দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক: ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের প্রবেশের প্রতিবাদ ও ছাত্ররাজনীতি প্রতিরোধের আন্দোলনে গত ২৮ মার্চ থেকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে চলছে অচলাবস্থা। আন্দোলনের অংশ হিসেবে সব ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ঈদুল ফিতর ও পহেলা বৈশাখের ছুটির আগে-পরের সব টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী বর্জন করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে, বাধ্য হয়ে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সভায় পূর্বনির্ধারিত বাকি সব টার্ম ফাইনাল পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সেই অচলাবস্থা এখনো কাটেনি। এভাবে দীর্ঘ সময় পরীক্ষাসহ অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ থাকলে সেশনজটের শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এদিকে ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে অনড় অবস্থানে রয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। যদিও ছাত্ররাজনীতি চালু হবে কি হবে না; বিষয়টি এখনো হাইকোর্টে বিচারাধীন। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের বর্জন করা টার্ম ফাইনাল পরীক্ষার নতুন তারিখ নির্ধারণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাচ ও বিভাগের শ্রেণি প্রতিনিধিদের সঙ্গে এ বিষয়ে আজ মঙ্গলবার সভা ডেকেছেন বুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার। এর আগে গত শনিবার পরীক্ষাগুলোর তারিখ পুনর্নির্ধারণ করে পুনরায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বুয়েটের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল।
বুয়েটের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পরীক্ষার বিষয়ে স্নাতক পর্যায়ের প্রতি ব্যাচের শ্রেণি প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিজ নিজ বিভাগের বিভাগীয় প্রধানরা বিভাগের শিক্ষকদের নিয়ে আলোচনা করে পরীক্ষা শুরুর সম্ভাব্য তারিখ ঠিক করে কর্র্তৃপক্ষকে জানাবেন। সব বিভাগের সব ব্যাচের পরীক্ষার পুনর্নির্ধারিত তারিখের প্রস্তাব পাওয়ার পর সব বিভাগীয় প্রধানসহ শ্রেণি-প্রতিনিধিদের সঙ্গে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, ডিন ও সংশ্লিষ্টদের আলোচনায় প্রস্তাব প্রণয়ন করা হবে। সার্বিক পর্যালোচনা শেষে চূড়ান্ত প্রস্তাব অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।
তবে পরীক্ষা কার্যক্রমে ফিরলেও মূল দাবি থেকে সরছেন না শিক্ষার্থীরা। যেকোনো ধরনের ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান অনড় রয়েছে। আন্দোলনকারীদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৭ শতাংশ শিক্ষার্থী ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলছেন, হাইকোর্টের রায়ের বিষয়টি আইনিভাবে মোকাবিলার জন্য আইনজীবী নিয়োগের বিষয়ে বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাদের কাছে নাম চেয়েছে। অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেক দিন ধরে এটি নিয়ে আলোচনা চলছে। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে বুয়েট কর্র্তৃপক্ষের জারি করা ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তির’ কার্যক্রমে হাইকোর্ট যে স্থগিতাদেশ দিয়েছে, তার অনুলিপি পাওয়া সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বুয়েটের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বুয়েটের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে আমাদের যে দাবি ছিল আমরা সেটিতেই অনড় রয়েছি। আমরা এ ইস্যুতে প্রায় সব শিক্ষার্থীই ঐক্যবদ্ধ। যত যা হয়ে যাক না কেন, আমরা আমাদের এ প্রাণের ক্যাম্পাসকে আবার আবরার ফাহাদের মৃত্যুপুরীতে পরিণত করতে দিতে পারি না।’
আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের দাবিগুলো আগামীকালের (আজ উপাচার্যের উপস্থিতিতে) মিটিংয়ে শ্রেণি প্রতিনিধিরা উপস্থাপন করবেন এবং আলোচনা হবে। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সবাই মিলে নেগোসিয়েশন (দর কাষাকষি) করা হবে। আমরা পরীক্ষায় বসব কি না, সেটা আলোচনার পর বোঝা যাবে।’
ছাত্ররাজনীতি চালুর দাবি কিছু শিক্ষার্থীর : সামাজিকভাবে অবমাননা ও র্যাগিংয়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া অভিযোগের তদন্ত, নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি চালু ও ক্যাম্পাসে জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে মানববন্ধন করেছে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতিপ্রত্যাশী কয়েকজন শিক্ষার্থী। মানববন্ধন শেষে গতকাল সোমবার বুয়েট শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে ওই শিক্ষার্থীরা বলেন, ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময় তারা একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর দ্বারা প্রায়ই অনলাইনে ও সরাসরিভাবে হেনস্তা-অপমানের শিকার হচ্ছেন। বুয়েট ক্যাম্পাসে হিযবুত তাহরীরের মতো মৌলবাদী সংগঠন যে সক্রিয় তার সত্যতা বুয়েটের সিসিটিভি ফুটেজ দেয়। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে বিষয়টি তদন্ত করে মৌলবাদী সংগঠনে জড়িতদের পরিচয় খুঁজে বের করে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়ন করে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার অনুরোধ জানান তারা।
এ বিষয়ে বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের (ডিএসডব্লিও) পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আল আমিন সিদ্দিক বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়া এবং পরীক্ষায় ফেরাতে উপাচার্য শ্রেণি প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসবেন। এই মিটিংয়ের পর আমরা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারব। ছাত্ররাজনীতির পক্ষে এবং বিপক্ষে শিক্ষার্থীদের কথাও আমরা শুনব। লিখিত আদেশ পাওয়া সাপেক্ষে আইনি প্রক্রিয়ায় কীভাবে যাওয়া যায় সেটি নিয়েও আলোচনা হবে। আর শিক্ষার্থীদের সম্ভাব্য সেশনজট নিরসনেও বিভাগীয় প্রধানরা কাজ করে যাচ্ছেন। আশা করছি খুব দ্রুত বুয়েটের অচলাবস্থা কেটে যাবে।’
২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে বুয়েটের একটি আবাসিক হলে শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ছাত্রলীগের এক নেতার কক্ষে নিয়ে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। সেই ঘটনায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বুয়েটে নিষিদ্ধ হয় ছাত্ররাজনীতি। এরপর থেকে গত সাড়ে চার বছর রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ছিল। এর মধ্যেই গত মাসে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও দপ্তর সম্পাদকসহ একদল নেতাকর্মী ক্যাম্পাসে প্রবেশ করলে পরদিন নতুন করে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধিমালা লঙ্ঘন করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ক্যাম্পাসে ঢোকার ঘটনায় পুরকৌশল বিভাগের ২১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইমতিয়াজ রাব্বি দায়ী। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন রাব্বির হলের সিট বাতিল করলে বুয়েটে ফের ছাত্ররাজনীতি ফেরানোর দাবিতে সমাবেশ ও এরপর নেতাকর্মীদের নিয়ে গত ৩১ মার্চ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে ছাত্রলীগ। এর পরদিন ছাত্ররাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ওই আদেশ স্থগিত করে হাইকোর্ট।