সুশিক্ষার আশা সুদূর পরাহত - দৈনিকশিক্ষা

সুশিক্ষার আশা সুদূর পরাহত

মো. নজরুল ইসলাম |

শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে ঢুকলেন কিন্তু সঙ্গে কোনো বই বা অন্য কোনো শিক্ষা উপকরণ নেই, আছে একটি ব্যাগ যার ভেতর থেকে তিনি কোনো চক, ডাস্টার বা মার্কার কলম বের করলেন না। তিনি বের করলেন আগ্নেয়াস্ত্র পিস্তল এবং চাকু, ছুরি ইত্যাদিসহ বেশ কয়েকটি ধারালো অস্ত্র। সেগুলো টেবিলে সাজিয়ে তিনি লেকচার দেয়া শুরু করলেন। তিনি এসব করেন বিনা প্রায় বাধায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক বা সার্জন ল্যাবরেটরিতে অথবা অপারেশন থিয়েটারে রোগীর অপারেশনের কাজে ব্যবহারযোগ্য ছুরি, কাঁচি, গজ, প্যাড ইত্যাদি ব্যবহার করে থাকেন কিন্তু শ্রেণিকক্ষে পিস্তলের মতো আগ্নেয়াস্ত্রের প্রদর্শনী ও ব্যবহার সম্ভবত পৃথিবী নামক গ্রহের বাসিন্দারা এই প্রথম প্রত্যক্ষ করলেন। পরনে ঢিলেঢালা পোশাক, চোখে পুরু কাঁচ আর মোটা ফ্রেমের চশমা, হাতে মোটা একটি বই যার পাতাগুলো বিবর্ণ প্রায়, বিদ্যায় বিদ্যাসাগর এমন প্রবীণ শিক্ষাগুরু তিনি নন, তিনি জিন্স-টি শার্ট পরিহিত একজন যুবক যিনি বিদ্যার বলে বলীয়ান না হয়ে পেশীশক্তি ও অস্ত্রের বলে বলীয়ান বলেই শ্রেণিকক্ষে নিজেকে জাহির করতে পছন্দ করেন।

শুধু কী তাই!  একদিন কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে চতুর্থ শিল্প-বিপ্লব যুগের ক্ষুদ্রাস্ত্র বিশেষজ্ঞ এই অত্যাধুনিক শিক্ষক তার এক ছাত্রকে গুলিও করে বসলেন। এতোক্ষণে প্রশাসনের টনক নড়লো, পুলিশ ডাকা হলো, পুলিশ এসে তাদের দায়িত্ব পালন করলেন। এটি কোনো সিনেমার গল্প নয়, যমুনার পূর্ব পাড়ের একটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মাত্র কয়েকদিন আগে এমন ঘটনা ঘটিয়ে কথিত শিক্ষক মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছেন। শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীকে এবং নারী সহকর্মীকে যৌন হয়রানি, মাদরাসার হুজুর কর্তৃক ছাত্রকে বলাৎকার–এমন ঘটনা হরহামেশাই ঘটে চলেছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।

একসময় বলা হতো শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। শিক্ষকতা পেশা না হয়ে নেশা হলেই বরং জাতির মঙ্গল হতো। শিক্ষকতাকে সবচেয়ে সম্মানের কাজ হিসেবে, শিক্ষককে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে দেখতে যিনি পছন্দ করতেন এমন একজন অতি সুমহান ব্যক্তি ছিলেন ভারতের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট, বিজ্ঞানী এপিজে আব্দুল কালাম। শিক্ষক এবং শিক্ষকতা সম্পর্কে তার ধারণা কেমন ছিলো তা তার লেখনী থেকেই জানা যাক। ‘Teaching is not a profession; it is a calling, a voice of moral demand that asks us to become someone we are not yet—someone different, some better and someone just beyond our reach. A career in teaching is not for achievement but is a gift to be received.’ তিনি আরো বলেন, ‘Teaching is to connect the individual with the reality. It, indeed involves creating a bridging spiritual formation. A form of community that has the capacity to support authentic education should emerge among our teachers. We cannot expect to reform education if we fail to cherish and challenge the human heart that is the source of good teaching. Good teaching is much more than technique. Good teaching, indeed, comes from the identity and integrity of the teacher.’ 

একজন শিক্ষক কেমন হবেন এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘What soil is to life on the earth, teachers are to society. Teachers, like soil are the stage on which the human generations and other constructs of human knowledge are physically supported. Just as soil shelters seeds and provides physical support for their roots as they germinate, grow and mature into adult plants that create seed and thus perpetuate the cycle, the teachers prepare and guide the young minds to assume careers and become engines of growth and progress.’   

শিক্ষাদান বিষয়টির সঙ্গে শিক্ষকের আবেগ এবং ভালোবাসা জড়িত। শিক্ষকের অন্তরে যদি এ দুটোর অভাব থাকে, শেখানোর কাজটি যদি ভালোবেসে না ঘটে, জ্ঞান বিতরণের কাজটি যদি শিক্ষকের অন্তরাত্মা থেকে উৎসারিত না হয় তবে সেটি হবে শুধু শ্রেণিকক্ষে দাঁড়িয়ে অযথা কিছু সময় ক্ষেপণ করে বেতনের অর্থ হালাল করার অপচেষ্টা মাত্র। শিক্ষক কিছু বাক্য মুখস্থ করে এসেছেন এবং ৪০-৪৫ মিনিট কোনোভাবে পার করে দেবার জন্য মঞ্চে সেগুলো আওড়ে চলেছেন অথচ তার মাথায় কাজ করছে অন্য একটি পার্ট-টাইম প্রজেক্টের কথা, কোচিং বা অন্য কোনো বিষয় যেখান থেকে আরো অতিরিক্ত কিছু অর্থযোগের আশা অথবা রাজনৈতিক বিষয় যা তার পরবর্তী প্রমোশনে সহায়তা করবে। এমন শিক্ষকের সংখ্যাই আজকাল অনেক বেশি। 

সংলিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়ম-শৃঙ্খলার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ক্যাডেট কলেজসমূহকে মডেল বা আদর্শ হিসেবে ধরা যেতে পারে যেখানে নিয়ম-শৃঙ্খলার সঙ্গে কোনো ধরনের আপস করা হয় না। পড়ার সময় পড়া, খেলার সময় খেলা-এর অন্যথা হয় না কখনো। এখানে ঝড়বৃষ্টি-বাদলেও নিয়মিত ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়, বাইরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যাই হোক না কেনো ক্যাডেট কলেজগুলোতে এর ছোঁয়াও লাগে না। আবার পাশাপাশি অনেক স্কুল বা কলেজ আছে যেখানে দেখা যায় ক্লাসের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু পণ্ডিত মহাশয়ের কোনো পাত্তাই নেই, তিনি হয়তো ভুলেই গেছেন তার দায়িত্বের কথা। অনেক স্কুল-কলেজের ভর্তির সময় সরবরাহকৃত প্রসপেক্টাসে অত্যন্ত আকর্ষণীয়, চমকপ্রদ অনেক বিষয়ের উল্লেখ করা হয় যা দেখে অভিভাবক ধরেই নেন সেটি হবে দেশের অন্যতম একটি উন্নতমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। অনেকপ্রতিষ্ঠানে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয় এমনকি অনেক বিষয়ের শিক্ষকই নেই, এক বিষয়ের শিক্ষক অন্য বিষয় গোঁজামিল দিয়ে পড়িয়ে চলেছেন দিনের পর দিন। সারা বছর ধরে ভর্তি প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখে অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে ভর্তি হলেই একটি সনদ প্রদানের গ্যারান্টি দেয়া হয়। শোনা যায়, দু’একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও না কি এমন প্রক্রিয়া চালু আছে কিছু শিক্ষক-কর্মকর্তার যোগসাজশে। রাজধানীর প্রতিটি কানাগলিতে ভুঁইফোঁড়ের মতো বিশ্ববিদ্যালয় গজাচ্ছে ক্রমাগত যেনো একটি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার একটা হিড়িক পড়ে গেছে। এ অশুভ প্রতিযোগিতা থামাবার জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ আজও দৃশ্যমান নয়। 

সবার মুখে একটি কথা প্রায় শোনা যায়-আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ। আসলে শিক্ষাক্রমে ত্রুটি নাকি ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি, নাকি দুটোই ত্রুটিপূর্ণ? এ প্রশ্ন নিয়ে বুদ্ধিজীবীরা টক শো গরম রাখেন দিনের পর দিন। অথচ সঠিক সমাধানের পথ আজও আবিষ্কৃত হলো না। দক্ষ শিক্ষকের অভাব, অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব, শিক্ষার্থীদের মনোযোগ এবং সার্বিক শৃঙ্খলার অভাব। এতো কিছুর অভাব নিয়েই একটি স্বাধীন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এগিয়ে চলেছে ঢিমে তালে। নব্যগঠিত স্বাধীন দেশের প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে এবং ড. কুদরাত-এ-খুদার সভাপতিত্বে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে গঠিত হয়েছিলো দেশের সর্বপ্রথম শিক্ষা কমিশন, কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন যা শিক্ষাব্যবস্থার একটি রূপরেখা প্রণয়ণ করে সুপারিশমালা পেশ করে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে। এ কমিশনের পূর্ণ বাস্তবায়ন আলোর মুখ না দেখলেও পরবর্তীতে গঠিত হয়েছিলো জাতীয় শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি, মজিদ খান শিক্ষাকমিশন, মফিজ উদ্দিন শিক্ষা কমিশন, শামসুল হক শিক্ষা কমিশন, কবির চৌধুরী শিক্ষা কমিশন, ড. এম এ বারী শিক্ষা কমিশন ইত্যাদি নামে প্রায় অর্ধ-ডজনেরও বেশি শিক্ষা কমিশন যা দেখে ধারণা হয় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা একটি গিনিপিগ যার ওপর যখন যেমন খুশি তেমন অস্ত্রপচার করা যায়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো যায়। আর এই সুযোগেই স্বার্থান্বেষী মহল ঝোপ বুঝে কোপ মারার অপপ্রয়াস পেয়েছেন। শহরের আনাচে কানাচে গড়ে তুলেছেন খাদ্য-গোডাউনের আদলে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়াই। সে প্রতিষ্ঠানগুলোতে না আছে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, না আছে খেলার মাঠ, না আছে যোগ্য শিক্ষক, ল্যাব অথবা লাইব্রেরি। ভাবতেও অবাক লাগে একটি বহুতল ভবনের নিচতলায় চলছে মার্কেট-শপিং মল, আর ওপরে দিব্যি চলছে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে চলেছে সনদ ক্রয়-বিক্রয়ের রমরমা বাণিজ্য। 

এ সমস্যার সমাধান কোথায়? প্রথমেই দরকার জাতীয়ভাবে আমাদের মাইন্ডসেট পরিবর্তনের। পুঁজিবাদী চেতনা থেকে বের হয়ে এসে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রকে সুসংহত করে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থা চালুর বিকল্প নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হিসেবে ‘সংখ্যা নয়, মান’ এর ওপর অধিক গুরুত্ব দিতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় না দিয়ে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে সরকারকে। এমএ পাস করার পর একজন নাগরিকের শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতে না পারা, শুদ্ধ বাংলায় একটি পত্র লিখতে না পারা শুধু লজ্জাজনকই নয়, এটি অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়ও বটে। যেকোনো মূল্যেই হোক না কেনো এ লজ্জা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।  

লেখক: যুগ্ম-পরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়     

    

 

৭ কলেজ নিয়ে পরিকল্পনা জানালেন শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha ৭ কলেজ নিয়ে পরিকল্পনা জানালেন শিক্ষা উপদেষ্টা অটোরিকশার ধাক্কায় ছাত্রীর মৃত্যু, ৮ দাবিতে জাবিতে ব্লকেড - dainik shiksha অটোরিকশার ধাক্কায় ছাত্রীর মৃত্যু, ৮ দাবিতে জাবিতে ব্লকেড শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা ছাত্রাবাস খোলার দাবিতে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ - dainik shiksha ছাত্রাবাস খোলার দাবিতে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ট্রাম্প প্রশাসনে শিক্ষামন্ত্রী হচ্ছেন লিন্ডা ম্যাকমোহন - dainik shiksha ট্রাম্প প্রশাসনে শিক্ষামন্ত্রী হচ্ছেন লিন্ডা ম্যাকমোহন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে চবিতে এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রামে আবেদন করুন, ফি ১০০০ - dainik shiksha চবিতে এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রামে আবেদন করুন, ফি ১০০০ কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বাউবিতে বিএড প্রোগ্রামে ভর্তি, আবেদন ফি ৭০০ - dainik shiksha বাউবিতে বিএড প্রোগ্রামে ভর্তি, আবেদন ফি ৭০০ চবিতে এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রামে আবেদন করুন, ফি ১০০০ - dainik shiksha চবিতে এমফিল ও পিএইচডি প্রোগ্রামে আবেদন করুন, ফি ১০০০ please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039119720458984