‘ভালো বনাম খারাপ ফলাফল’র সামাজিক সার্টিফিকেট! - দৈনিকশিক্ষা

‘ভালো বনাম খারাপ ফলাফল’র সামাজিক সার্টিফিকেট!

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক: শুরুতেই বলে রাখি- এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করার জন্য নানা সংখ্যা এবং হার দিয়ে কোয়ান্টিটেটিভ কোনো আলোচনা আমি করব না; বরং কিছু কোয়ালিটেটিভ আলোচনা করতে চাই। বাজারে জারি থাকা ‘ভালো ফলাফল’ বনাম ‘খারাপ ফলাফল’-এর জনপ্রিয় ধারণা এবং এর পশ্চাতে বিদ্যমান সমাজের অসম ব্যবস্থাকে বিশ্লেষণ করতে চাই।

প্রতি বছর এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয় এবং আমরা সংবাদপত্রে ও প্রাইভেট টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে পাসের হার, পাসের সংখ্যা এবং জিপিএ-৫ সংক্রান্ত খবর প্রকাশ ও প্রচারিত হতে দেখি। ভালো ফলাফলকারী শিক্ষার্থীদের আনন্দ উচ্ছ¡াসের ছবি দেখি। ভালো ফলাফল করে আনন্দ, উল্লাস ও উচ্ছ¡াস প্রকাশ করার বিষয়টি খুবই স্বাভাবিক। কেননা আমরা অনেকেই জানি যে একজন শিক্ষার্থীর ভালো ফলাফলের পেছনে কতগুলো মানুষের আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং ঐকান্তিক নিষ্ঠা লুকায়িত থাকে। আমরা জানি, কতগুলো মানুষের শ্রমে, ঘামে, সময় এবং উদ্বেগের ভেতর দিয়ে একজন শিক্ষার্থী ভালো ফলাফল করে। তাই ভালো ফলাফলের সঙ্গে বাঁধভাঙা উচ্ছ¡াসের সম্পর্ক খুবই স্বাভাবিক।

কেননা ভালো ফলাফল তার পরিশ্রম, কষ্ট ও চেষ্টার স্বীকৃতি। ভালো ফলাফল একজন শিক্ষার্থীর দীর্ঘদিনের সব নিষ্ঠার প্রতিফল। একজন শিক্ষার্থীর পেছনে তার পিতা-মাতা, ভাই-বোন, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও আত্মীয়-পরিজনের যে সময়, শ্রম ও মেধা বিনিয়োগ তারই এক ধরনের প্রতিফল। তাই ভালো ফলাফল করার সঙ্গে উচ্ছ¡াস, উল্লাস এবং আনন্দ প্রকাশ করার বিষয়টি খুবই স্বতঃস্ফূর্ত এবং স্বাভাবিক। কিন্তু ভালো ফলাফল বলতে আসলে আমরা কী বুঝি? বা ভালো ফলাফল বলতে আমাদের আদতে কী বোঝানো হয়? এই বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা করার প্রয়োজন আছে কেননা জিপিএ-৫ পাওয়াটাই যদি ভালো ফলাফলের একমাত্র মাপকাঠি হয়; আবার জিপিএ গোল্ডেন ফাইভ পাওয়াটাই যদি খুব ভালো ফলাফলের একটা মাত্রা হয়, তাহলে অধিকাংশ শিক্ষার্থী যারা জিপিএ-৫ অর্জন করতে পারেনি, তাদের আমরা কোথায় ঠেলে দিচ্ছি সেটা আমরা সাধারণত বিবেচনায় রাখি না। অর্থাৎ জিপিএ-৫ পাওয়াটাই যদি ভালো ফল হয়, তাহলে জিপিএ-৫ যারা পায়নি, তারা খারাপ ফলাফল করেছে? এ ধরনের সাধারণীকরণ ও সরলীকরণ আমাদের একটা বিপন্ন অবস্থার দিকে ঠেলে দিতে পারে। আর যারা পরীক্ষায় ফেল করেছে, তাহলে তাদের আমরা একটা চূড়ান্ত খারাপের দিকে ঠেলে দিচ্ছি কিনা, সেটাও আমরা মাথায় রাখি না।

যার কারণে সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী এ জন্য ৯ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল করার কারণে আত্মহত্যা করেছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। ফলে ভালো এবং খারাপ ফলের যে মানদণ্ড আমরা নিজের অজান্তে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছি, সেটা সমাজের একটা বিপন্ন অবস্থার জন্ম দিতে পারে, সেটা আমরা মনে রাখি না। আবার আমরা এটাও চিন্তার মধ্যে রাখি না যে, শহর এবং গ্রামের মধ্যে শিক্ষার সুযোগ-সুবিধার মধ্যে ব্যাপক তারতম্য রয়েছে। সমাজে বিদ্যমান অর্থনৈতিক অসমতা এবং স্কুলগুলোর শিক্ষার গুণগত মানের তারতম্য যে ভালো ফলাফল করার ক্ষেত্রে একটা তারতম্য তৈরি করে, সে বিবেচনাও আমরা এই ভালো ফলাফল মাপার মানদণ্ডে বিচার করি না। ফলে সুযোগের সমতা যেখানে নেই, সেখানে প্রাপ্তির সমতা আশা করা- যারা ভালো ফলাফল করেনি তাদের প্রতি এক ধরনের অন্যায় ও অবিচার। আমরা বুঝে কিংবা না বুঝে এ অবিচার করছি।

কেননা যারা ভালো ফলাফল করেনি তাদের ভালো ফলাফল না করার পেছনে কেবল তারা একাই দায়ী নয়; এর জন্য দায়ী সমাজে বিদ্যমান অসম অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক ব্যবস্থা। ঢাকা শহরের নামকরা স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীরা যে ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা তার তুলনায় সেরকম সুযোগ-সুবিধা ও পৃষ্ঠপোষকতা পায় না। ফলে ঢাকা শহরের স্বনামধন্য স্কুলগুলোর কথিত ভালো ফলাফল দিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নাম-গোত্রহীন স্কুলগুলোর ফলাফলকে একই পাল্লায় মাপা যাবে না। ফলে ভালো ফলাফল এবং খারাপ ফলাফলের মাপঝোঁক করার ক্ষেত্রে শহর ও গ্রামের তারতম্য, স্কুলগুলোর সুযোগ-সুবিধা তারতম্য, সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতার তারতম্য এবং সমাজে বিদ্যমান অর্থনৈতিক অসমতার বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে। এখানে যে বিষয়টি মনে রাখা জরুরি, সেটি হচ্ছে ভালো শিক্ষক, ভালো ব্যবস্থাপনা, ভালো পৃষ্ঠপোষকতা এবং ভালো প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে সুযোগের সমতা বিধান না করে কেবলমাত্র জিপিএ-৫-এর মানদণ্ড দিয়ে ভালো এবং খারাপ ফলাফল নির্ধারণ করা যাবে না। এ ভালো এবং খারাপ ফলাফলের আরো একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে, যা আমরা কদাচিৎ বিবেচনায় নিই।

একে তো স্কুলগুলোর সুযোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার কারণে ফলাফলের অসমতা, যার জন্য কোনোভাবেই শিক্ষার্থীরা দায়ী নয়, সে অসমতায় পরবর্তী জীবনেও নতুন করে অসমতা তৈরি করে দেয়। কেননা এসএসসির ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে কলেজের ভর্তির ব্যবস্থা হলে, যারা ভালো ফল করেনি অর্থাৎ যারা ভালো জিপিএ অর্জন করতে পারেনি, তারা ভালো কলেজে ভর্তি হতে পারবে না। আর ভালো কলেজে ভর্তি হতে না পারলে এইচএসসি পরীক্ষায়ও তাদের ভালো ফলাফল করার সম্ভাবনা সংকুচিত হয়ে যায়। অর্থাৎ সমাজের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধার অসমতার কারণে যাদের আমরা খারাপ ফলাফলের ক্যাটাগরিতে ঠেলে দিচ্ছি, তাদেরই আমরা আবার কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে ভালো কলেজে ভর্তির সুযোগ না দিয়ে তাদের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলকেও খারাপ করার দিকে ঠেলে দিচ্ছি। আর এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হলে উচ্চশিক্ষার দ্বারও তাদের জন্য রীতিমতো বন্ধ হয়ে যাবে। বন্ধ হয়ে না গেলেও নিঃসন্দেহে সংকুচিত হয়ে যাবে।

ফলে ভালো ফল এবং খারাপ ফলের দ্বৈরথে কাটা পড়ে যাচ্ছে সমাজের পিছিয়ে পড়া একটা বিরাট জনগোষ্ঠী; সমাজের সুযোগ-সুবিধার তারতম্যে মার খাওয়া জনগোষ্ঠী; সমাজের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী এবং শহর ও গ্রামের দ্বৈরথে পিছিয়ে পড়া বৃহত্তর গ্রামীণ জনগোষ্ঠী। এভাবেই সমাজের বিদ্যমান শ্রেণি-বৈষম্য ও অর্থনৈতিক অসমতা ক্রমবর্ধমান হয়। সুতরাং ভালো ফল যারা করছে আর খারাপ ফল যারা করছে তাদের মধ্যে পার্থক্যটা যতটা না মেধার, তারচেয়ে অধিক বেশি সামাজিক অসমতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সুযোগের তারতম্যের কারণে। তাই অন্য বছরের সঙ্গে তুলনা করে জিপিএর সংখ্যা বাড়ল নাকি কমল এবং অন্য বছরের সঙ্গে শতাংশ তুলনা করে শিক্ষার্থীর অনুপাতে পাসের হার বাড়ল নাকি কমল সেটা দিয়ে দেশের বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার সত্যিকারের কোনো চেহারা পাওয়া যায় বলে আমার মনে হয় না।

প্রত্যন্ত গ্রামের কিংবা কোনো প্রান্তিক অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী ভালো শিক্ষকের অভাবে, ভালো স্কুলের অভাবে এবং সামাজিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে হয়তো ভালো ফলাফল করতে পারছে না; কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থা এবং শিক্ষা কাঠামো তাকে সেখান থেকে তুলে আনার পরিবর্তে অন্য প্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে এসএসসিতে খারাপ ফলাফল করার কারণে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে : এসএসসি পরীক্ষায় ভালো জিপিএ না পাওয়ার কারণে ভালো কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায় না; আর ভালো কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ না পাওয়ার কারণে এইচএসসি জিপিও ভালো পায় না; আর এইচএসসিতে জিপিএ ভালো না পাওয়ার কারণে উচ্চশিক্ষার সুযোগও পায় না; ফলে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের মতো ‘খারাপ ফলাফলের দুষ্টচক্রে’ পড়ে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর জীবন বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে, যা আমরা গভীরভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা না করেই ভালো কিংবা খারাপ ফলাফলের সামাজিক-সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছি। আমি মনে করি এই জায়গায় অধিকতর মনোযোগ দেয়া জরুরি, অন্যথায় জিপিএ-নির্ভর শিক্ষা এবং পাসের হার নির্ভর শিক্ষা কোনোভাবেই শিক্ষার গুণগত মানকে নিশ্চিত করবে না। পরিশেষে বলব, যারা জিপিএ-৫ পেয়েছে তাদের কষ্ট, চেষ্টা এবং নিষ্ঠাকে পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে তাদের অভিনন্দন জানাই। কিন্তু যারা জিপিএ-৫ না পেয়ে তথাগত খারাপ রেজাল্ট করেছে, তাদেরও অধিকতর অভিনন্দন জানাই কেননা তাদের জিপিএ-৫ না পেয়ে খারাপ ফলাফল করাটা যতটা না তাদের জন্য, তারচেয়ে অধিকতর দায়ী সমাজের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধার অসম ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনা। ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সূত্র: ভোরের কাগজ

পাঠ্যবইয়ের কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর কমানোর ধান্দায় মুদ্রাকররা - dainik shiksha পাঠ্যবইয়ের কাগজের বার্স্টিং ফ্যাক্টর কমানোর ধান্দায় মুদ্রাকররা বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ না পাওয়া শিক্ষকদের তথ্য আহ্বান - dainik shiksha বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ না পাওয়া শিক্ষকদের তথ্য আহ্বান কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক শূন্যপদের তথ্য সংগ্রহে ফের ই-রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha শিক্ষক শূন্যপদের তথ্য সংগ্রহে ফের ই-রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ ববি উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আল্টিমেটাম - dainik shiksha ববি উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আল্টিমেটাম এসব কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাজ নয় - dainik shiksha এসব কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাজ নয় প্রাথমিকের দুই ফুটবল টুর্নামেন্টের নাম বদলে গেলো - dainik shiksha প্রাথমিকের দুই ফুটবল টুর্নামেন্টের নাম বদলে গেলো please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0049629211425781