ঘুষগ্রহণকারী বেশিরভাগ কর্মকর্তাই নিজের নাম রেখেঢেকে চলেন। সবার সঙ্গে ঘুষের ব্যাপারে আলোচনা করেন না। সাধারণত কর্মচারী বা ‘বিশ্বস্ত’ লোকের মাধ্যমে ঘুষ নেন তারা। এ ক্ষেত্রে অনেকটাই উদার কক্সবাজারের রামু উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদ।
তিনি ঘুষের আলাপ ও দর-কষাকষি নিজে করতে পছন্দ করেন। তার কোনো রাখঢাক নেই। নিজের অফিস কক্ষে বসেই ঘুষ নেন। তবে দরজাটা বন্ধ করে নেন। ঘুষদাতাদের তিনি সন্ধ্যার পর আসতে উৎসাহিত করেন। মঙ্গবার (৯ মে) দেশ রূপান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন শরীফুল আলম সুমন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রামু উপজেলার শিক্ষক-কর্মচারীদের কোনো কাজই ঘুষ ছাড়া হয় না। ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেন নুর মোহাম্মদ। কাজ বুঝে তিনি ঘুষের রেট ঠিক করেন। শিক্ষকপ্রতি এমপিওতে নতুন স্কুলের ক্ষেত্রে ৫০ হাজার আর পুরনো স্কুলের ক্ষেত্রে ৪০ হাজার টাকা। কর্মচারীপ্রতি এমপিওতে ঘুষ নেন ৩০ হাজার টাকা। উচ্চতর স্কেলপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে ঘুষ নেন ৮ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা। নামের ভুলসহ অন্যান্য ভুল সংশোধনের ক্ষেত্রে ঘুষ নেন ১ হাজার ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা। আর নতুন এমপিওভুক্ত স্কুলগুলোর সব শিক্ষক-কর্মচারীর এমপিওতে প্যাকেজ হিসেবে ঘুষ নেন ৩ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকা।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি রামু উপজেলার ধেছুয়া পালং উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ ওসমান গনির কাছ থেকে ৩১ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন। সেই ঘুষগ্রহণের ভিডিও হাতে এসেছে। ভিডিওতে দেখা যায়, শিক্ষা কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদ প্রধান শিক্ষক ওসমান গনির কাছ থেকে ঘুষ নিচ্ছেন। বেশ দর-কষাকষিও করেন। ভিডিও কথোপকথনে বলতে শোনা যায় :
নুর মোহাম্মদ : তাড়াতাড়ি কথা শেষ করেন। আমি আপনাদের কাজগুলোই করছি।
ওসমান গনি : ও তো আমাকে গত পরশু ১০ হাজার টাকা দিয়েছিল। সেটাও আরেকজনের কাছ থেকে ধার করে নিয়েছে। সেটা আমি আপনাকে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি নেননি। আমি আজ সকালে আরও ৫ হাজার টাকা চাপ দিয়ে নিয়েছি। কিন্তু সে আমাকে বলেছে, যদি আপনি আরও ৫ হাজার টাকা দিতে পারেন তাহলে হয়তো স্যার আমার ফাইলটা প্রসেস করত।
নুর মোহাম্মদ : ও তো এসেছিল। আমি তাকে বলেছি, আপনার হেডমাস্টারকে নিয়ে আসেন। এখনই আপনি আমাকে ২০ হাজার দেবেন।
ওসমান গনি : স্যার, এখন ১৫ হাজার এনেছি। আর ৫ হাজার কাল আপনার বিকাশ বা নগদে পাঠিয়ে দেব।
নুর মোহাম্মদ : ঠিক আছে, এমপিও হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু বাকি ২০ হাজার দেবেন। এটা নিয়ে কিন্তু নয়-ছয় করবেন না। ওই ৫ হাজার কালই দিয়ে যাবেন। আর বাকি ২০ হাজার যেদিন বেতন হবে সেদিন দেবেন। আমি এই টাকা আর চাইব না। আপনি এর জিম্মাদার হলেন।
ওসমান গনি : ঠিক আছে, স্যার। (তিনি একটি খামের ভেতরে ১৫ হাজার টাকা নুর মোহাম্মাদের হাতে দেন, তিনি তা তার ড্রয়ারে রাখেন।)
নুর মোহাম্মদ : এই এমপিওতে আপনারও একটা বিষয় ছিল।
ওসমান গনি : (এক হাজার টাকার তিনটি নোট নুর মোহাম্মাদের হাতে দেন। তিনি টাকাটা গুনে দেখে আবার ড্রয়ারে রাখেন।) এটা স্যার সামান্য, আপনাকে সম্মান করলাম।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রধান শিক্ষক ওসমান গনি যে শিক্ষকের এমপিওভুক্তির জন্য ঘুষ দেন তিনি ধেছুয়া পালং উচ্চবিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক কাম সহকারী শিক্ষক আলী আহমেদ। তার এমপিওভুক্তির জন্য ৪০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে বাধ্য করা হয়েছে। যার ২০ হাজার ওসমান গনির মাধ্যমে নেওয়া হয়েছে। একই দিন ওই স্কুলের সমাজবিজ্ঞানের সহকারী শিক্ষক কামরুন নেছার উচ্চতর স্কেলের জন্য ৮ হাজার টাকা ঘুষ নেন নুর মোহাম্মদ। আর প্রধান শিক্ষক ওসমান গনির উচ্চতর স্কেলের জন্য ৩ হাজার টাকা ঘুষ নেন। ওসমান গনির কাছ থেকে ৩১ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন।
রামুর ধেছুয়া পালং উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ওসমান গনি বলেন, ‘আমরা উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। কোনো কাজ তিনি ঘুষ ছাড়া করেন না। বাধ্য হয়ে শিক্ষকদের পক্ষে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা দিয়েছি।’
আরও জানা গেছে, পশ্চিম গোয়ালিয়া পালং এসইএসডিপি উচ্চবিদ্যালয়টি সম্প্রতি এমপিওভুক্ত হয়েছে। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছাড়াও ৫ জন সহকারী শিক্ষক ও ৫ জন তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করেছেন। ওই স্কুলের জন্য প্যাকেজ হিসেবে ৩ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন নুর মোহাম্মদ। এ ছাড়া নতুন এমপিওভুক্ত ছ্যালাতলী একে আজাদ উচ্চবিদ্যালয়েরও বেশ কয়েকজন শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করেছেন। ওই বিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষকের কাছ থেকে ৫০ হাজার ও কর্মচারীর কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা করে ঘুষ নিয়েছেন নুর মোহাম্মদ।
নাম প্রকাশ না করে রামু উপজেলার দক্ষিণ মিঠাছড়ি উচ্চবিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক জানান, ‘আমাদের স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির দুজন কর্মচারী উচ্চতর স্কেলের জন্য আবেদন করলে তাদের কাছ থেকেও ঘুষ নিয়েছেন নুর মোহাম্মদ। উচ্চতর স্কেলে তাদের মাসে মাত্র ১০০ থেকে দেড়শ টাকা বেতন বাড়বে। তাদের কাছ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা করে ঘুষ নেওয়া হয়েছে।’
গত ২৬ এপ্রিল ধেছুয়া পালং উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ওসমান গনি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদের ঘুষগ্রহণ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও কক্সবাজার জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, ‘নুর মোহাম্মদ রামু উপজেলায় যোগ দেওয়ার পর থেকেই ঘুষগ্রহণ শুরু করেন। শিক্ষক-কর্মচারীর এমপিও, বিএড স্কেল, উচ্চতর স্কেল, নাম সংশোধনসহ বিভিন্ন ফাইলে ১০ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেন। টাকা না দিলে ফাইল ছাড় করা হয় না। বাধ্য হয়েই গত ১৪ ফেব্রুয়ারি তার অফিসে আমার কাছ থেকে ৩১ হাজার টাকা ঘুষগ্রহণের সময় ভিডিও ধারণ করি।’
রামু উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘অনেকেরই বিভিন্ন ধরনের চাওয়া-পাওয়া থাকে। সেগুলো পূরণ করতে না পারলে তারা প্রোপাগান্ডা ছড়ান।’ ভিডিওতে আপনাকে সরাসরি ঘুষ নিতে দেখা যাচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আজকাল কাটিং-কুটিং করে অনেক কিছুই করা যায়। ভিডিওটা সঠিক নয়।’
গত ২৭ এপ্রিল কক্সবাজার জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নাছির উদ্দিন মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে একটি চিঠি দেন। তাতে বলা হয়েছে, রামু উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদ দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তার বিরুদ্ধে নানা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ আসছে। বিশেষ করে এমপিও ও কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে জোরপূর্বক বিভিন্ন অঙ্কের অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগীরা তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে, অডিও-ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়েছে। তাকে সতর্ক করা হলেও তিনি বেপরোয়া। তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানাচ্ছি।
মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, ‘রামু উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ আমরা পেয়েছি। এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলে তাকে সরিয়ে দেওয়া হবে। আর তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেগুলো প্রমাণিত হলে বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।’