সমবায় অধিদপ্তরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৫১১ পদে কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। নিয়োগ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে এসব পদে নতুন করে পরীক্ষা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রণালয়। ৫ জুন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও তদন্ত কমিটির মতামত বিবেচনায় নিয়ে পূর্বের পরীক্ষার ফল বাতিল করে জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়াটি নতুনভাবে এমসিকিউ পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণের আদেশ দেয়া হলো।’ তবে অভিযোগ আছে, চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে নেয়া কোটি কোটি টাকা ফেরত দেয়ার ভয়ে চেপে রাখা হয়েছে পরীক্ষা বাতিলের তথ্য। গায়েব করে ফেলা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন। এ অবস্থায় ৩ জুলাই মন্ত্রণালয়ের আরেক পত্রে, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করে নতুন নিয়োগ পরীক্ষার বিষয়ে অগ্রগতি জানাতে বলেছে মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
গত বছরের ৯ জুলাই সমবায় অধিদপ্তরের ৫১১ পদে কর্মচারী নিয়োগ ঘিরে ‘শতকোটি টাকা বাণিজ্যে মরিয়া সিন্ডিকেট’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ হয় গণমাধ্যমে। রিপোর্ট প্রকাশের পরই নিয়োগ দুর্নীতি তদন্তে একটি কমিটি গঠন করেছিল মন্ত্রণালয়। কমিটির তদন্তে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসসহ নানা অনিয়মের সত্যতা পাওয়া গেছে বলে মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে অভিযোগ উঠেছে, ঘটনার গভীরে না গিয়ে দায়সারা কাজ করে প্রতিবেদন দিয়েছে তদন্ত কমিটি। ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগ পরীক্ষার কারণে সরকারের প্রায় চার কোটি টাকা গচ্চা গেলেও তদন্ত প্রতিবেদনে জড়িতদের চিহ্নিত করা হয়নি। উলটো তাদের রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ ভুক্তভোগীরা এবার নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িতদের নাম ও তথ্য-প্রমাণসহ অভিযোগ জমা দিয়েছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে।
অভিযোগে বলা হয়েছে, একাদশ জাতীয় সংসদের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ১৮তম বৈঠকের কার্যবিবরণীতে লিপিবদ্ধ ১০(৮) এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সমবায় অধিদপ্তরে ‘৫১১টি পদে নিয়োগ, শতকোটি টাকা বাণিজ্যে মরিয়া সিন্ডিকেট’ শীর্ষক গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে ১ মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে দাখিল করতে বলা হয়েছিল। উক্ত আদেশের প্রেক্ষিতে তদন্ত দলের সদস্য পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের উপসচিব মো. শাহাদাৎ হোসেন এবং সহকারী সচিব গোলাম সরোয়ার একটি দায়সারা তদন্ত করেন। তারপরও ছয়টি অভিযোগের মধ্যে তিনটি অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। সঠিকভাবে তদন্ত হলে সব অভিযোগই প্রমাণিত হতো।
জানা গেছে, ৫১১টি পদে নিয়োগে এমসিকিউ পরীক্ষা বাতিল করে নতুন পরীক্ষা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত নিবন্ধক (প্রশাসন) ও নিয়োগ কমিটির সভাপতি মো. হাফিজুল হায়দার চৌধুরী এবং উপনিবন্ধক (প্রশাসন), নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব মো. আতিকুল ইসলামসহ অন্যান্য সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে কোনো সুপারিশ নেই তদন্ত প্রতিবেদনে।
জানা গেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র অনুযায়ী সমবায় অধিদপ্তরের নিয়োগ কমিটির সভাপতি হবেন একজন অতিরিক্ত নিবন্ধক (প্রশাসন, মাসউ ও ফাইন্যান্স)। কিন্তু সে সময়ে সমবায় অধিদপ্তরে এই পদে কেউ কর্মরত ছিলেন না। নিয়োগ বাণিজ্য কবজা করতে এ পদে কাউকে পদায়ন না করে অবৈধভাবে তৎকালীন যুগ্মনিবন্ধক হাফিজুল হায়দার চৌধুরীকে (বর্তমানে অতিরিক্ত নিবন্ধক) অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী কাউকে ঊর্ধ্বতন পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া যায় না। এছাড়া, ১ মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা থাকলেও তদন্ত দল তা করেনি। উপসচিব ড. অশোক কুমার বিশ্বাসের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রণালয়ের পৃথক তদন্ত কমিটি নিয়োগ বাণিজ্যে অবৈধ অর্থের লেনদেনের প্রমাণ পেলেও উপসচিব মো. শাহাদৎ হোসেন ও সহকারী সচিব গোলাম সরোয়ারের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-নিয়োগ বাণিজ্যে অর্থ লেনদেনের সত্যতা পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সাবেক মহাপরিচালকের পথ অনুসরণ করে ‘হাফিজ-আতিক’ সিন্ডিকেট দিয়েই বর্তমান নিবন্ধক ও মহাপরিচালক মো. শরিফুল ইসলাম এই ৫১১টি পদে নিয়োগ সম্পন্ন করতে চান। এজন্য তিনি সচিবসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করে নতুনভাবে পরীক্ষা গ্রহণের নির্দেশনাসংক্রান্ত পত্রটি জারি করিয়েছেন।
জানতে চাইলে সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধক ও মহাপরিচালক মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে এটা ঠিক। তবে এখনো নতুন করে পরীক্ষা নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি।’ পরীক্ষা বাতিল হলে জড়িতদের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলো না-এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাকে দেখতে হবে কারা জড়িত ছিল। তবে নতুন করে প্রক্রিয়া শুরু হলে আগের নিয়োগ কমিটিতে যারা ছিলেন তারা কেউ থাকবেন না।’ আপনার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ‘হাফিজ-আতিক’ সিন্ডিকেট আগের মতোই বদলি ও সংযুক্তি বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন-এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বদলি চলমান প্রক্রিয়া। এ নিয়ে কেউ বাণিজ্য করছে কিনা তা আপনি কিভাবে বুঝলেন।’ নিজের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগও তিনি অস্বীকার করেন।
সরকারি অর্থের অপচয় : সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, অনিয়মের কারণে পরীক্ষার ফল বাতিল করলেও দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দূরের কথা, প্রতিবেদনে এ সংক্রান্ত সুপারিশও নেই। এতে তাদের দুর্নীতি ও অনিয়মকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে এবং নিয়োগ পরীক্ষার খরচ বাবদ সরকারি কোষাগারের ৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা গচ্চা গেছে। যা সরকারি অর্থের অপচয়। তাহলে অপচয়কারীদের বিচার কেন হবে না-অধিদপ্তরের অনেক কর্মকর্তা এই প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলেন, যাদের লালসার কারণে সরকারি অর্থের এ অপচয় বর্তমান মহাপরিচালক তাদেরকেই আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন।
আবেদন ছাড়াই উত্তীর্ণ : জানা গেছে, বাতিল পরীক্ষায় আবেদনই করেননি এমন প্রায় ১০০ জনের নাম ছিল উত্তীর্ণদের তালিকায়। তাদের নাম ও ইউজার আইডি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে জমা দেয়া অভিযোগের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। অথচ তাদের খুঁজে পায়নি তদন্ত কমিটি। এ নিয়োগের জন্য টেলিটকের মাধ্যমে আবেদন নেয়া হয়। কিন্তু টেলিটক থেকে পাঠানো তালিকার ভিত্তিতে হাজিরা শিট তৈরি না করে পরীক্ষার্থীর তথ্য টেম্পারিং করে জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়। এমনকি কোনো কোনো পদে ছেলেকে মেয়ে বা মেয়েকে ছেলে বানিয়ে উত্তীর্ণ করা হয়। ফলে একই রোল নম্বরের অধীনে একাধিক পরীক্ষার্থী পাওয়া যায়। আবার ওই সব প্রার্থীর টেলিটক ইউজার আইডিও ভিন্ন ভিন্ন। এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি তদন্ত কমিটি।
উত্তরপত্র মূল্যায়নে অনিয়ম : জানা গেছে, পরীক্ষার্থীদের খাতা মূল্যায়নের জন্য কালো তালিকাভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠানকে কোনো চুক্তি ছাড়াই ওএমআর শিট সরবরাহ ও মূল্যায়নের দায়িত্ব দেয় নিয়োগ কমিটি। উত্তরপত্র মূল্যায়নের সময় বিভিন্ন ব্যক্তি গোপন কক্ষে ঢুকে উত্তরপত্রের নম্বর জালিয়াতি এবং অনুত্তীর্ণ, অযোগ্য প্রার্থীদের রোল ফলাফল শিটে অন্তর্ভুক্ত করে। যেখানে এমসিকিউ পরীক্ষার ফল পরীক্ষার পরদিনই দেওয়া যায়, সেখানে ২ সপ্তাহের বেশি সময় পর ফল প্রকাশ করা হয়। তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে দেরিতে ফল প্রকাশের কারণে নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং দেরিতে ফল প্রকাশ সমীচীন হয়নি বলে উল্লেখ করলেও এর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেনি।
নিবন্ধকের বিরুদ্ধেও অভিযোগ : সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে জমা দেওয়া নথিতে অভিযোগ করা হয়েছে, সরকার দুর্নীতিবিরোধী কঠোর মনোভাব দেখালেও সমবায় অধিদপ্তরে ‘দুর্নীতির ভূত’ দূর হচ্ছে না। অধিদপ্তরে যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন খোদ বর্তমান নিবন্ধক শরিফুল ইসলাম। অভিযোগ আছে, ‘হাফিজ-আতিক’ সিন্ডিকেট নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতিসহ নানা বাণিজ্য জড়িত। সমবায় অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, গত ১ বছরে ২৩৪ জনকে বদলি করা হয়েছে। ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়নি এমন আরও ৬০-৭০ জনের বদলির আদেশ। প্রতিটি বদলি থেকে সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে মোটা টাকা। সমবায় অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে উপজেলা সমবায় অফিসার বা উপসহকারী নিবন্ধকের কোনো পদ নেই। কিন্তু সংযুক্তিতে এ পদের প্রায় ৩৪ জন প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত। এছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন সমবায় কার্যালয়ে অ্যাকাউন্ট্যান্ট পদ না থাকলেও শুধু অর্থের বিনিময়ে তিনি সংযুক্তি দিয়েছেন। অধিদপ্তরের প্রশাসন শাখায় শাখা প্রধান পদে দুজন কর্মরত থাকা সত্ত্বেও সেখানে আরও দুজন উপসহকারী নিবন্ধককে সংযুক্ত করেছেন। যারা মূলত ‘হাফিজ-আতিক সিন্ডিকেট’র কালেক্টর।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সমবায় অধিদপ্তরের উপনিবন্ধক (প্রশাসন) ও বাতিল হওয়া নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব মো. আতিকুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। আর অধিদপ্তরের অতিরিক্ত নিবন্ধক (প্রশাসন) ও বাতিল হওয়া নিয়োগ কমিটির সভাপতি মো. হাফিজুল হায়দার চৌধুরীর মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।