সিলেটের নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্লু-বার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজ। শিক্ষার্থী প্রায় ৪ হাজার। এক দশক ধরে প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন হুসনে আরা বেগম। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ২৫ আগস্ট শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন হুসনে আরা। গভর্নিং বডির সভাপতি পদে জেলা প্রশাসক থাকলেও অধ্যক্ষ হুসনে আরার হাতে ছিল সব। অভিযোগ উঠেছে– ভর্তি, নিয়োগ, দরপত্র ও ক্লাস ফি থেকে বছরে কোটি টাকা আদায় হলেও এর হিসাব দেননি হুসনে আরা, হয়নি অভ্যন্তরীণ অডিট।
হুসনে আরা ছাড়াও পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন গোয়াইনঘাটের সালুটিকর ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ শাকির উদ্দিন, গোয়াইনঘাট সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ ফজলুল হক, কোম্পানীগঞ্জের এম সাইফুর রহমান ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মো. নজরুল ইসলাম ও গোলাপগঞ্জের ঢাকাদক্ষিণ সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এরশাদ আলী।
শিক্ষা অধিদপ্তরের নীতিমালা অনুযায়ী, কয়েক বছর পর পর সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং প্রতিবছর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অডিট হওয়ার কথা। কিন্তু উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলো এর ধারে কাছেও যায়নি, বছরের পর বছর অডিট হয়নি। প্রতিষ্ঠানপ্রধান কাউকে কোনো হিসাব দেননি। হিসাব চেয়ে উল্টো মারধরের শিকার হয়েছেন অনেক শিক্ষক। তাই আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শিক্ষক-অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের পদত্যাগের দাবি তোলেন; পদত্যাগে বাধ্য করেন।
হুসনে আরার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ দেয় শিক্ষার্থীরা। এতে উল্লেখ করা হয়, অধিকাংশ সময় তিনি স্কুলে অনুপস্থিত থাকতেন। প্রি-নার্সারিতে ভর্তি, টেন্ডার থেকে কমিশন ও মাসিক বেতন থেকে লাখ লাখ টাকা আদায় হলেও তার হিসাব দেননি। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে গোপনে তিনি খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দেন। কম্পিউটার গায়েব ও বিজ্ঞান মেলার প্রাইজমানি নয়ছয় করেন। তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি হুসনে আরা। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘৫-৬ বছর আগে একবার অভ্যন্তরীণ অডিট হয়েছিল। তবে সে সম্পর্কে কিছু জানা নেই।’
গোয়াইনঘাটের সালুটিকর ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ শাকির উদ্দিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে থেকে তিনি দায়িত্ব পালন করলেও কখনও প্রতিষ্ঠানে অডিট করাননি। কলেজের শিক্ষকরা জানান, সালুটিকর বাজার ইজারা ছাড়াও শিক্ষার্থী ও প্রবাসীদের মাধ্যমে এই কলেজের আয় হয়। গত বছর কলেজ তহবিলের হিসাব নিয়ে অধ্যক্ষের সঙ্গে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সিরাজুল ইসলামের। পরে তাঁকে গভর্নিং বডি থেকে বাদ দেওয়া হয়। সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এক যুগে প্রায় ৪০ লাখ টাকার হিসাবে গরমিল রয়েছে। সবশেষ এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র ফি ৯৫ হাজার টাকা পরিশোধ করেননি তিনি। অথচ কলেজ তহবিল থেকে কেন্দ্রের ফি দেওয়ার জন্য ১ লাখ ৫ হাজার টাকা তুলেছেন শাকির উদ্দিন।’
সরকার পতনের পর গা-ঢাকা দেন অধ্যক্ষ। এ অবস্থায় গত ২৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা সভা করে কলেজের সিনিয়র প্রভাষক সালেহ আহমদকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেয়।
গোয়াইনঘাট সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. ফজলুল হকের বিরুদ্ধেও রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এই অধ্যক্ষ গত ১৯ আগস্ট প্রবাস থেকে পদত্যাগ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে জাফলং পাথর কোয়ারি নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে। ফজলুল হক জানান, তিনি দুই মাস আগে অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করেছিলেন। ভাইস প্রিন্সিপাল তপন কৃষ্ণ দেব বলেন, ‘মাউসি থেকে কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। তাই আর্থিক লেনদেন নিয়ে সমস্যা হচ্ছে।’
কোম্পানীগঞ্জের এম সাইফুর রহমান ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে একক স্বাক্ষরে ব্যাংক হিসাব পরিচালনা, শিক্ষককে মারধর, ছাত্রদের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগ রয়েছে। বিএনপি ঘরানার এই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে কলেজের তহবিল তছরুপের অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষার্থী ও স্থানীয় কিছু মানুষের চাপে গত ১৯ আগস্ট পদত্যাগে বাধ্য হন তিনি। এ ছাড়া গত ২৫ আগস্ট শিক্ষার্থীদের চাপে পদত্যাগ করেন গোলাপগঞ্জের ঢাকাদক্ষিণ সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এরশাদ আলী ও সিলেট নগরীর কিশোরী মোহন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গৌরী দাস।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অঞ্চল সিলেটের সহকারী পরিচালক প্রতাপ চন্দ্র চৌধুরী বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানে কয়েক বছর পর পর অডিট করা হয়। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সাধারণত প্রতিবছর গভর্নিং বডি অডিট করার কথা।’ সাইফুর রহমান কলেজের অধ্যক্ষ নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে আগেই আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে।