ঝড় এসেছে, স্বজন কেড়েছে
হামলা করেছে খল
শত বাধাতেও অটুট তিনি
চিত্তে অবিচল।
শান্ত সমুদ্রে কখনোই দক্ষ নাবিক তৈরি হয় না। দক্ষ নাবিক তৈরির জন্য দরকার উত্তাল সমুদ্র। উত্তাল ঢেউয়ের মাঝে শক্ত হাতে যিনি জাহাজের হাল ধরতে পারেন, সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারেন..সেইতো এক পরিপক্ক নাবিক। চারিদিকে যখন চরম প্রতিকূল অবস্থা তখন হাল ধরার মত কে থাকে? সবাই কী হাল ধরতে পারেন? দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় নৌকার হাল ধরে রাখা কঠিন। আর তখন দরকার হয় একজন কান্ডারির। তাইতো নজরুলের কলমে উঠে এসেছে নেতৃত্ব বা কান্ডারির সেই সাহসী চিত্র। ‘দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ, ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ? কবি এখানে ‘হিম্মৎ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন ব্যাপক অর্থে। তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, সংকট মোকাবিলায় সবার হিম্মৎ বা সাহস থাকে না। কবি আরো বুঝাতে চেয়েছেন যে, হিম্মতের সঙ্গে বুদ্ধি এবং প্রজ্ঞাদীপ্ত প্রেরণাও থাকতে হবে।
প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ হয়ে সমস্ত ষড়যন্ত্রের দেয়াল ভেদ করা, দোদুল্যমান দলীয় কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রাখা এবং অসীম ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক, মাদার অব হিউম্যানিটি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আজ বিস্ময়কর নেতৃত্বের এক জাদুকর।
শোষণ-নিপীড়নের সীমা যখন ছাড়িয়ে যায়, তখনই মুক্তি দূত হিসাবে আর্বিভূত হোন এমন কোন মহানায়ক যিনি দাসত্বের শৃংঙ্খল ভেঙে প্রতিষ্ঠা করেন সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা। বিশ্ব ইতিহাসের তেমনি একজন মহানায়ক হলেন..হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান। যিনি নিপীড়নের দুর্ভেদ্য দেয়াল ভেদ করে বাঙালিদের জন্য নিয়ে এসেছিলেন মুক্তির বারতা । স্বৈরাচারের নাগপাশ থেকে দেশকে মুক্ত করে বাঙালিদের উপহার দিয়েছিলে বহু বছরের কাঙ্খিত গণতন্ত্র।
তিনি ছিলেন এমনই একজন নেতা..যার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের স্ফুলিঙ্গে তিমিরাচ্ছন্ন আকাশে উদিত হয়েছিলো স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য এবং যার একটি ভাষণই ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র এবং কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে এক মহা প্রলয় সৃষ্টি করেছিলে। যা এখন বিশ্ব ইতিহাসের এক অনন্য দলিল। একটি বদ্ধ প্রকোষ্ঠে আটকে পড়া জাতিকে উদ্ধার করার জন্য এমন ভাষণ বিশ্বে বিরল। কৃমি কীটে খাওয়া দগ্ধ শাসন ব্যবস্থার বেড়াজালে বন্দি হয়ে পড়েছিলো বাঙালি জাতি, আর এমনই এক প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি কালো অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়ে আলোর স্ফূরন ছড়িয়েছিলো এবং বাঙালির হৃদয়ে স্বাধীনতার স্বাদ পেতে ঝংকার তুলেছিলো। অর্ধশত বছর আগে দেয়া সেই কালজয়ী ভাষণেই মুক্তির আস্বাদন পেয়েছিলো বাঙালি জাতি। ঐতিহাসিক সেই ভাষণটি বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলো এবং এমনই অনুপ্ররণামূলক ভাষণ ছিলো সেটি, যা মানুষের হৃদয়কে নাড়া দিয়েছিলো এবং বুকের তাজা রক্ত দিতে বাঙালি ন্যূনতম কুণ্ঠাবোধ করেনি।
এমন সাহসী ও কালজয়ী নেতার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা তার বাবার মতই নেতৃত্ব গুণের অধিকারী হয়েছেন। তার বাবার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের মুন্সিয়ানা জাতি আজ দেখছে। বাংলাদেশ নামক সোনার বাংলার চেহারাই তিনি পাল্টে দিয়েছেন উন্নয়ন আর ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় উন্নয়নটি হয়েছে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে । স্বপ্নের সোনার বাংলায় স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মান শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্বের এক উজ্বল দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের গোড়াপত্তন হয় ২৩ জুন ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব পাকিস্থান আওয়ামী মুসলীম লীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এই দলকে এগিয়ে যেতে হয়েছে এবং বর্তমানে এই দলটি বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালোনা করে যাচ্ছে। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে দলটির নির্বাচনী প্রতীক নৌকা। দলটির প্রথম সভাপতি ছিলেন মাওলানা হামিদ খান ভাসানী। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান দলটির সভাপতি হোন এবং দলকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু এবং তার দল আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। বঙ্গবন্ধু দলটির তিনবার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। আর তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা দলটির ৯ বার সভাপতি নির্বাচিত হোন। ৭৩ বছরে দলটির ২১টি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মে মাতৃভূমি বাংলাদেশে পিতামাতাসহ পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য নিহত হওয়ার ৬ বছর পর প্রবাস থেকে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে ই শেখ হাসিনার অনুপস্থিতে তাকে সর্ব সম্মতিক্রমে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ৪২ বছর ধরে শেখ হাসিনা দলটির সভাপতি হিসাবে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। তার সাহসী এবং দক্ষ নেতৃত্বে দলটি আজ ঐক্যবদ্ধ। চার দশকের বেশি সময় ধরে বৃহৎ একটি দলকে নেতুত্ব দেয়া সোজা কোন বিষয় নয়। দুর্গম গিরি কান্তার মরু তাকে অতিক্রম করতে হয়েছে। পরতে পরতে তাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ। প্রাণনাশের হুমিকতে সব সময়ই থেকেছেন। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ২১ আগস্টে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এবং মানুষের ভালোবাসায় প্রাণে বেঁচে যান তিনি। তবে এটা ঠিক বঙ্গবন্ধু কন্যা হিসাবে মৃত্যুকে তিনি কখনোই ভয় করেননি।
সমালোচনা থাকতেই পারে, কিন্তু মানুষের কল্যাণে তিনি যে কিছু করতে চান সেটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে। করোনা মহামারিতে সারা বিশ্ব যখন দিশেহারা..তখন তিনি খুব ধৈর্য্য আর প্রজ্ঞার সঙ্গে সেটা মোকাবিলা করেছেন। করোনা মোকাবিলায় বিশ্বের মধ্যে তিনি অনন্য নজীর স্থাপন করেছেন। তিনি তার পিতার মতই একজন স্বপ্নদ্রষ্টা নেতা। তিনি বাংলার প্রতিটি মানুষকে নিয়ে ভাবেন। গরীব-দুখীদের কষ্ট মাথায় রেখে তিনি ভূমিহীনদের ঘর বানিয়ে দিয়েছেন। সেটা সবাই জানে। নারীর ক্ষমতায়নে শেখ হাসিনার অবদান এক বড় মাইলফলক হয়ে থাকবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের যে স্বপ্ন বাঙালিদের ছিলো..তিনি সেটাও পূরণ করেছেন। বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নিয়ে গেছেন শেখ হাসিনা। তার পরবর্তী লক্ষ্য বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিনত করা।
স্বৈরশাসনের অবসান, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারসহ নানা অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে রাজপথে থেকেছেন। বহবার গ্রেফতার হয়েছেন, কারাবরণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ৯ মাস গৃহবন্দি থেকেছেন। সরকার গঠনের পর থেকে বাংলাদেশকে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন। তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। আর সেটা তিনি সুন্দরভাবে করতে পেরেছেন। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করা, বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণ, মডেল ইকোনোমিক রাষ্ট্র বানানোসহ নানা উন্নয়নমূলক কাজ করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। সমুদ্রে অধিকার প্রতিষ্ঠার অনন্য নজীর স্থাপন করেছেন।
বাংলাদেশের সক্ষমতা আজ বিশ্ব জেনে গেছে। বাংলাদেশকে দেখে বিশ্বের অনেক দেশের শেখার আছে অনেক কিছু। পদ্মাসেতু, বঙ্গবন্ধু সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল, বঙ্গবন্ধু রেলসেতু, মাতারবাড়ি প্রকল্প, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, পায়রা সমুদ্রবন্দর সহ বহু মেগা প্রকল্পের সফল সমাপ্তি ঘটতে চলেছে। শেখ হাসিনা এমন একজন নেতা যিনি তার সিদ্ধান্তে অবিচল থাকতে পারেন। ইস্পাত কঠিন সমস্যাকে তিনি দক্ষতার সঙ্গে সমাধান করতে পারেন। তিলে তিলে আন্দোলন সংগ্রাম করে বহু ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে তিনি আজ এ পর্যায়ে এসেছেন।
১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার সভায় গুলি ও বোমা হামলায় ৫০ জন আহত হয়। এত হুমকি আর আক্রমনের পরেও তিনি নিজেকে শান্ত রেখেছেন, দলকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা করেছেন।
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন সারথী এই নেতা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন..বাংলার প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌছে দেবেন। তিনি তার সেই প্রতিশ্রুতি রেখেছেন।
ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরীর কাজ বহুদূর এগিয়েছে। ১৮ কোটি মানুষের ছোট একটি দেশকে নেতৃত্ব দেয়ার কাজ তো এত সহজ নয়। নানা প্রকার সমস্যার জালে আটকে পড়া বিভিন্ন সেক্টরকে তিনি সমস্যামুক্ত করেছেন। দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তার অনন্য ভূমিকা রয়েছে। যাহোক তার সঠিক নেতৃত্বে দেশের সবগুলো খাত সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নিত্যপন্যের অতিরিক্ত দাম সাধারন মানুষকে বেকায়দায় ফেলেছে। বৈশ্বিক বাজারের প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের একটি অপার সম্ভাবনা রয়েছে, আর সেটি হলো, কৃষি। কৃষিকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েই এগোতে হবে আমাদের। দেশে বেকারত্ব চরম আকার ধারণ করেছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকারের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। কিন্তু কর্মসংস্থানের পরিধি আরো বহুগুণে বাড়াতে হবে।
তিনি ইতোমধ্যে জাতিকে একটি নতুন শিক্ষাক্রম উপহার দিয়েছেন। শিক্ষা খাতকে সমৃদ্ধ করতে তিনি বহু স্কুল, কলেজ জাতীয়করণ করেছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কাছে শিক্ষকরা প্রত্যাশা করেন..তিনি সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে একসঙ্গে জাতীয়করণ করে দেবেন। শেখ হাসিনা শিক্ষকদের এই প্রত্যাশা পূরণ করবেন বলে শিক্ষকরা বিশ্বাস করেন।
বঙ্গবন্ধু কন্যার কাছে সমগ্র জাতির একটি বড় চাওয়া, আর সেটি হলো, দুর্নীতিমুক্ত ও বেকারমুক্ত একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। দুর্নীতি দমনে শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্স নীতির সফল বাস্তবায়ন দেখতে চায় দেশবাসী। সর্বোপরি..দ্রব্যমূল্যের যে লাগামহীন উর্ধ্বগতি চলছে-তাতে সাধারন মানুষ দিনে দিনে অসহায় হয়ে পড়ছে। স্মার্ট বাংলাদেশের রূপকারকে অবশ্যই এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই পারেন..সাধারন মানুষকে এ যাতনার হাত থেকে মুক্ত করতে। শেখ হাসিনা এমন এক নেতা যিনি বাঙালির আগামী দিনগুলো নিয়ে ভাবেন। তার সুদক্ষ নেতৃত্বে ইতোমধ্যে সার্বজনীন পেনশন স্কিম প্রক্রিয়াটি বহুদূর এগিয়েছে। জাতীয় সংসদ অনুমোদিত হয়েছে। সার্বজনীন পেনশন অবশ্যই তার দূরদর্শী নেতৃত্বের বহিঃপ্রকাশ। জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদ দমনে তার সাহসী নেতৃত্ব অবশ্যই প্রশংসনীয়।
লেখক : মাজহার মান্নান, কবি ও কলামিস্ট