হাইকোর্টের রায় অমান্য করায় শিক্ষকদের ৭ মাস থেকে বেতন ভাতা বন্ধ - দৈনিকশিক্ষা

হাইকোর্টের রায় অমান্য করায় শিক্ষকদের ৭ মাস থেকে বেতন ভাতা বন্ধ

দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক |

দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক : হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়ন না করায় রংপুরের পীরগাছায় একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারিরা সাত মাস থেকে বেতন ভাতা না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। শুধু তাই নয়, একটি পক্ষকে সুবিধা প্রদানের জন্য হাইকোর্টের রায়ের তথ্য গোপনেরও অভিযোগ রয়েছে। বিদ্যালয়টির নাম পাঠক শিকড় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। এটির অবস্থান উপজেলার কান্দি ইউনিয়নে।

অভিযোগ ও সরেজমিনে জানা গেছে, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে পাঠক শিকড় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে অবৈধভাবে গোপনে ম্যানেজিং কমিটি গঠন করেন তৎকালীন  প্রধান শিক্ষক বিধান চন্দ্র রায়। জুন মাসের শেষ সপ্তাহে গোপনে কমিটি গঠনের বিষয়টি ফাঁস হয়। এ বিষয়ে একাধিক দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করলেও সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ক্ষুব্ধ হন অভিভাবকরা। এক পর্যায়ে ওই কমিটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রীট পিটিশন(৮০৫৬/২০২২) দাখিল করেন শিক্ষার্থীর অভিভাবক শহিদুল্লাহ কাওছার রুবেল। চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর ম্যানেজিং কমিটিকে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে বিধি মোতাবেক প্রকাশ্যে বৈধভাবে কমিটি গঠনের আদেশ দেন।

পরিপত্র অনুযায়ী, ম্যানেজিং কমিটি অবৈধ হওয়ায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিদ্যালয়ের সভাপতি। এরই মধ্যে গত ৫ জুলাই প্রধান শিক্ষক বিধান চন্দ্র রায় চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাউশি'র পরিপত্রানুযায়ী প্রধান শিক্ষকের পদ শুন্য হলে সহকারি প্রধান শিক্ষকই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করবেন। ওই প্রতিষ্ঠানে সহকারি প্রধান শিক্ষক হিসেবে নাজমা খাতুন বিদ্যমান রয়েছেন।

হাইকোর্টের রায়ে ম্যানেজিং কমিটি অবৈধ হওয়ায় পরিপত্র অনুযায়ী সহকারি প্রধান শিক্ষক নাজমা খাতুন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন মর্মে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানান এবং শিক্ষকদের বেতন ভাতা উত্তোলনের ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন।

এদিকে হাইকোর্টের রায় অমান্য করে সেই ম্যানেজিং কমিটি বিদ্যালয়ের ছয় নম্বর জুনিয়র সহকারি শিক্ষক মোশারফ হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেন। এর আগে সিনিয়র চার শিক্ষককে দায়িত্ব গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করে পত্রে স্বাক্ষর করতে বলেন। তারা এমন পত্রে স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানালে বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারি শিক্ষক অনিল চন্দ্রকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। অপর তিন জ্যেষ্ঠ সহকারি শিক্ষকের স্বাক্ষর জ্বাল করে অনাপত্তি পত্রে স্বাক্ষর দেখানো হয়। ঘটনাটি ফাঁস হলে স্বাক্ষর জ্বালের বিষয়টি ইউএনওসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেন জ্যেষ্ঠ সহকারি শিক্ষকরা।

এরপরও জুনিয়র সহকারি শিক্ষক মোশারফ হোসেন নিজেকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দাবি করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে ম্যানেজিং কমিটির রেজুলেশনসহ কাগজপত্র দাখিল করেন। অথচ হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী ম্যানেজিং কমিটি অবৈধ ঘোষিত হওয়ায় সমস্ত কার্যক্রমও অবৈধ। এক্ষেত্রে নিয়মানুযায়ী ম্যানেজিং কমিটি না থাকায় ইউএনও দায়িত্ব পালন করার কথা। তিনি তা না করে গত ৯ আগস্ট বিষয়টি সমাধানের জন্য মতামত চেয়ে মাউশি'র কাছে পত্র পাঠান। সেখানে সহকারি প্রধান শিক্ষক নাজমা খাতুন ও সহকারি শিক্ষক মোশারফ হোসেনের দাখিল করা কাগজপত্র সংযুক্ত করা হয়। তবে অজ্ঞাত কারণে মাউশির কাছে পাঠানো পত্রে ৮ মাস আগে হাইকোর্টের রায়ে ম্যানেজিং কমিটি অবৈধ ঘোষণার বিষয়টি গোপন রাখেন ইউএনও। এমনকি এই দীর্ঘ সময় অজ্ঞাত কারণে নিজেও ওই বিদ্যালয়ের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেননি। অবৈধ ম্যানেজিং কমিটিকে সুযোগ দিতেই তিনি কালক্ষেপণের জন্য এমন করেছেন বলে অভিযোগ অভিভাবক ও এলাকাবাবাসীর।

এদিকে হাইকোর্ট কর্তৃক ম্যানেজিং কমিটি অবৈধ ঘোষণার রায়ের ৮ মাস পর স্থগিত চেয়ে সুপ্রিমকোর্টে লিভ টু আপিল(১৮৩০/২০২৩) করেন ওই কমিটির সভাপতি। ২১ আগস্ট পক্ষগণকে বিরোধীয় বিষয়ে ৮ সপ্তাহের জন্য স্থিতি অবস্থা (স্টাটাসকো) বজায় রাখার নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ। এ ঘটনায় ম্যানেজিং কমিটি না থাকায় ও ইউএনও প্রতিস্বাক্ষর না করায় বিদ্যালয়টির শিক্ষক কর্মচারিদের বেতন ভাতা বন্ধই থেকে যায়।

অপরদিকে দীর্ঘদিন বেতন ভাতা বন্ধ থাকায় মানবেতর জীবন যাপন করতে থাকেন শিক্ষক কর্মচারিরা। তাই তাদের অনুরোধে ইউএনও'র কার্যালয়ে বেতন ভাতা প্রদানের জন্য কাগজপত্র জমা দেন সহকারি প্রধান শিক্ষক নাজমা খাতুন। কিন্তু ইউএনও নাজমুল হক সুমন বেতন ভাতার কাগজে প্রতি স্বাক্ষর না করায় উত্তোলন করা সম্ভব হয়নি। এক পর্যায়ে সহকারি প্রধান শিক্ষক নাজমা খাতুন বিধি মোতাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসাবে তার মাধ্যমে ইউএনও'র প্রতি স্বাক্ষরে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারিদের বেতন ভাতা প্রদানের জন্য হাইকোর্টে রীট পিটিশন (১১৯৭৫/২০২৩)দাখিল করেন। শুনানি শেষে ১৬ অক্টোবর হাইকোর্ট ইউএনও'কে ৩০ দিনের মধ্যে বিষয়টি নিষ্পত্তির আদেশ দেন। কিন্তু ইউএনও হাইকোর্টের রায়কে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করে গত ২৬ নভেম্বর অবৈধ কমিটির সভাপতি বরাবর একটি পত্র ইস্যু করেন।

সেখানে তিনি মহামান্য হাইকোর্টে রীট পিটিশন নং- ১১৯৭৫/২০২৩ এর আদেশে পাঠক শিকড় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীদের নামে মোছা. নাজমা খাতুন উপস্থাপিত বেতন-ভাতা নিষ্পত্তিতে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে নির্দেশনা প্রদানের কথা উল্লেখ করেন।

এছাড়া ম্যানেজিং কমিটি অবৈধ ঘোষণার রায় চ্যালেঞ্জ করে লিভ টু আপিলে (১৮৩০/২০২৩) আপিল বিভাগ স্থিতি অবস্থা (স্টাটাসকো) দেওয়ায় ম্যানেজিং কমিটি বহাল বলে দাবি করেছেন। একই সঙ্গে কমিটির সভাপতিকে বিধি মোতাবেক বেতন ভাতা প্রদানসহ অন্যান্য কার্যক্রম নিষ্পত্তির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেন।

অথচ আইনজীবীরা বলছেন, আপিল বিভাগ স্থিতি অবস্থা (স্টাটাসকো) দিয়েছেন। রায় স্থগিত করেননি। তাই হাইকোর্ট কর্তৃক ম্যানেজিং কমিটি অবৈধ ঘোষণার রায় বহাল রয়েছে। হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়ন ইউএনও'র উপর বর্তায়। তাকেই নির্দেশিত বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করতে হবে। এক্ষেত্রে অবৈধ ঘোষিত ম্যানেজিং কমিটি কোন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। তবে চূড়ান্ত শুনানি শেষে সুপ্রিম কোর্ট যদি হাইকোর্টের ঘোষিত রায় স্থগিত করেন সে ক্ষেত্রে ম্যানেজিং কমিটির দায়িত্ব পালনে কোন বাধা নেই।

রংপুর জজ কোর্টের অ্যাডভোকেট এ কে এম হারুন উর রশিদ বলেন, 'আপিল বিভাগ রায় স্থগিত করেননি। পক্ষগণকে স্থিতি অবস্থার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই পূর্বের দেওয়া হাইকোর্টের রায় বহাল রয়েছে। এক্ষেত্রে ম্যানেজিং কমিটি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। পরিপত্র অনুযায়ী ইউএনও নিজেই ওই বিদ্যালয়ের সভাপতি। তিনি আগের কমিটির সভাপতিকে বৈধতা দিতে পারেন না।' 

ওই বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নাজমা খাতুন বলেন, 'দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষক কর্মচারিদের বেতন ভাতা বন্ধ থাকায় মানবিক কারণে হাইকোর্টে রীট পিটিশন দাখিল করি। হাইকোর্ট আমার মাধ্যমে ইউএনও মহোদয়কে বেতন ভাতা প্রদানের নির্দেশনা দিয়েছেন।' 

বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক অনিল চন্দ্র বলেন, 'দীর্ঘদিন থেকে বেতন বন্ধ থাকায় মানবেতর জীবন যাপন করছি। সকলে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েছি। মানবিক কারণে হলেও হাইকোর্টের রায় দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছি' ।

এ বিষয়ে পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল হক সুমন বলেন, 'যেহেতু মাহামান্য হাইকোর্টের রায়ের উপর স্টাটাসকো দিয়েছে আপিল বিভাগ তাই কমিটি বৈধ। এজন্য কমিটিকে বিষয়টি নিষ্পত্তির দায়িত্ব দিয়েছি। হাইকোর্টের রায় অমান্যের অভিযোগ সঠিক না।' 

মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ - dainik shiksha সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল - dainik shiksha জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় - dainik shiksha শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0050690174102783