শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ছিলো শ্যামলী রানী সরকারের। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে ১৬তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশ নিতে আবেদন করেছিলেন তিনি। প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে চূড়ান্তভাবে বাংলা বিষয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিবন্ধিতও হন। তারপর শিক্ষক পদে নিয়োগ সুপারিশ পেতে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করেছিলেন শ্যামলী। সাতক্ষীরা জেলার নিজ বাসস্থান থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরের একটি মাদরাসায় বাংলা বিষয়ের সহকারী শিক্ষক নির্বাচিত হয়ে চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছিলেন তিনি। গত ১০ অক্টোবর যোগদানও করেছিলেন। কিন্তু মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর ও বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) সঙ্গে ওই মাদরাসা কর্তৃপক্ষের সমন্বয়হীনতায় তার শিক্ষকতা স্বপ্নের বলি হতে চলেছে। চূড়ান্ত নিয়োগ সুপারিশ পেলেও যোগদানের পরেও এবারের মতো চাকরিতে থাকতে পারছেন না তিনি। দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে এ তথ্য উঠে এসেছে।
চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে শ্যামলী রানী পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলার নুরুন আলা নুর ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসার বাংলা বিষয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। তবে তাকে ক্লাস করতে দেয়া হচ্ছে না, স্বাক্ষর করতে দেয়া হচ্ছে না হাজিরা খাতাতেও।
দৈনিক আমাদের বার্তাকে শ্যামলী জানান, গত ১০ অক্টোবর তাকে নিয়োগপত্র দিয়েছিলো ওই মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। ১২ অক্টোবর তিনি যোগদান করেন। সেদিন থেকেই শুরু করেন ক্লাস নেয়া। এরপর আসে পূজার ছুটি। ছুটি শেষে ২৯ অক্টোবর প্রতিষ্ঠানে গেলে মাদরাসা প্রধান তাকে প্রতিষ্ঠানে যেতে নিষেধ করেন।
এ বিষয়ে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় ওই মাদরাসার সুপার এ বি এম রুহুল আমিনের সঙ্গে। তিনি জানান, তার প্রতিষ্ঠানের সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের একজন শিক্ষক বাংলায় সমন্বিত হয়ে এমপিওভুক্ত হয়েছেন ইতোমধ্যে। এখন শ্যামলী রানী যোগদান করলে এমপিওভুক্ত হতে পারবেন না। কারণ প্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো অনুসারে দুজন বাংলার শিক্ষক থাকা সম্ভব নয়। সুপার বলেন, তিনি চান না ওই প্রার্থীর কোনো ক্ষতি হোক। তিনি এ প্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত হতে পারবেন না, তাই তাকে ছেড়ে দিতে চেয়েছেন।
সুপার বলেন, যোগদান করিয়েও চাকরি করতে না দেয়ায় সুপার হিসেবে আমার তিন মাসের এমপিও বন্ধ হওয়ার শঙ্কা থাকলেও তাকে লিখিত প্রত্যয়ন দিচ্ছি সব কারণ জানিয়ে। এনটিআরসিএর কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিজে কথাও বলেছি। তারা বলেছেন, প্রার্থীকে যোগদান করতে না দেয়ার বিষয়টি লিখিতভাবে জানিয়ে প্রত্যয়ন দিলে ওই প্রার্থীকে অন্য কোথাও সুপারিশ করা হবে। তবে, এই সম্ভাবনায় ভরসা পান না শ্যামলী।
অন্য শিক্ষক সমন্বয় করে এমপিওভুক্ত হলেও শূন্যপদের তথ্য কেনো দেয়া হলো জানতে চাইলে সুপার বলেন, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে মাদরাসার পদবি সংশোধনের আবেদন করেছিলাম মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে। কিন্তু দীর্ঘদিন অপেক্ষা করার পরও কোনো কার্যক্রম বা অগ্রগতি দেখিনি। এক পর্যায়ে হতাশ হয়ে পড়ি। পরে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি শিক্ষক নিয়োগে শূন্যপদের তথ্য দেই এনটিআরসিএতে। পরে এ বছরের মার্চে ওই পদে প্রার্থী নির্বাচন করে এনটিআরসিএ। কিন্তু প্রায় একই সময়ে আগের সামাজিক বিজ্ঞানের শিক্ষিকাকে পদ সমন্বয় করে বাংলার শিক্ষক হিসেবে সমন্বয় করে অধিদপ্তর। ওই শিক্ষক বাংলার সহকারী শিক্ষক হিসেবে সম্প্রতি এমপিওভুক্তও হয়েছেন।
এর সমাধান কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, নতুন শিক্ষিকাকে বা আগের নিয়োগ পাওয়া শিক্ষিকাকে অন্য বিষয়ের পদে সমন্বয় করলে তারা এমপিওভুক্ত হতে পারবেন। আমার প্রতিষ্ঠানে ইংরেজির সহকারী শিক্ষকের পদ খালি আছে।
এক প্রশ্নের জবাবে সুপার আরো বলেন, গণবিজ্ঞপ্তির ফল প্রকাশের আগে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিলেও আমি এনটিআরসিএতে আবেদন করে শূন্যপদের তথ্যটি বাতিল করতে পারতাম। কিন্তু সে সুযোগ হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে মাদরাসা শিক্ষকদের এমপিওভুক্তিতে আলাদা সফটওয়্যার (মেমিস) চালু হয়। এর আগে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের ইএমআইএস সফটওয়্যারে স্কুল-কলেজের পাশাপাশি মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের তথ্যও অন্তর্ভুক্ত ছিলো। ইএমআইএস থেকে যখন মেমিসে তথ্য নিয়ে আসা হয়, দেখা যায়, বেশিরভাগ মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীর পদবি ঠিক নেই। তাই ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে পদবি সংশোধনের আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করে সংশোধন করা হয়। আট সহস্রাধিক এমপিওভুক্ত মাদরাসার পদবির তথ্য যাচাই-বাছাই ও সংশোধনের কিছুটা সময় লেগে যায়। তবে ওই সুপার পদবি সংশোধনের আবেদন করে আবার এনটিআরসিএতে তথ্য দিয়েছেন।
এ বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের শূন্যপদের তথ্য যাচাই, প্রার্থী নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা এনটিআরসিএর শিক্ষাতত্ত্ব ও শিক্ষামান শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, চূড়ান্ত সুপারিশের আগে আমাদের বিস্তারিতভাবে বিষয়টি জানালে আমরা ওই পদের জন্য প্রার্থী নির্বাচন করতাম না। তবে সেটি জানানো হয়নি। কোনো প্রার্থীকে কোনো যৌক্তিক কারণে যোগদান করতে দেয়া না হলে আমরা ওই প্রার্থীকে শূন্যপদ থাকা সাপেক্ষে অন্য প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ সুপারিশ করে থাকি। তবে এ ক্ষেত্রে ওই প্রার্থীকে যোগদান না করানোর যৌক্তিক কারণ প্রতিষ্ঠান প্রধানকে লিখিত প্রত্যয়নের মাধ্যমে এনটিআরসিএকে জানাতে হবে। পরে আমরা ওই প্রার্থীর আবেদন ও প্রত্যয়ন যাচাই করে ঊর্ধ্বতনদের অনুমোদন নিয়ে ওই প্রার্থীকে অন্য প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ সুপারিশ করার চেষ্টা করবো। তবে এ ক্ষেত্রে তার বিষয়ের শূন্যপদ থাকতে হবে।
উল্লেখ্য, মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগে লক্ষ্যে ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে সরকার এনটিআরসিএ প্রতিষ্ঠা করে প্রাক-যোগ্যতা নির্ধারণী সনদ দিয়ে আসছিলো। ওই নিবন্ধন সনদ ছাড়া কেউ শিক্ষক পদে নিয়োগের জন্য আবেদন করতে পারতেন না। নিয়োগের জন্য পরীক্ষা হতো স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। কিন্তু মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে সরকারের নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এন্ট্রি লেভেলে প্রার্থী বাছাইয়ের পুরো দায়িত্ব দেয়া হয় এনটিআরসিএকে। সেই থেকে এনটিআরসিএর বাছাই করা প্রার্থীদের প্রতিষ্ঠানে যোগদানে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠতে থাকে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও ব্যবস্থাপনা কমিটির বিরুদ্ধে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার গত তিন বছরে কয়েকশ প্রতিষ্ঠান প্রধানকে শাস্তিও দেয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সারা দেশে শ্যামলীর মতো আরো অনেক শিক্ষক নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতায় নিয়োগ পাওয়া প্রতিষ্ঠানে যোগদান করতে পারছেন না। ভুক্তভোগীরা এমন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চান।
শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে সয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।