দেশের সব শ্রেণি-পেশার জনগণকে টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনতে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি চালু করেছে সরকার। প্রাথমিকভাবে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা এবং সমতা— এই চার স্কিম নিয়ে চালু হয়েছে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি। শুরুতেই এ পেনশন কর্মসূচিতে মানুষের ব্যাপক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিদিনই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ নিবন্ধন শেষ করে চাঁদা পরিশোধ করছেন।
শুরুতে নিবন্ধন সম্পন্ন করে চাঁদা দেওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীরা। আর সব থেকে কম নিবন্ধন করে চাঁদা দিয়েছেন প্রবাসীরা। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীদের জন্য চালু করা হয়েছে প্রগতি স্কিম। অপরদিকে বিদেশিদের জন্য চালু করা হয়েছে প্রবাস স্কিম।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার পর্যন্ত চাঁদা পরিশোধসহ যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন ৬ হাজার ১০৩ জন। তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ ৩ কোটি টাকার ওপরে।
পেনশন স্কিমে নিবন্ধনের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে চাঁদা পরিশোধের ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছেন ঢাকা বিভাগের বাসিন্দারা। আর সব থেকে কম চাঁদা পরিশোধ করেছেন সিলেট বিভাগের বাসিন্দারা।
পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে পেনশন স্কিমের আওতায় আসাদের মধ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীরা রয়েছেন অর্ধেকের বেশি। তাদের জন্য চালু করা প্রগতি স্কিমে নিবন্ধন করে চাঁদা পরিশোধ করেছেন ৩ হাজার ২৫২ জন।
দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে সুরক্ষা স্কিম। অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বা স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিরা যেমন- কৃষক, রিকশাচালক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি ইত্যাদি পেশার ব্যক্তিদের জন্য এই স্কিম চালু করা হয়েছে। এই স্কিম গ্রহণ করে চাঁদা পরিশোধ করেছেন এক হাজার ৮২৮ জন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক প্রকাশিত আয় সীমার ভিত্তিতে দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী আয়ের ব্যক্তিদের (যার বর্তমান আয় সীমা বাৎসরিক সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা) জন্য চালু হওয়া সমতা স্কিমে চাঁদা দিয়েছেন ৮৭৫ জন। এছাড়া প্রবাসীদের জন্য চালু করা প্রবাসী স্কিমে ১৪৮ জন চাঁদা দিয়েছেন।
চাঁদা দেয়ায় এগিয়ে ঢাকা বিভাগ
পেনশন স্কিমে নিবন্ধন সম্পন্ন করে চাঁদা দেওয়ার ক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত শীর্ষে রয়েছে ঢাকা বিভাগ। ঢাকা বিভাগের এক হাজার ৮৩৯ জন চাঁদা পরিশোধ করেছেন। পরের স্থানে থাকা চট্টগ্রাম বিভাগের এক হাজার ৬৫৪ জন চাঁদা দিয়েছেন। তৃতীয় স্থানে রয়েছে খুলনা বিভাগ, চাঁদা দিয়েছেন ৭৩১ জন। এছাড়া রাজশাহী বিভাগের ৫৪৪, রংপুর বিভাগের ৩৯০, বরিশাল বিভাগের ৩৮৮, ময়মনসিংহ বিভাগের ৩৫২ এবং সিলেট বিভাগের ২০৫ জন চাঁদা দিয়েছেন।
চাঁদা দেয়ায় শীর্ষে ৩১-৪০ বছর বয়সীরা
পেনশন স্কিমে এখনো পর্যন্ত সব থেকে বেশি চাঁদা দিয়েছেন ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সীরা। চাঁদা পরিশোধকারীদের মধ্যে ২ হাজার ৬৫৪ জন রয়েছেন ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সী। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সী রয়েছেন এক হাজার ৮৩৭ জন।
এছাড়া ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সী রয়েছেন এক হাজার ১৯৮ জন। ১৮ থেকে ২০ বছর বয়সী ৭৬ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সী রয়েছেন ৩১৩ জন। এছাড়াও বয়স ৬০ পেরোলেও বিশেষ বিবেচনায় পেনশন স্কিমে অংশ নিয়ে চাঁদা দিয়েছেন ২৫ জন।
১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী সব বাংলাদেশি নাগরিকের জন্য সর্বজনীন এই পেনশন স্কিম চালু করেছে সরকার। তবে বিশেষ বিবেচনায় ৫০ বছরের বেশি বয়সীরাও পেনশন স্কিমে আসার সুযোগ পাচ্ছেন।
এদিকে, পেনশনের আওতায় আসাদের জমা দেওয়া চাঁদা ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ খাতে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তবে এই টাকা কোন কোন খাতে বিনিয়োগ করা হবে, তা এখনো ঠিক করা হয়নি। এ লক্ষ্যে একটি বিনিয়োগ নীতিমালা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে নীতিমালা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। নীতিমালা তৈরি হয়ে গেলে সেই অনুযায়ী পেনশন স্কিমের টাকা বিনিয়োগ করা হবে।
অবশ্য এই বিনিয়োগ নীতিমালা তৈরি করার আগেই প্রাথমিকভাবে জমা হওয়া চাঁদার টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সরকারি সিকিউরিটিজে বা ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হতে পারে।
এ বিষয়ে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে। এই জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর করবে। সেখানে একটা বোর্ড আছে, বোর্ড গাইডলাইন তৈরি করবে। আমরা একটা বিনিয়োগ বিধিমালাও তৈরি করবো। সেটার কাজ চলছে।
তিনি বলেন, বিনিয়োগ ছাড়া চলবে কীভাবে? বিনিয়োগ করতেই হবে। আমরা চাচ্ছি খুব দ্রুত বিনিয়োগ করতে। আমরা ফান্ড পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিনিয়োগের উদ্যোগ নেবো। গাইডলাইন তৈরির আগে যদি আমি সরকারি কোনো... বিনিয়োগ করি তাতেও সমস্যা নেই। যেমন আমি যদি ট্রেজারি বিল কিনি, ট্রেজারি বিলের থেকে নিরাপদ তো কিছু নেই। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে ট্রেজারি বিল কিনবে, তাতে কোনো সমস্যা নেই। তবে এখানে একটা প্রভিশন রাখা হয়েছে, তা হলো নিরাপদ বিনিয়োগের বাইরে আমরা কোনো বিনিয়োগ করবো না।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্ট ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমি মনে করি উদ্যোগটা (সর্বজনীন পেনশন) প্রশংসনীয়। তবে কথা হচ্ছে কাভারেজ কতটুকু হয়। কেননা, যারা ইনফরমাল সেক্টরে (অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে) কাজ করেন তারা কি প্রিমিয়াম দিতে পারবেন? প্রিমিয়াম দিতে না পারলে এর আওতায় আসতে পারবেন না। তারপরের বিষয় এই ফান্ড ফাইন্যান্সিং হবে, নাকি এখানে আবার সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে? এভাবে কতগুলো বিষয় আছে।
ফান্ডের টাকা কোথায় বিনিয়োগ করা যেতে পারে? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, সুষ্ঠু বিনিয়োগ করে যাতে ফান্ডটা সেভ ফাইন্যান্সিং হয়, সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। বিনিয়োগটা যাতে লাভজনক হয় তার ব্যবস্থাও করতে হবে। বিনিয়োগ থেকে যেন অবশ্যই ভালো রিটার্ন পাওয়া যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে এই ফান্ডের অর্থ বিনিয়োগ করা উচিত হবে কি না? এমন প্রশ্নে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সরকারের প্রকল্প থেকে আয় কেমন আসবে সেটা দেখতে হবে। সব প্রকল্প থেকে তো আয় হয় না। পদ্মা সেতু থেকে আয় হচ্ছে, কিন্তু অনেক প্রকল্প থেকে তো আয় হয় না। এগুলো দেখে-শুনে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সর্বজনীন পেনশন সরকার চালু করেছে ঠিকই, কিন্তু এটার পরিচালন ব্যবস্থা, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, বিনিয়োগ পলিসি, বিনিয়োগ টিম- এগুলোর কোনো কিছু ঠিক করা হয়নি। একটা সিস্টেমের মাধ্যমে (সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচি) করা হয়েছে, তবে এটা হিউজ ডেটাবেজ ম্যানেজমেন্ট ইস্যু। সেটাও ঠিক করা হয়নি।
বিশেষ করে সমতা অর্থাৎ দরিদ্রদের জন্য যে স্কিম করা হয়েছে, সেখানে কীভাবে সিলেকশনটা (দরিদ্র কি না যাচাই) হবে? আমি কি আবেদন করলেই আমাকে নেবে? তা তো হওয়ার কথা না। আমাকে তো নিজেকে দরিদ্র হিসেবে প্রমাণ করতে হবে। সেটা কিসের ভিত্তিতে হবে, এ বিষয়ে বলা হয়নি। কে সার্টিফাই করবে, কিসের ভিত্তিতে? এগুলো না করে এখন যদি আমাকে (দরিদ্র হিসেবে) দিয়ে দেয় তাহলে তো মুশকিল হয়ে যাবে। সরকারকে তো মাসে মাসে প্রচুর টাকা দিতে হবে। এছাড়া ফেক অ্যাকাউন্ট থাকতে পারে, সেগুলো দূর করবে কীভাবে? সুতরাং এখানে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে, যোগ করেন বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ।
তিনি আরও বলেন, একটা বড় অফিস লাগবে। শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকবে। সেখানে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট থাকবে। অর্গানোগ্রাম থাকতে হবে। এগুলোর কিছুই করা হয়নি। অফিসটাও ভাড়া করা হয়নি।
পেনশনের চাঁদার টাকা সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা যাবে কি না? এমন প্রশ্নে আহসান এইচ মনসুর বলেন, এটা (ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ) খুব বেশি করা ঠিক হবে না। এতে নিরাপত্তা থাকবে, কিন্তু রিটার্ন সেভাবে আসবে না। কারণ সরকারি সিকিউরিটিজে ৫-৬ শতাংশের মতো মুনাফা পাওয়া যায়। সরকারি বন্ডের সমস্যা হচ্ছে, তা বাজার ভিত্তিক না। ব্যাংকাররা রাখেন শুধু একটা কারণে, সেটা হলো এসএলআর শর্ত পূরণ করার জন্য। অনেকটা ‘যা-ই পাই তাই ভালো’। তবে যা-ই পাই তাই দিয়ে তো আর পেনশন ফান্ড চলবে না। লিকুইডিটি ম্যানেজমেন্ট চলবে।
পেনশন স্কিমে জমা হওয়া চাঁদা কোথায় বিনিয়োগ করা যেতে পারে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জন্য এটা একটা চ্যালেঞ্জ। আমাদের স্টক মার্কেট খুবই আন্ডার ডেভলপ, খুবই করাপশন। তবু বলা যায় অল্প কিছু স্টক আছে, যেগুলো রিলায়েবল। স্টক মার্কেটে কিছু বিনিয়োগের সুযোগ রাখা উচিত। এটা পৃথিবীর সব দেশেই রাখে। তবে এই বিনিয়োগ শুধু ট্রিপল ‘এ’ ক্যাটাগরির কোম্পানিতে করার সুযোগ রাখা যেতে পারে, তার বাইরে না।
শেয়ারবাজারের বাইরে কোথায় বিনিয়োগ করা যেতে পারে? এমন প্রশ্নে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বন্ড মার্কেটে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। সরকারি বন্ডের কথা যেটা বলা হলো, সেটা করা যেতে পারে। এর বাইরে ভালো কোম্পানি যদি বাজারে বন্ড ছাড়ে, সেখানে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। এছাড়া সরকার যদি ভালো প্রকল্প নিয়ে আসে, সেখানে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। যেমন- দ্বিতীয় পদ্মা সেতু বা প্রথম পদ্মা সেতু থেকে একটা বন্ড ইস্যু করলো, ৯-১০ শতাংশ মুনাফা দেয়, সেটাতে বিনিয়োগ করা যেতে পারে। তাহলে সরকারও কিছু ফান্ড পেয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, বিনিয়োগটা ভালো জায়গায় না হলে চালান গায়েব হয়ে যাবে। এটা খুবই চ্যালেঞ্জিং। এই ফান্ড যেন যেনতেনভাবে যে কোনো জায়গায় সরকারের ইচ্ছেমতো ব্যয় না হয়। রিজার্ভে যেমন হয়েছে- এই পয়রা বন্দরকে দিয়ে দাও, অমুককে দিয়ে দাও। দিয়ে দেখা গেলো ৭ বিলিয়ন ডলার নাই হয়ে গেছে। সেটা করা যাবে না।
অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত বলেন, সর্বজনীন পেনশন খুবই ভালো পদক্ষেপ। এটা সামাজিক নিরাপত্তাকে মাথায় রেখে করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে শুরু করা হয়েছে, দেখা যাক কীভাবে যায়। এমনিতে ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। পরবর্তীতে এতে যদি কোনো কিছু সংযোজন করতে হয়, করা যাবে।
পেনশন স্কিমে জমা হওয়া চাঁদা কোথায় বিনিয়োগ করা যেতে পারে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সরকারি বিনিয়োগ দেশের উন্নয়নের জন্য, সেদিক থেকে এগুলো কোনো ব্যবসায়িক বিনিয়োগ না। এগুলো (পেনশনের চাঁদার টাকা) দেশের উন্নয়নে ব্যবহার হবে। সরকার যেখানে দরকার মনে করবে, সেখানে ব্যবহার করবে। আমি এটাকে অত গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি না।