সোনালী ব্যাংকের ৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত হলমার্কের বিরুদ্ধে হওয়া দুর্নীতির ১১টি মামলার মধ্যে একটি মামলার রায় ঘোষণার দিন ঠিক করেছে আদালত। এটি হবে হলমার্কের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া ১১ মামলার প্রথম রায়।
রোববার মামলাটির যুক্তিতর্ক গ্রহণ শেষে ঢাকার ১ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মো. আবুল কাশেম আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন।
রায়ে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যাশা করেছেন দুদকের প্রসিকিউটর মীর আহমেদ আলী সালাম।
যুক্তিতর্ক শেষে তিনি বলেন, দণ্ডবিধির ৪২০/৪০৬/৪০৯ ও ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এবং ২০১২ সালের মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২) ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন আদালত। যেখানে দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায় প্রতারণার জন্য সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড, ৪০৬ ধারায় অপরাধজনক বিশ্বাস ভঙ্গের জন্য সর্বোচ্চ ৩ বছর ও ৪০৯ ধারায় সরকারী কর্মচারী কর্তৃক অপরাধজনক বিশ্বাস ভঙ্গের জন সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় সর্বোচ্চ ৭ বছর এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২) ধারায় সর্বোচ্চ ১২ বছর করে কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। আমরা আশা করছি আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।
২০১০-২০১২ খ্রিষ্টাব্দের মার্চের মধ্যে সোনালী ব্যাংকসহ দেশি-বিদেশি ৪১টি ব্যাংকের বিভিন্ন শাখা থেকে হলমার্ক ৩ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা তুলে নেয়। এর মধ্যে জালিয়াতির খবর প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর মাত্র ৫৬৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা পরিশোধ করে হলমার্ক। এরপর গত এক যুগে একটি টাকাও আদায় হয়নি। প্রতি মাসে ১০০ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধের শর্তে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে জামিন পান মামলার অন্যতম আসামি হলমার্কের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম। কিন্তু তিনি ছয় বছর জামিনে বাইরে থাকলেও এক টাকাও পরিশোধ না করায় ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জুলাই তার জামিন বাতিল করে ফের কারাগারে পাঠায় আদালত।
২০১২ খ্রিষ্টাব্দে ফান্ডেড (সোনালী ব্যাংক থেকে সরাসরি ঋণ) ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ৩৪ হাজার ৮৭৭ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২৭ জনকে আসামি করে ১১টি মামলা করে দুদক। তবে রায়ের তারিখ ঘোষণা হওয়া মামলায় মোট আসামি ১৯ জন। এরা হলেন, প্রতিষ্ঠানটি ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ, তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, জেনারেল ম্যানেজার তুষার আহমেদ, সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের জিএম মীর মহিদুর রহমান, উপ- মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মো. সফিজউদ্দিন আহমেদ, ডিএমডি মাইনুল হক (বর্তমানে ওএসডি), এজিএম মো. কামরুল হোসেন খান (সাময়িক বরখাস্ত) ও নকশী নিটের এমডি মো. আবদুল মালেক কারাগারে রয়েছেন।
এ ছাড়া জামিনে রয়েছেন দুই উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) শেখ আলতাফ হোসেন (সাময়িক বরখাস্ত) ও সাভারের হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জামাল উদ্দিন সরকার।
হলমার্কের মামলায় পলাতক আসামিদের মধ্যে রয়েছেন, প্যারাগন গ্রুপের এমডি সাইফুল ইসলাম রাজা, সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের জিএম ননী গোপাল নাথ (বর্তমানে ওএসডি), প্রধান কার্যালয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবির, সহকারী উপমহাব্যবস্থাপক মো. সাইফুল হাসান, নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল মতিন, ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের মালিক মীর জাকারিয়া, টি অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তসলিম হাসান, ডিএমডি (ওএসডি) সোনালী ব্যাংক মো. আতিকুর রহমান ও সোনালী ব্যাংক ধানমণ্ডি শাখার বর্তমান জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুন্নেসা মেরি।
এ মামলায় অস্তিত্বহীন ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের নামে প্রায় ৫২৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ১০ কোটি ৫০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। মামলায় আদালত চার্জশিটে মোট ৮১ জন সাক্ষীর মধ্যে ৫৭ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন । মামলাটিতে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করে আদালত।
হলমার্ক কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হুমায়ুন কবির বিদেশে বিলাসী জীবনযাপন করছেন। নিয়ম ভেঙে হলমার্ক গ্রুপকে অন্তত ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ পাইয়ে দেয়ার ঘটনা ফাঁস হলে মামলা করে দুদক। এ মামলা থেকে বাঁচতে তিনি বিদেশে পালিয়ে যান। প্রথমে মালয়েশিয়ায় আত্মগোপন করেন। সেখান থেকে যাতায়াত শুরু করেন কানাডায়।
মালয়েশিয়া ও কানাডা- দু’দেশেই থাকেন নিজস্ব প্রাসাদোপম বাড়িতে, চলাচল করেন বিলাসবহুল গাড়িতে। দেশ দুটিতেই তিনি সম্পদও গড়েছেন। সেই সম্পদ দেখাশোনার জন্য আলাদা লোকও রেখেছেন। তার দুই মেয়ে পড়াশোনা করছে কানাডায়। সূত্র জানায়, হুমায়ুন কবিরের বিরুদ্ধে দুদকের দায়ের করা ৩৭ মামলায় ওয়ারেন্ট আছে। দেশে এলেই গ্রেফতার হবেন এই আশঙ্কায় তিনি বিদেশেই নিরাপদ মনে করছেন। তবে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য নানা মাধ্যমে চেষ্টা চলছে।