করোনাভাইরাস নিয়ে মানুষের যখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা তখন একদল বুদ্ধিজীবীর মন্তব্য ছিলো বিশ্বজুড়ে এটি একটি ভ্যাকসিন ভ্যাকসিন খেলা। করোনার পর্ব শেষ হতে না হতেই ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ। এই বিষয়টি নিয়েও বুদ্ধিজীবীদের মন্তব্য একেবারেই উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। অনেকটা যেনো জেনেশুনেই বিষপান করলো ইউক্রেন। মিত্রদের উসকানিতে যুদ্ধের ফাঁদে পা দিয়ে দেশটি কতোটা মাশুল গুণছে তা এখন হয়তো হাড়ে হাড়েই অনুমান করতে পারছে। কিছুদিন ঢাকঢোল পিটিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ন্যাটো এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের পাশে থাকলেও এখনকার চিত্র ভিন্ন। যুদ্ধের শুরুতে যদিও ওয়ার্ল্ড করপোরেটরা মন্তব্য করেছিলেন করোনায় বিশ্বের অস্ত্র ব্যবসা ভাটা পড়েছে বলেই রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। তবে পাল্টাপাল্টি বিধি-নিষেধের ফলে যুদ্ধের ঝাঁজ লেগেছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। হুথি বিদ্রোহীরা মাথাচাড়া দিয়েছে। রাশিয়ার কাছে ইউক্রেনের ক্রমাগত পরাজয় এবং নতজানু হওয়ার ফলে বিশ্ব মোড়লদের আত্মসম্মান রক্ষায় নতুন যুদ্ধ ইসরায়েল ফিলিস্তিন বলেও মন্তব্য করছেন অনেক সাধারণ এবং ‘অসাধারণ’ মানুষ। তবে করোনার পরপর বিশ্ব কাঁপিয়ে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিলো তার সমাপ্তি কবে হবে তা অজানা। যুদ্ধাস্ত্র এবং রসদের জন্য পরনির্ভর ইউক্রেন স্বনির্ভর রাশিয়ার সঙ্গে ছুতারের মতো কতোদিন টুংটাং করে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে তা বলা মুশকিল।
রাশিয়া যখন দুর্দান্ত দাপটের সঙ্গে পুতিনকে পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করে সেই মুহূর্তে যুদ্ধরত অপরপক্ষ ইউক্রেন যদি তার সামরিক শাখার প্রধান এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা শাখার প্রধানকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয় তাহলে দেশটির ভঙ্গুর অবস্থার বিষয়ে মন্তব্য করতে কোনো সমরবিদের প্রয়োজন হয় না। জেলেনস্কি জেনারেল ভ্যালেরি জালুঝনিকে সেনাপ্রধানের পথ থেকে সরিয়ে দেবেন এমন গুঞ্জন বেশ আগেই শোনা গিয়েছে। জনপ্রিয়তার জরিপে তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। পাশাপাশি দেশটির শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাকেও বরখাস্ত করলেন জেলেনস্কি। এই খবরগুলো মোটেই সুখকর নয় ইউক্রেনের জন্য। ইতিমধ্যে দেশটির সামরিক বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে অস্ত্র কেনার নামে আর্থিক মোটা অঙ্কের দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ফলে আমেরিকা ও ন্যাটো ইউক্রেনের বিষয়ে অনেকটাই সতর্ক হয়ে পা ফেলার নীতি অনুসরণ করে চলছে।
সেনাপ্রধানের পথ থেকে বরখাস্ত হওয়া জালুঝনি যে মন্তব্য করেছেন তাতে ভিন্ন কিছুরও ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যুদ্ধের দুই বছরের মাথায় সেনাবাহিনীর প্রধানের পথ থেকে সরে দাঁড়িয়ে জালুঝনি নিজেই বলেছেন ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের কাজ আর ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের কাজের মধ্যে পার্থক্য আছে, আর জয়ী হতে হলে ‘প্রত্যেককে’ অবশ্যই বদলাতে হবে এবং নতুন বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হবে। তাহলে কয়েক মাস আগের জনপ্রিয়তা জরিপের ফলাফল দেখেই কি সামনের দিকে হাঁটবেন এই জেনারেল? যুদ্ধের এই পর্যায়ে এসে ইউক্রেন কি তার প্রেসিডেন্ট পরিবর্তনের দিকে পা বাড়াবে? এমন প্রশ্ন থেকেই যায়। আর সেই পদক্ষেপে সদ্য বিদায়ী সামরিক প্রধান প্রেসিডেন্টের জন্য কতোটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবেন তা দেখার বিষয়।
ইউক্রেন চলমান যুদ্ধে কতোটুকু ভূমি হারিয়েছে সে প্রসঙ্গে আজকে না হয় আলোচনা নাই করলাম। কিন্তু দেশটি রাশিয়ার সামরিক হামলার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বড় ধরনের যে সংকটে রয়েছে তা মোকাবিলা করবে কীভাবে! সামরিক বাহিনী থেকে সদ্য বরখাস্ত হওয়া জেনারেল প্রেসিডেন্ট জেলনস্কিকে যদি চ্যালেঞ্জ করে বসেন তাহলে সমীকরণ পাল্টেও যেতে পারে। নানান সংকটের মধ্যে থাকা ইউক্রেন কি পারবে যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে রাশিয়ার সঙ্গে টেক্কা দিয়ে টিকে থাকতে?
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভাষায় ‘সস্তা রাজনীতির’ শিকার হয়ে ওয়াশিংটন যে সহায়তার প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলো তা অনিশ্চিত। আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনৈতিক সহায়তা নির্ভর করছে হাঙ্গেরির সমর্থনের ওপর। ইউক্রেনের অর্থনৈতিক সহায়তা পাওয়া যখন অনিশ্চয়তার মুখে তখন রাশিয়া তার সরকারি ব্যয়ের ৩০ শতাংশ যুদ্ধের পেছনে বরাদ্দ দিচ্ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর সহযোগিতায় ২০২৪ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত ইউক্রেন যুদ্ধের মাঠে টিকে থাকলেও চলতি বছরের শেষে অথবা আগামী বছরের শুরুর দিকে মস্কো, কিয়েভ, ওয়াশিংটন, ব্রাসেলস, বেইজিং, তেহেরান ও পিয়ংইয়ংয়ের যৌথ উদ্যোগে যুদ্ধের পরিণতি নির্ধারিত হতে পারে। তবে ইউনাইটেড স্টেটস আর্মির ইউরোপের সাবেক কমান্ডিং জেনারেল বেল হজেস মনে করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ইউক্রেনের বহরে যুক্ত হলে কিছুটা শক্তি সঞ্চার হবে। সেক্ষেত্রে চাপে পড়বে পুতিন বাহিনী। আর কিংস কলেজ লন্ডনের ডিপার্টমেন্ট অব ওয়ার স্টাডিজের বারবারা জানচেত্তা মনে করেন, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের পুরো সময় ধরেই রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ চললেও তা অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতে পারবে না। এদিকে ইউক্রেন এবং মলদোভাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য পদ না দিলেও বিজয় হবে পুতিনের।
লেখক: সাবেক শিক্ষক, ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়