শতাংশ চলে যায় কোচিং, আর হাউস টিউটরের ফি বাবদ। অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থী বছরে যদি শিক্ষা খাতে ১০০ টাকা খরচ করে, তার মধ্যে ৩০ টাকা খরচ হয় কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনিতে। ওই শিক্ষার্থীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ টাকা খরচ হয় বই, খাতা-কলম বা অন্য কোনো শিক্ষা উপকরণ কেনার পেছনে।
তৃতীয় সর্বোচ্চ টাকা ব্যয় হয় ভর্তি, সেশন ফি, পরীক্ষা ফি বাবদ, যা ১৭ শতাংশ। এ ছাড়া যাতায়াত ও টিফিন বাবদ খরচ হয় ১৬ শতাংশ, টিউশন ফিতে ১০ শতাংশ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইউনিফর্ম কেনায় ৯ শতাংশ অর্থ খরচ হয়।
বিবিএস জরিপ বলছে, সাধারণত শহরের শিক্ষার্থীরা কোচিং ও প্রাইভেট পড়তে গিয়ে বেশি টাকা খরচ করে আর তাদের খরচের হার ৩৩ শতাংশ। আর গ্রামের শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক কম টাকা খরচ করে। এই হার ২৬ শতাংশ।
বিবিএসের একজন কর্মকর্তা দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সহযোগিতায় সারাদেশের ছয় হাজার ১২০টি খানা থেকে তথ্য সংগ্রহ ও নমুনা আকারে সাতটি বিভাগের প্রায় ২৭ হাজার মানুষের সাক্ষাত্কার নিয়ে জরিপটি করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘জরিপে দেখেছি সরকারি স্কুলের চেয়ে বেসরকারি স্কুলের খরচ দিগুণ। এ ছাড়া একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষা খাতে যে পরিমাণ টাকা খরচ করে তার বড় একটি অংশই চলে যায় প্রাইভেট ও কোচিং বাণিজ্যে।
রমরমা কোচিং বাণিজ্য বন্ধে ২০১২ খ্রিস্টাব্দে হাইকোর্ট থেকে একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। কোচিং বন্ধে ওই বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও একটি নীতিমালা জারি করা হয়েছিল। যদিও ওই নীতিমালা তৈরির উদ্যোক্তা ও মন্ত্রণালয়ের একজন বিতর্কিত অতিরিক্ত সচিব ও অভিভাবকের ব্যানার ব্যাবহার করে একটি প্রতারক চক্র কোচিং মালিকদের কাছ থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে কয়েকটি ধারা শিথিল করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
কোচিং বাণিজ্য বন্ধে সরকার কঠোর অবস্থানে থাকলেও তাতে যে কোনো কাজ হয়নি তা প্রমাণ হয় বিবিএস জরিপে।
শিক্ষকরা ক্লাসে পাঠদান করার পরও প্রাইভেট ও কোচিং কতটা জরুরি তা জানতে দৈনিক শিক্ষার পক্ষ থেকে রাজধানীর কয়েকটি পরিবারে সাথে কথা বললে তাদের সবার কণ্ঠেই একই অভিযোগ। তারা বলেন, ক্লাসে যদি শিক্ষক ভালো করে পড়ান, তাহলে কোচিং ও প্রাইভেট পড়ার কোনো প্রয়োজন হয় না। কিন্তু শিক্ষকরা ক্লাসে ঠিকভাবে মনোযোগ দেন না। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের অনেক কথাই বোঝা যায় না। কোনোমতে ৪৫ মিনিট সময় কাটিয়ে দেন। অনেকটা বাধ্য হয়েই প্রাইভেট ও কোচিংয়ে ভর্তি হতে হয়েছে বলে জানান তারা।
তারা বলেন, প্রাইভেট পড়াতে অনেক শিক্ষক চাপ প্রয়োগ করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। অথচ যে শিক্ষকদের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের যত্ন করে পড়ানোর কথা, তাঁরা সেই যত্ন নিচ্ছেন ব্যাচে কোচিং করিয়ে। শিক্ষার্থীদের বাসা কিংবা কোচিংয়ে পড়িয়ে শিক্ষকরা হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচছুক ভিকারুন নিসা নূন স্কুলের একজন অভিভাবক দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, এখানে শিক্ষার্থীদের ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা এমনকি ড্রয়িংয়েও কোচিং করতে হয়। অভিভাবকদের মনে একটা বিষয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে সন্তানকে কোচিং না করালে পাস করানো যাবে না। সাংবাদিকদের কাছেও অভিযোগ না করার জন্য মৌখিক নির্দেশে দেয়া রয়েছে।
জরিপে বলা হয়, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খরচ দিগুণেরও বেশি। তাতে দেখা গেছে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত একজন শিক্ষার্থীর বার্ষিক খরচ ৩১ হাজার ৬১৪ টাকা। যার বিপরীতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত একজন শিক্ষার্থীর শুধু তার শিক্ষা খাতে বার্ষিক খরচ ৫২ হাজার টাকা। এ খরচ শুধু একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষা খাতের। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচের এই তারতম্যের মূলে ভর্তি ও রেজিস্ট্রেশন ফির আকাশ-পাতাল পার্থক্য। দেখা গেল, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বাবদ খরচ হয় গড়ে সাত হাজার টাকার মতো। অথচ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ভর্তি বাবদ খরচ হয় ১৫ হাজার ২১০ টাকা। টিউশন ফিতেও বড় ধরনের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে টিউশন ফিতে খরচ হয় সাড়ে ৯ হাজার টাকা। যার বিপরীতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খরচ হয় প্রায় ২০ হাজার টাকা। বিবিএসের করা জরিপে আরো দেখা গেছে, সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক কলেজগুলোতে বছরে শিক্ষা খাতে একজন শিক্ষার্থীর ব্যয় ১৬ হাজার ৫১৮ টাকা। কিন্তু বেসরকারি কলেজে খরচ হয় ১৭ হাজার ৩১২ টাকা। আর সরকারি কলেজগুলোতে (উচ্চ মাধ্যমিকের পরও পড়ার সুযোগ আছে যেখানে) বার্ষিক খরচ হয় ২৪ হাজার ১২২ টাকা। বেসরকারি কলেজে খরচ হয় ২৬ হাজার ৩৮৮ টাকা।
এদিকে বিবিএসের জরিপে আরো দেখা গেছে, একটি পরিবার তার আয়ের ৬০ শতাংশ অর্থ ব্যয় করে খাদ্য কেনায়। ২৯ শতাংশ টাকা খরচ করে খাদ্য বহির্ভূত পণ্য কেনায়। ৭ শতাংশ টাকা খরচ হয় শিক্ষা খাতে। আর ৪ শতাংশ টাকা খরচ হয় স্বাস্থ্য খাতে।