সেন্টমার্টিন দ্বীপে কোনো তথ্য সংগ্রহের জন্য যেতে এখন থেকে পরিবেশ অধিদপ্তর ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিতে হবে সাংবাদিকদের। এ ছাড়া দ্বীপে সেমিনার, কর্মশালা, দলবদ্ধ ভ্রমণ, শিক্ষা সফর, গবেষণা, নমুনা সংগ্রহ এবং স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান র্কতৃক পরিচালিত সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রম করতে চাইলেও পূর্বানুমতি নিতে হবে। এমন বিধিনিষেধের কথা উল্লেখ করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় গেজেট আকারে গত ২৩ মে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা দীপংকর বর।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, দুই মাস আগে এই প্রজ্ঞাপন জারি হলেও তা এখনও জানে না জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং সাধারণ মানুষ। ফলে এখনও সেন্টমার্টিনে দেদার কেনাবেচা হচ্ছে বিভিন্ন প্লাস্টিকপণ্য, রাস্তায় চলছে মোটরযান।
মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সেন্টমার্টিনে চলাচলকারী সব ধরনের জলযান এবং দ্বীপে খাবারের প্লাস্টিক পাত্র, চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিক বোতলে যে কোনো ধরনের পানীয়, বহু স্তরের প্লাস্টিকজাত মোড়কসহ, পলিথিন বা একবারের জন্য ব্যবহৃত প্লাস্টিকজাত সব পণ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ, মজুত, পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয় বা ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হলো। দ্বীপে সৈকতের ভাঙন রোধে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া জিও ব্যাগ বা পাথর ফেলে বাঁধ নির্মাণ করা যাবে না। এ ছাড়া ভ্রমণের জন্য অনলাইন রেজিস্ট্রেশন, অবতরণের জন্য ফি এবং দ্বীপে দিনপ্রতি প্রকৃত ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী পর্যটকের সংখ্যা নিশ্চিতকরণের কথাও বলা হয়েছে। তবে জনপ্রতি কত টাকা অবতরণ ফি দিতে হবে এবং প্রতিদিন কতজন পর্যটক সেখানে যেতে পারবেন তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, সেন্টমার্টিনে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার স্থাপনা সরকারি কাজ ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা যাবে না। সেইসঙ্গে দ্বীপে ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইন, বিধি ও নীতিমালার সঙ্গে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০১৬-এর সংশ্লিষ্ট বিধানগুলো প্রতিপালন করা হবে।
দ্বীপে মোটর ও যন্ত্রচালিত যানবাহন যেমন মোটরসাইকেল, ভটভটি, নছিমন, করিমন এবং ব্যাটারিচালিত যানবাহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে রিকশা, সাইকেল ও ভ্যান নির্ধারিত সড়ক দিয়ে চলাচলের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দ্বীপের কোন কোন সড়ক দিয়ে রিকশা-ভ্যান চলবে তা নির্দিষ্ট করা হয়নি। পাশাপাশি সেন্টমার্টিনে চলাচলকারী জাহাজ থেকে পাখিকে চিপস বা অন্য কোনো খাবার দেওয়াও বন্ধ করা হয়েছে।
গেজেট প্রকাশের পর দুই মাস অতিবাহিত হলেও সরেজমিন পরিদর্শনে দ্বীপে এর কোনো বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। এখনও দ্বীপের প্রায় প্রতিটি দোকান, হোটেল, মোটেলে ব্যবহার হচ্ছে পলিথিন ব্যাগসহ নানা প্লাস্টিক পণ্য। চলছে মোটরসাইকেল, ইজিবাইক, ভটভটি, নছিমন, করিমন। এ বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, পরিবেশ অধিদপ্তরের কেউ প্রজ্ঞাপনের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কথা জানাননি। সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান বলেন, তিনি প্রজ্ঞাপনের বিষয়টি জানেন না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজার কার্যালয়ের পরিচালক ফরিদ আহমেদ ও উপপরিচালক হাফিজুর রহমানও জানান, তারা প্রজ্ঞাপনের কথা জানেন না। দ্বীপে তথ্য সংগ্রহে যেতে হলে সাংবাদিকদের কেন অনুমতি লাগবে তা জানতে ফোন করা হয়েছিল পরিবেশ অধিদপ্তরের আইন শাখার পরিচালক খোন্দকার মো. ফজলুল হককে। তিনিও বলেন, প্রজ্ঞাপনের বিষয়ে এখনও জানেন না।
পরিবেশ ও প্রতিবেশগতভাবে সংকটময় অবস্থায় থাকা দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন নিয়ে আন্তর্জাতিক ওশান সায়েন্স জার্নালে ২০২০ সালে এক গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশ হয়। এতে বলা হয়, ২০৪৫ সালের মধ্যে দ্বীপটি পুরোপুরি প্রবালশূন্য হতে পারে। সেন্টমার্টিনে প্রবাল ছাড়াও বিশ্বজুড়ে বিলুপ্তপ্রায় জলপাই রঙের কাছিম, চার প্রজাতির ডলফিন, বিপন্ন প্রজাতির পাখিসহ নানা ধরনের বন্য প্রাণীর বাস। ফলে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেও বিপুলসংখ্যক পর্যটকের যাতায়াতকে দ্বীপটির অস্তিত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই দ্বীপটি রক্ষায় সেখানে পর্যটকদের রাতযাপন নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। দ্বীপের অন্যতম জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এলাকা ছেঁড়াদ্বীপ ও গলাচিপা অংশে পর্যটক প্রবেশও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সেন্টমার্টিন দ্বীপ রক্ষায় গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি এই সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে ৯ সেপ্টেম্বর আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সেন্টমার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের চিত্র তুলে ধরে পরিবেশ অধিদপ্তর একটি প্রতিবেদন দেয়। পরে ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কমিটি এসব সিদ্ধান্তে আসে। তবে অভিযোগ আছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় প্রকাশিত নতুন প্রজ্ঞাপনে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার গুরুত্বপূর্ণ বহু সিদ্ধান্ত বাদ পড়েছে।