সিলিন্ডার থেকে বেইলি রোডে আগুনের সূত্রপাত - দৈনিকশিক্ষা

সিলিন্ডার থেকে বেইলি রোডে আগুনের সূত্রপাত

দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক |

চুলা জ্বালানো অবস্থায় গ্যাসের সিলিন্ডার পরিবর্তন করছিলেন চুমুক কফি হাউসের কর্মচারী। এ সময় একটি সিলিন্ডার থেকে বের হতে থাকা গ্যাস আগুনের সংস্পর্শে আসে। মুহূর্তেই আগুন ধরে যায় দোকানে।

রাজধানীর নিউ বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে আগুনের সূত্রপাত নিয়ে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য দিয়েছেন চুমুক কফি হাউসের দুই মালিক আনোয়ারুল হক ও শফিকুর রহমান। তবে এই ঘটনায় নিজেদের দায় স্বীকার করেননি তাঁরা। বলেছেন, এটি নিছক একটি দুর্ঘটনা। জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত এসব তথ্য জানিয়েছেন এ ঘটনায় রমনা থানায়  করা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আবু আনছার।

চুমুক কফি হাউস থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর পুরো ভবনে যে ভয়াবহ দৃশ্যের সৃষ্টি হয়, তার বর্ণনা দিয়েছেন সেদিন বেঁচে যাওয়া কয়েকজন ও বাইরে থেকে দেখা প্রত্যক্ষদর্শী। এ বিষয়ে পুলিশকেও সাক্ষ্য দিয়েছেন কেউ কেউ।

আগুন শুরুর সময় ঘটনাস্থলের সামনে ছিলেন ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট মোহাম্মদ সাদ্দাম। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, চুমুক কফি হাউসে আগুন দেখার পরপরই ওয়াকিটকি থেকে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে কল করেন তিনি। পরে সেখান থেকে ফায়ার সার্ভিস ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে অবগত করা হয়। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছান ততক্ষণে আগুন ভবনটির অন্যান্য তলায়ও পৌঁছে যায়। সাদ্দাম বলেন, ‘আমরা দেখতে পাই, আগুন লেগেছে ভবনটির নিচের অংশে। সেখানে কয়েকজন মিলে ফায়ার এক্সটিংগুইসার বা অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছিল না।’  

সাততলা ওই ভবনের নিচতলায় ছিল চুমুক কফি হাউস। সেই দোকানের সামনেই ছিল সরু সিঁড়ি ও লিফট। দ্বিতীয় তলায় ছিল কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁ। রেস্তোরাঁটির ব্যবস্থাপক আবদুল হালিম ঘটনার বর্ণনায় বলেন, ‘রাত তখন ৯টা ৫০ বাজে। কাচ্চি ভাইতে ৩০-৩৫ জন অতিথি ছিলেন। গ্লাসের ভেতর থেকে হঠাৎ দেখলাম বাইরে ধোঁয়া উড়ছে। তখন দৌড়ে দরজার খুলে দেখতে পাই সিঁড়ির নিচে আগুন জ্বলছে। পরে রেস্তোরাঁয় থাকা সবাইকে বের হয়ে ওপরে উঠতে বলি।’

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, কাচ্চি ভাই থেকে বের হয়েই তৃতীয় তলায় থাকা ইলিয়ন নামের একটি পোশাকের দোকানে আশ্রয় নিয়েছিলেন অনন্ত ৪৫ জন। কালো ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে না পেরে সেখানে সবাই অচেতন হয়ে যান। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সেখানে গিয়ে প্রথমেই দু-একজনকে মৃত অবস্থায় দেখতে পান। বাকিদের পেয়েছিলেন অচেতন অবস্থায়। পরে তাঁরাও মারা যান।

ইলিয়নে আশ্রয় নেওয়াদের প্রায় সবাই মারা গেলেও তৃতীয় তলারই আরেকটি দোকানে ঢুকে পড়ে প্রাণে বাঁচেন ফিরোজ আল মামুন। সেদিনের সেই ভয়াল স্মৃতি বর্ণনা করে তিনি জানান, আগুন লাগার পর হইচই শুনতে পেয়ে চতুর্থ তলা থেকে নিচে নেমে তৃতীয় তলার একটি কাপড়ের দোকানে ঢুকে পড়েন তিনি। ততক্ষণে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে পুরো কক্ষ। বিদ্যুৎও চলে গেছে। পুরো ভবনেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। প্রায় দেড় ঘণ্টা ওই কক্ষে অনেকের সঙ্গে আটকে ছিলেন ফিরোজ আল মামুন। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর তাঁকে উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।

ফিরোজ আল মামুন বলেন, ‘আমার সঙ্গে ওই দোকানে আরও বেশ কয়েকজন ছিলেন। কালো ধোঁয়ায় কেউই নিশ্বাস নিতে পারছিলেন না। দোকানে থাকা কিছু কাপড় নাকে চেপে ধরে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।’

ভবনটির পঞ্চম তলায় পিৎজা ইন নামের একটি রেস্তোরাঁয় আটকে ছিলেন মোতালেব হোসেন। তিনি একটি কোম্পানিতে কাজ করেন। মোতালেব বলেন, তাঁরা ছাদে ওঠার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ছাদে আগে থেকেই অনেকে উঠে যাওয়ায় সেখানে দাঁড়ানোর জায়গা হচ্ছিল না। সবাই সিঁড়ির ওখানে দাঁড়িয়েছিল। তবে ভাগ্যক্রমে পঞ্চম তলাতেই জায়গা পেয়েছিলেন তিনি। যখন ফায়ার সার্ভিস ক্রেন দিয়ে ছাদ থেকে মানুষ নামিয়ে নিচ্ছিল। তখন তিনিও গিয়ে ছাদে ওঠেন। সবার শেষে তাঁকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস।

ভবনটির ছাদের একাংশে অ্যামব্রোসিয়া নামের একটি রেস্তোরাঁ ছিল। এর বাইরেও ছিল কফির দোকানসহ ফাস্ট ফুডের অনেক দোকান। এমন একটি ফাস্ট ফুডে কাজ করতেন শরীফুল ইসলাম। পুলিশকে সাক্ষ্যে তিনি জানান, আগুনের খবর তাঁরা অনেক পরে পেয়েছেন। ততক্ষণে দ্বিতীয় তলায় আগুন পৌঁছে গেছে। পরে চিৎকার শুনে অনেকে ছাদে উঠে আসে, কেউ কেউ আবার নামারও চেষ্টা করে। পাঁচতলা সিঁড়ি থেকে সাততলা পর্যন্ত মানুষের ভিড় ছিল। ছাদেও প্রায় ৪০-৫০ জনের মতো মানুষ ছিল।

ছাদে আটকে পড়াদের উদ্ধারে যুক্ত ছিলেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা মোকলেছুর। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা যখন ক্রেন দিয়ে মানুষ নামাচ্ছিলাম, তখন সবার চোখমুখে ছিল আতঙ্ক। ক্রেনে উঠতে কেউ কেউ তাড়াহুড়ো করছিলেন। মুখে বলে সে জায়গার পরিস্থিতি বোঝানো যাবে না।’

ভয়াবহ এই আগুনের পরের দিনেই ফায়ার সার্ভিস পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্ত কমিটির সদস্যসচিব ঢাকা বিভাগের উপসচিব মো. ছালেহ উদ্দিন বলেন, ‘আমরা বেশ কয়েকটি বিষয় সামনে রেখে তদন্ত করছি। তদন্ত শেষে পুরো বিষয়টি জানতে পারব।’

এদিকে রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উৎপল বড়ুয়া বলেন, ‘আমরা প্রাথমিক কিছু তদন্তের কাজ শেষ করেছি। সেখানে যাদের অবহেলা দেখা যাবে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’ 

ঢাকায় রেস্তোরাঁয় সাঁড়াশি অভিযান 
বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের প্রাণহানির পর নড়েচড়ে বসেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। একযোগে ঢাকার বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে অভিযানে নেমেছে পুলিশের আটটি অপরাধ বিভাগের থানার পুলিশ। গত রোববার দুপুর থেকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত ৩৮১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে রেস্টুরেন্টের মালিক, ম্যানেজার ও স্টাফ রয়েছেন। এ ছাড়া ২২টি রেস্টুরেন্ট বন্ধ, একটি ভবন সিলগালা এবং চার প্রতিষ্ঠানকে ৬ লাখ টাকা জরিমানা করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।

ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) কে এন রায় নিয়তি বলেন, বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে ২৪ ঘণ্টার অভিযানে ৩৮১ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। ওই সব রেস্টুরেন্টে কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হচ্ছিল না। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলছিল কার্যক্রম।

অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সামনে নোটিশ টানাতে হাইকোর্টের নির্দেশ 
অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের চিহ্নিত স্থাপনার সামনে নোটিশ টানানোর নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের বেঞ্চ এ নির্দেশ দেন।

সেই সঙ্গে ঢাকার সব ভবন-স্থাপনায় পর্যাপ্ত অগ্নি প্রতিরোধব্যবস্থা আছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে কমিটি গঠন করে দিয়েছেন আদালত। কমিটিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের সচিব, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধি, ফায়ার সার্ভিসের একজন পরিচালক, বুয়েটের একজন প্রতিনিধি ও রাজউকের প্রতিনিধি রাখতে বলা হয়েছে। ওই কমিটিকে আগামী চার মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে হবে।

এদিকে গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত ঢাকা শহরের বহুতল ভবন, কারখানা ও স্থাপনায় কটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, এতে কতজন হতাহত হয়েছেন, কী কী ক্ষতি হয়েছে এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে—সে বিষয়ে প্রতিবেদন চেয়েছেন হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চ। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে এ প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। ব্লাস্ট, আসক এবং অগ্নিকাণ্ডে নিহত তানজিনা নওরীনের পরিবারের সদস্যের করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর বেঞ্চ এই আদেশ দেন। 

যেসব চাকরির পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha যেসব চাকরির পরীক্ষা স্থগিত কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসছে সরকার - dainik shiksha কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসছে সরকার উত্তরায় গুলিতে ২ শিক্ষার্থী নিহত - dainik shiksha উত্তরায় গুলিতে ২ শিক্ষার্থী নিহত ছাত্রলীগ আক্রমণ করেনি, গণমাধ্যমে ভুল শিরোনাম হয়েছে - dainik shiksha ছাত্রলীগ আক্রমণ করেনি, গণমাধ্যমে ভুল শিরোনাম হয়েছে সহিংসতার দায় নেবে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন - dainik shiksha সহিংসতার দায় নেবে না বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জবিতে আজীবনের জন্য ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আশ্বাস প্রশাসনের - dainik shiksha জবিতে আজীবনের জন্য ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আশ্বাস প্রশাসনের মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের কারণ জানালেন পলক - dainik shiksha মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধের কারণ জানালেন পলক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032379627227783