বর্তমান শাসনতান্ত্রিক সংকট উত্তরণে এবং নতুন সরকার গঠনে অনেকগুলো বৈধপথ খোলা রয়েছে। সংবিধান বহাল রেখে কিংবা বাতিল করে এই সংকট উত্তরণ করা সম্ভব। এ বিষয়ে অতীতের অনেক নজির রয়েছে।
১. সুপ্রিম কোর্টে রেফারেন্সের মাধ্যমে; ২. জাতীয় সরকার গঠন করে সংবিধান বাতিল এবং নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে; ৩. সদ্য বিদায়ী সরকারের নিজেদের মতো বানানো সংবিধানের অধীনে; ৪. সংবিধানের বাইরে গিয়ে ক্রান্তিকালীন বিধিমালা অনুয়ায়ী।
অতীতে ১৯৯০ এবং ২০০৭ সালে এ পদ্ধতিতেই সংকটের সমাধান করা হয়েছিল। এই ক্রান্তিকালীন বিধানের আলোকে জাতীয় সরকার গঠন এবং এর সকল কার্যক্রমের বৈধতা পরবর্তীতে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ দিবে। এছাড়া এসব ক্রান্তিকালীন বিধানাবলী পরবর্তীতে সংবিধানের অংশ করতে হবে। এর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক বা জাতীয় সনদ স্বাক্ষরিত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে তার মন্ত্রিসভার সকল সদস্য পদত্যাগ করেছেন বলে ধরে নিতে হয়। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি এই সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থাভাজন অন্য কোনো সংসদ সদস্যকে না পেলে সংসদ ভেঙে দেবেন। রাষ্ট্রপতির কাছে শুধু প্রতীয়মান হতে হবে এই সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থাভাজন আর কোনো সদস্য নেই। সংসদ বাতিল সংক্রান্ত আদেশনামায় তিনি শুধু এই কারণই উল্লেখ করবেন।
উল্লেখ্য যে, সংবিধান এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে সম্পূর্ণ দায়মুক্তি দিয়েছে। সংবিধানের ৫১ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে রাষ্ট্র্রপতির এ কার্য সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর সংসদ বাতিল করার সম্পূর্ণ এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির। তিনি তার বাতিল সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে শুধু লিখবেন, সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থাভাজন অন্য কোনো সদস্য না পাওয়ায় সংসদ বাতিল করা হলো। তবে এখানেও একটি সংকট রয়েছে। আওয়ামী লীগ ১৪তম সংবিধান সংশোধনের সময় এই পথটিও কঠিন করে গেছে। সংবিধানে উল্লেখ আছে, সংসদ বাতিলের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মন্ত্রিসভা এই সংসদের ভিতর থেকে করতে হবে। নতুন সরকার এবং সংসদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান সরকার এবং বর্তমান সংসদ বহাল আছে বলে ধরে নিতে হবে। এই সাংবিধানিক সংকট নিরসনে রাষ্ট্র্রপতি সুপ্রিম কোর্টে একটি রেফারেন্স পাঠাতে পারেন। রেফারেন্সে রাষ্ট্রপতি লিখবেন, দেশে ছাত্র-জনতার গণঅভূত্থান সংঘটিত হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ, দেশত্যাগ করেছেন এবং সংসদের অন্যান্য সদস্যদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারবিহীন থাকতে পারে না। সেহেতু জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী এবং দেশের সকল রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী এবং গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অভিপ্রায় অনুযায়ী জনস্বার্থ এবং জনশৃঙ্খলার স্বার্থে একটি জাতীয় সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। যেহেতু সুপ্রিম কোর্টের আদেশ, নির্দেশ, রায় ও নির্দেশনা সংবিধানের অংশ। সেহেতু দেশের সার্বভৌমত্ব এবং জনস্বার্থে এই কার্যক্রমের অনুমোদনের প্রয়োজন। নতুবা দেশ এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে পতিত হবে। সুতরাং দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এই রেফারেন্স অনুমোদন করা একান্ত আব্যশক। সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন পাওয়া গেলে সংবিধানের এই সংক্রান্ত সকল জটিলতার অবসান ঘটবে এবং জাতীয় সরকার গঠনে এবং তার কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনো সাংবিধানিক সংকট বা বৈধতার প্রশ্ন উত্থাপিত হবে না। দ্বিতীয়ত, যে পথটি আছে তা সংবিধানের বিদ্যমান ব্যবস্থার আলোকে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করার পর সংবিধানের আলোকে বর্তমান সংসদের মধ্য থেকে একজনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সংসদের অবশিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত একটি সরকারকে অব্যাহত রাখা। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার এবং বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। ছাত্র-জনতা কোনেভাবেই সংবিধানের এই পথটি গ্রহণ করবে না। বিশেষত: বর্তমানে যে সংসদ রয়েছে, তা একটি ধোঁকাবাজির সংসদ। ডামি নির্বাচনে গঠিত সংসদ হিসেবে জাতীয়ভাবে পরিচিতি রয়েছে। এই নির্বাচনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল প্রার্থীই ছিলেন শেখ হাসিনার অনুগত এবং অনুকম্পা প্রার্থী। নির্বাচনে জনগণের উপস্থিতিও ছিল না। কোনো বিরোধী দলও অংশ নেয়নি। প্রকৃতপক্ষে শতকরা ৫ জন লোক ভোট প্রদান করেছেন। ফলে জনগণের সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে এই সংসদ গঠিত হয়েছে। সুতরাং প্রতারণার মাধ্যমে গঠিত সংসদের এই অস্বিত্ব কেউ মেনে নিবে না।
তৃতীয়তঃ যে ব্যবস্থা রয়েছে তা হলো জনস্বার্থ এবং জনশৃঙ্খলার স্বার্থে ক্রান্তিকালীন বিধান অনুযায়ী ‘একটি জাতীয় সরকার গঠন করা। সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর পূর্বে সংবিধানে ক্রান্তিকালীন ব্যবস্থা ছিল। এই ক্রান্তিকালীন ব্যবস্থার অধীনে ১৯৯০ সালে প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে একটি একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছিল। শাহাবুদ্দীন আহমেদ সে সময় ছিলেন দেশের প্রধান বিচারপতি। তাকে যখন দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দল ঐক্যমতের ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়েছিল তখন তিনি প্রধান বিচারপতির পদ ছেড়ে যেতে রাজি ছিলেন না। আবার তৎকালীন সংবিধান অনুযায়ী তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হওয়া এবং পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতির পদে ফেরত যাওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। তখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয় দেশ ও জাতীর বৃহত্তর স্বার্থে ক্রান্তিকালীন বিধান অনুযায়ী তিনি এ দায়িত্ব গ্রহণ করবেন এবং নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর তিনি প্রধান বিচারপতি পদে ফেরত যাবেন। তার ফেরত যাওয়া এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধয়ক সরকারের সকল কার্যক্রম পরবর্তীতে বৈধতা দেয়া হবে। সে আলোকে পরবর্তীতে সংবিধানের ১১তম সংশোধনীর মাধ্যমে অস্থায়ী সরকারের সকল কার্যক্রমের বৈধতা এবং প্রধান বিচারপতি পদে ফেরার ব্যবস্থা করা হয়। ফলে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এবং অতীতের রেফারেন্স অনুযায়ী এখন একটি জাতীয় সরকার গঠন এবং পরবর্তীতে ওই সরকারের সকল কার্যক্রমের বৈধতা দেয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমাঝেতামূলক একটি জাতীয় ঘোষণা স্বাক্ষরিত হওয়া প্রয়োজন। এই ঘোষণায় সকল রাজনৈতিক দল এই মর্মে একমত হবে যে ’জাতীয় সরকার এবং এর সমস্ত কার্যক্রমের বৈধতা পরবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে অনুমোদন করা হবে। এই কাজকে আরও মজবুত এবং সাংবিধানিক ভিত্তি দিতে হলে সুপ্রিম কোর্টে একটি রেফারেন্স পাঠিয়ে অথবা রিভিউ পিটিশনের মাধ্যমে ১৪তম সংশোধনীর পূর্বে যে ক্রান্তিকালীন বিধানাবলী ছিল তা পুনরুজ্জীবিত করা যেতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে, জাতীয় সরকার যতদিন খুশী ততদিন ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারে শুধু পরবর্তীতে সংসদ তার সকল কার্যক্রমের বৈধতা দিবে। জাতীয় সরকারের সকল কার্যক্রম ‘ক্রান্তিকালীন বিধিমালা’ হিসাব জারী হবে। যেমন সামরিক আইনের সময় ‘মার্শল প্রক্লেমেশন’ হিসাবে এবং ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়কের সরকারের সময় ‘জরুরি বিধিমালা’ হিসাবে জারি হয়েছিল। এইসব প্রক্লেমেশন এবং বিধিমালা পরবর্তী অনুমোদন কিছু সংবিধানের অংশ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়। ঠিক তেমনিভাবে’ জাতীয় সরকারের ‘সকল কার্যক্রম পরবর্তীতে সংসদ অনুমোদন করবে এবং যেসব কার্যক্রম সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালিত হয় সেগুলো সংবিধানের অংশ হিসাবে পরবর্তীতে সেসব সংবিধানের অংশ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হবে।’
এই সংকট সাংবিধানিকভাবে উত্তরণের আরেকটি পথ খোলা আছে আর তা হলো রিভিউ পিটিশনের মাধ্যমে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী ফেরত আনা। ত্রয়োদশ সংশোধনী ফেরত আনার এখনো সুযোগ রয়েছে। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মামলার (বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মামলার পক্ষ হিসাবে আছেন) কোনো একটি পক্ষ অথবা সুপ্রিম কোর্টের একজন সিনিয়র আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে রিভিউ পিটিশন করবেন। আপিল বিভাগ যদি রিভিউ পিটিশন মনজুর করে তাহলে পুরনো তত্ত্ব্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় ফেরত যাওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে তত্ত্ব্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসাবে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির জায়গায় একটি বিকল্প রাখতে হবে। যেমন রাষ্ট্রপতি দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ক্রমে ‘সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি অথবা সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত কোনো বিচারপতি অথবা সকলের কাছে আস্থাভাজন একজন দল নিরপেক্ষ সুনাগরিককে প্রধান বিচারপতি হিসাবে নিয়োগ দিবেন।’
এই সংকটের সমাধান সংবিধানের বাহিরে গিয়ে করা সম্ভব। যদি সরকারকে বিপ্লবী সরকার অথবা জাতীয় সরকার হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সে ক্ষেত্রে বর্তমান সংবিধানকে বাতিল করতে হবে এবং একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। বাংলাদেশ একটি গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার। বিদ্যমান সংবিধানে উল্লেখ রয়েছে জনগণের ইচ্ছাই সর্বোচ্চ আইন। সুতরাং জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী বর্তমান সংবিধান বাতিল এবং নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা সম্ভব। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার কোনো সংবিধানের আওতায় হয়নি। ওই সরকার গঠিত হয়েছিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুযায়ী এবং পরবর্তী স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র সংবিধানের অংশ করা হয়। বর্তমানে যে সংবিধান তাও স্বাধীন দেশের জনপ্রতিনিধিরা গঠন করেননি। ওই সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্যরা। যারা পাকিস্তানের অখণ্ডতার বিশ্বাসী হয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। পৃথিবীর অসংখ্য নজির রয়েছে বিপ্লবের পর নতুন করে সংবিধান রচিত হয়েছে। জুলাই-আগস্টের এই গণঅভূত্থান একটি জাতীয় বিপ্লব। এই বিপ্লব দেশের আপামর জনগণ এবং ছাত্রসমাজ সংগঠিত করেছে। ফলে বিপ্লবত্তোর দেশে বিপ্লবীরা যেভাবে চাইবে সেভাবে ঘোষণা দিয়ে (যা বিধিমালা হিসাবে গণ্য হবে) সরকার পরিচালনা করতে পারবে। এই ঘোষণাগুলো জারি হতে পারে ‘জাতীয় ঘোষণা অথবা জাতীয় সনদ হিসাবে। জাতীয় সরকার সাধারণ সকল রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং অভ্যুত্থানকারী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত হতে পারে। এই গণঅভ্যুত্থানের সরকার রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আমূল সংস্কার এবং স্বাধীনতা, সাম্য এবং ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে নতুন এক সংবিধান প্রণয়ন করবে। এই সংবিধানের আলোকে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের পর সংসদ নির্বাচন দিয়ে নতুন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। তার আগে দেশের মানুষের আস্থা অর্জনে এবং গণতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক বিশ্বকে অভিহিত করতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং নির্বাচনের পর এই সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। তার একটি নির্দিষ্ট মেয়াদকালের ঘোষণা থাকা উচিত হবে।