স্মার্ট শিক্ষায় স্কুল ফিডিং - দৈনিকশিক্ষা

স্মার্ট শিক্ষায় স্কুল ফিডিং

অলোক আচার্য |

স্মার্ট বাংলাদেশ ধারণাটির সঙ্গে এখন স্মার্ট শিক্ষা যোগ হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় পরিবর্তনের ছোঁয়া এসেছে শিক্ষা খাতেও। আর এর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে স্কুল ফিডিং কার্যক্রম। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে প্রয়োজন পর্যাপ্ত পুষ্টি। পুষ্টি চাহিদা পূরণ করা হয় সাধারণত পরিবার থেকেই। তবে স্কুলে যদি এই চাহিদার একটি অংশ পূরণ করা সম্ভব হয় তাহলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সে কারণেই স্কুল ফিডিং ধারণাটি গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া শিক্ষার টেকসই লক্ষ্য অর্জনে একটি বড় বাধা হলো শিক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া।

প্রাথমিক, এসএসসি এবং এইচএসসি বহু শিক্ষার্থী ঝরে যায়। শিক্ষাক্ষেত্রে যুযোপযুগী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পরও শিক্ষার্থী বিভিন্ন স্তর থেকে ঝরে যাচ্ছে যা গুণগত শিক্ষার ক্ষেত্রে বড় বাধা। মেয়েরা বাল্যবিয়ের শিকার হন এবং ছেলেদের ক্ষেত্রে কোনো শ্রমমূলক কাজে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। শিক্ষায় টেকসই অর্জনের লক্ষ্যে এটি প্রথম বাধা। শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে পরিবর্তন ও পরিমার্জন করার উদ্দেশ্য হলো কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে শিক্ষাকে আরো যুগোপযোগী করে তোলা। শিক্ষার এই লক্ষ্য অর্জনে সরকার বহুবিধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এসব বহুবিধ উদ্দেশের মধ্য অন্যতম হলো শিক্ষায় টেকসই উন্নয়ন সাধন বা মানসম্মত শিক্ষা প্রণয়ন করা। যেখানে শিক্ষার্থীর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ঝরে পড়া হ্রাস করা একটি গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘদিনের পদক্ষেপ। এতোকিছু সত্ত্বেও ঝরে পড়া আমাদের দেশের বিভিন্ন স্তরের স্তরের একটি দীর্ঘদিনের সমস্যা হিসেবেই থেকে গেছে। এই সমস্যা ক্রমহ্রাস করার চেষ্টাও দীর্ঘদিনের। কেনো শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে বা কেনো হঠাৎ বিদ্যালয়ে আসা ছেড়ে দেয় তার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমেই রয়েছে দারিদ্র্যতা। আমাদের দেশেও ক্রমান্বয়ে শিক্ষাকে আধুনিকায়ন এবং যুগোপযোগী করে তোলার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। তারই প্রেক্ষিতে চলতি বছর থেকেই নতুন পরিবর্তিত কারিকুলামে পাঠ্যপুস্তক,শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়েছে। কিন্তু এর সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য বাস্তবায়নের প্রধান বাধা হলো শিক্ষার্থী ঝরে পড়া। 

গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাথমিকে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থীর প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০০ কিলো ক্যালরির খাবারের প্রয়োজন হয়। বিদ্যালয়েই ৩০ শতাংশ ক্যালরি দেয়ার লক্ষ্য সরকারের। অর্থাৎ প্রতিদিন ৩০০ কিলো ক্যালরির খাবার তারা বিদ্যালয়ে গিয়েই পাবে। এই লক্ষ্যে দেশের ১৫০ উপজেলায় ৩৫ লাখ প্রাথমিক শিক্ষার্থীর জন্য ‘সরকারি স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম’ হাতে নিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণায় সাবেক অর্থমন্ত্রী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচি (২০২৩-২৬) শুরুর কথা বলেছিলেন।

এর আগে দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের ৩৫ জেলার ১০৪ উপজেলায় ১৫ হাজার ৪৭০ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৯ লাখের বেশি শিক্ষার্থীর জন্য চলমান স্কুল ফিডিং কার্যক্রম সম্প্রতি শেষ হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছিলো ৩১ হাজার ৭৬১ কোটি টাকা। স্কুল ফিডিং প্রকল্পের আওতায় দেশের দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় বিস্কুট বিতরণ কর্মসূচি চালু করা হয় ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে। দফায় দফায় তা বাড়িয়ে বর্তমানে ১০৪ উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিস্কুট বিতরণ করা হয়। নতুনভাবে আবারো স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম শুরু হলে তা শিক্ষার স্থায়ী উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। শিক্ষায় বাধা হিসেবে কাজ করছে ঝরে পড়া। ঝরে পড়ার কারণ হিসেবে বেশ কিছু কারণের উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো হলো-পরিবারের অন্যত্র চলে যাওয়া, বইখাতাসহ লেখাপড়ার উপকরণ নষ্ট হয়ে যাওয়া, তাৎক্ষণিকভাবে স্কুলের ব্যয় বহনে অক্ষমতা, বাবা মাকে ঘরের কাজে সহায়তা করা, উপার্জনে বা ভাগ্যান্বেষণে নেমে পড়া, লেখাপড়ায় আগ্রহ না পাওয়া, স্কুলে যেতে নিরাপদ বোধ না করা, যাতায়াতে যানবাহন সংকট সমস্যা ইত্যাদি।

এসব বিষয় বিশ্লেষণ করলে একটি বিষয় স্পষ্ট যে পড়ালেখার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করে অনেক পরিবারই তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে এবং এক্ষেত্রে তাদের সদিচ্ছারও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। যেখানে শতভাগ মানুষকে শিক্ষার আওতায় আনা প্রয়োজন। এই ঝরে পড়া রোধের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো স্কুলে খাবার। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে যদিও এটা চ্যালেঞ্জিং বিষয় হবে। কিন্তু  বর্তমান সরকার বিগত সময়ে বাংলাদেশে এমন অনেক অসম্ভব কাজ সম্ভব করেছেন যা থেকে এটা আশা করাই যায় যে দ্রুতই স্কুল ফিডিং কার্যক্রম চালু হয়ে তা প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পরে মাধ্যমিকেও ছড়িয়ে পড়বে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল চালু করার কথা বলা হয়েছে। বিষয়টি চ্যালেঞ্জিং। অনেক বিষয় বিবেচনায় নানা প্রতিবন্ধকতা পাড় হতে হবে। কিন্তু সাফল্য এলে তা হবে অনন্য অর্জন।  জাতীয় মিড ডে মিল কার্যক্রম শুরু হওয়ায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হারও বাড়ে। স্কুলের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। শ্রেণিতে মনোনিবেশ করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে মিড ডে মিল। টিফিনে বাড়িতে যাওয়া, খাওয়া অথবা অনেক পরিবারের রান্না না হওয়ায় খালি পেটেই আবার স্কুলে আসার মতো ঘটনাগুলো আর ঘটে না। তারা স্কুলের প্রদত্ত খাবার খেয়ে স্কুলেই নিশ্চিন্ত মনে ক্লাসে মনোযোগ দিতে পারে। মূলত শিশুদের পুষ্টিমান নিশ্চিত করতে, উপস্থিতির হার বাড়াতে এবং লেখাপড়া মনোযোগ ধরে রাখতে মিড ডে মিল অত্যন্ত কার্যকর।

বিদ্যালয়গুলোতে শতভাগ ছাত্রছাত্রী উপস্থিতি একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সবকিছুর সুযোগ-সুবিধা ভালো হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষার্থী ঝরে যায়। কিন্তু অসচ্ছল পরিবারগুলো বিশেষত যারা এই কঠিন সময় মোকাবিলা করেও টিকে আছে তারা অনেকেই তাদের সন্তানদের স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে দু’বেলা খাবারের আশায় কাজে দেয় এবং মেয়েদের বিয়ে দেয়ার প্রবণতা থাকে। আর শিক্ষার্থীরাও বাড়িতে অনেক সময় পুষ্টিকর খাদ্যের অভাববোধ করে এবং দরকারি পুষ্টি পায় না। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের সন্তান যাদের বাড়িতে পুষ্টিমান নিশ্চিত সম্ভব হয় না তারাও এর ফলে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাবে। অভিভাবকরাও আগ্রহী হবে সন্তানকে নিয়মিত বিদ্যালয়ে পাঠাতে। শিক্ষকদের সঙ্গে অভিভাবকের একটু সমন্বয় থাকলেই বিষয়টি আরো সহজ হবে। এর আগে পরিকল্পনা ছিলো ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে সারা দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার পরিবেশন করা হবে। সরকার বিদ্যালয়গুলোতে ডিজিটাল করার লক্ষ্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ল্যাপটপ, প্রজেক্টর পৌঁছে দিয়েছে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়েও পৌঁছে গেছে ওয়াইফাই সংযোগ। সেখানে ডিজিটাল কন্টেটের মাধ্যমে শিশুদের পড়ালেখা করানো হচ্ছে। এতোকিছুর পরেও শিশুকে বিদ্যালয়ে ধরে রাখতে স্কুল ফিডিং কার্যক্রম জরুরি। ২০৪১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার তাগিদ রয়েছে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ হলো স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থা। আর স্মার্ট মানে ডিজিটালাইজেশনের সঙ্গে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা। প্রযুক্তির মাধ্যমে লেখাপড়া এবং পড়ার পরিবেশ আনন্দদায়ক করতে প্রযুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আর শিক্ষকের কথা বললে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এখন যারা নিয়োগ পাচ্ছেন তারা দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষিত। সরকার শিক্ষা উন্নীতকরণে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে স্কুল ফিডিং কার্যক্রম অন্যতম। আশা করা যায় এটি সফলভাবে বাস্তবায়ন হলে বিদ্যালয়ে উপস্থিতি বৃদ্ধি পাবে এবং আগ্রহও বৃদ্ধি পাবে। এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত হবে। শিক্ষার যুগান্তকারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্কুল ফিডিং বড় ভূমিকা রাখবে। সব বিবেচনায় আমাদের প্রত্যাশা গুণগত শিক্ষা। স্মার্ট শিক্ষাব্যবস্থার স্বার্থেই স্কুল ফিডিং কার্যক্রম বাস্তবায়িত হোক যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।

লেখক: শিক্ষক, পশ্চিম বনগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেড়া, পাবনা 

শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।

 

মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের - dainik shiksha সময়মতো যথাযথ অ্যাকশন নেয়া হবে : কাদের সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই: ঢাবি উপাচার্য যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো - dainik shiksha যারা নিজেদের রাজাকার বলেছে তাদের শেষ দেখে ছাড়বো সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ - dainik shiksha সায়েন্সল্যাবে কলেজ শিক্ষার্থীদের অবরোধ, যান চলাচল বন্ধ র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে - dainik shiksha র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.005634069442749