নতুন আয়কর আইন অনুসারে করদাতাকে অবশ্যই ৩০ নভেম্বরের মধ্যে রিটার্ন জমা দিতে হবে। তা না হলে তার নিজের পক্ষে আর রিটার্ন জমা দেয়ার সুযোগ নেই। একমাত্র যদি কর কর্মকর্তা মনে করেন যে, তিনি করদাতার রিটার্ন নেবেন, তা হলেই কেবল করদাতাকে নোটিশ করবেন। পুরনো আইনের মতো প্রতিবছর ৩০ নভেম্বর কর দিবস পালিত হবে। সেদিনই ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের সারা বছরের আয়-ব্যয়ের খবর জানিয়ে রিটার্ন দাখিল করার শেষ দিন। নতুন আয়কর আইনের ১৭২ ধারা অনুযায়ী, রিটার্ন জমা দেয়ার সময় পার হওয়ার পর উপ-কর কমিশনারের মতে যদি করদাতার রিটার্ন জমার বাধ্যবাধকতা থাকে, তা হলে করদাতাকে রিটার্ন জমা দেয়ার জন্য নোটিশ দেবেন কর কর্মকর্তা। নোটিশ পাওয়ার ২১ দিনের মধ্যে বা কর কর্মকর্তার অনুমোদিত সময়সীমার মধ্যে রিটার্ন জমা দেবেন সংশ্লিষ্ট করদাতা।
নতুন আইনের ১৭৪ ধারায় বলা আছে করের ওপর সরল সুদ আরোপের পাশাপাশি কোনো ধরনের কর অব্যাহতি পাওয়া যাবে না। একজন করদাতার ওপর যত টাকা কর ধার্য হয়, তাকে সেই পরিমাণ টাকা কর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো কর অব্যাহতি মিলবে না। নতুন আয়কর আইন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
গত ২২ জুন আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪ রহিত করে যুগোপযোগী ও সময়োপযোগী করে নতুন আয়কর আইন, ২০২৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তত্ত্বাবধানে নতুন আইনটির বিষয়ে অবহিতকরণে অংশীজনদের সঙ্গে গণশুনানির আয়োজন করা হচ্ছে। আয়কর কর্মকর্তারা জানান, নতুন আইনে স্বনির্ধারণী রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ৩০ নভেম্বরের মধ্যে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে করদাতা প্রত্যাশিত রিবেট পাবেন না এবং বিলম্ব মাসুলও গুনতে হবে।
আয়করদাতার রিটার্ন প্রস্তুত সহজলভ্য করতে ফি নির্ধারণ করে এজেন্সিকে দায়িত্ব দেয়াসহ নতুন নীতিমালা করা হচ্ছে। নতুন আইন অনুযায়ী প্রত্যেক গণকর্মচারীকে রিটার্ন দিতে হবে।
বার্ষিক করযোগ্য আয় পাঁচ লাখ টাকার কম হলেই এক পাতার আয়কর বিবরণী জমা দিলেই হবে। এ ছাড়া সম্পদের পরিমাণ ৪০ লাখ টাকার কম হতে হবে, এমন শর্তও রয়েছে। কম আয় ও সম্পদের এই করদাতাদের জন্য এক পাতার একটি ফরম প্রকাশ করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর কর্মকর্তারা বলছেন, কম আয়ের করদাতার রিটার্ন জমা সহজ করতেই এক পাতার রিটার্ন ফরম চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নতুন আইনের আলোকে এই পাতা সাজানো হয়েছে।
এক পাতার ফরমে সব মিলিয়ে ১৬ ধরনের তথ্য দিতে হবে। এগুলো হলোÑ নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন), সার্কেল, কর অঞ্চল, কর বর্ষ, আবাসিক মর্যাদা, মোবাইল নম্বরসহ যোগাযোগের ঠিকানা, আয়ের উৎস, মোট পরিসম্পদ, মোট আয়, আরোপযোগ্য কর, কর রেয়াত, প্রদেয় কর, উৎসে কাটা করের পরিমাণ (যদি থাকে), এই রিটার্নের সঙ্গে প্রদত্ত কর, জীবনযাপন ব্যয়।
এক পাতার রিটার্ন ফরমের সুবিধা হলো এখানে কোন খাত থেকে কত কর আয় হয়েছে তার বিস্তারিত লিখতে হবে না। শুধু মোট আয়ের তথ্য দিলেই হবে। এভাবে মোট সম্পদ, জীবনযাত্রার খরচ, করের পরিমাণ এসবের মোট পরিমাণ লিখলেই হবে। এনবিআর সূত্র জানায়, এক পাতায় রিটার্ন জমা দিতে হলে কিছু শর্তও দেয়া হয়েছে। যেমন কোনো কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার হওয়া যাবে না এবং মোটরগাড়ি থাকবে না। এ ছাড়া সিটি করপোরেশন এলাকায় গৃহসম্পত্তি বা অ্যাপার্টমেন্টে বিনিয়োগ থাকলেও এক পাতার ফরম প্রযোজ্য হবে না। বিদেশে সম্পদ থাকলেও চলবে না। দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছেÑ আয়কর রিটার্ন ফরমের জটিল হিসাব-নিকাশের কারণে অনেকে বার্ষিক রিটার্ন দিতে চান না। আগেও এক পাতার ফরম ছিল। এখন শুধু মোট আয় ও করের পরিমাণ লিখলেই হবে।
এক পাতার রিটার্ন ফরমের পাশাপাশি এবার এক পাতার আয়কর বিবরণী জমার প্রাপ্তি স্বীকারপত্র বা প্রত্যয়নপত্র দেয়া হবে। সেই প্রত্যয়নপত্রের অনুলিপিও প্রকাশ করেছে এনবিআর। এর আগে সিøপের মতো প্রাপ্তি স্বীকারপত্র ছিল। রিটার্ন ফরমের একটি অংশ কেটে দেয়া হতো।
অন্যদিকে একজন করদাতার কর নথি নিরীক্ষায় পড়লে অন্তত সাতজন কর কর্মকর্তা ফাঁকি ধরতে নেমে পড়বেন। প্রথমেই ওই কমিশনারেটের কর কমিশনার করদাতার তথ্য অনুসন্ধানের জন্য কমপক্ষে দুই সদস্যের একটি অনুসন্ধান দল গঠন করবেন। দুজন কর পরিদর্শকের সমন্বয়ে গঠিত হবে এই দল। এই দল করদাতার আয়-ব্যয়, সম্পদ, লেনদেনসহ যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে ৬০ দিনের মধ্যে একটি অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেবেন। কর কমিশনার পরে সেই অনুসন্ধান প্রতিবেদন নিরীক্ষার জন্য নিরীক্ষা দলের কাছে পাঠাবেন। এই নিরীক্ষা দল গঠিত হবে কমপক্ষে দুজন উপ-কমিশনারের সমন্বয়ে এবং কর কমিশনার দলটি গঠন করবেন। নিরীক্ষা দল নির্দিষ্ট ওই করদাতার যাবতীয় আয়-ব্যয়, সম্পদ, জীবনযাত্রার তথ্য যাচাই-বাছাই করে ৬০ দিনের মধ্যে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করবে। খসড়া নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি ওই করদাতার কাছে পাঠিয়ে ব্যাখ্যা চাইবে নিরীক্ষা দল।
নিরীক্ষা দলটি তাদের প্রতিবেদন চূড়ান্ত করে কর কমিশনারের কাছে জমা দেবে। এর পর কর কমিশনার প্রতিবেদনটি অডিট কিউরেটরের কাছে পাঠাবেন। একজন যুগ্ম কর কমিশনার বা অতিরিক্ত কর কমিশনার অডিট কিউরেটরের দায়িত্ব পালন করবেন। অডিট কিউরেটর নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি পরীক্ষা করে দেখবেন এবং এ বিষয়ে মতামত দিয়ে তা ওই করদাতার সংশ্লিষ্ট উপ-কর কমিশনারের কাছে পাঠাবেন। এর পর ওই উপ-কর কমিশনার সাত দিনের মধ্যে অডিট কিউরেটরের সুপারিশের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ওই করদাতাকে নিরীক্ষা ফলাফলের বিস্তারিত জানিয়ে সংশোধিত রিটার্ন দাখিল এবং প্রাপ্য কর পরিশোধের নির্দেশ দেবেন।
উল্লেখ্য, বর্তমানে প্রায় ৯০ লাখ টিআইএনধারী আছেন। তাদের মধ্যে প্রতিবছর ৩০ লাখের মতো নিজেদের আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত জানিয়ে রিটার্ন জমা দেন।