‘মা লো মা’ বিতর্ক ও সমাধানের পথ - দৈনিকশিক্ষা

‘মা লো মা’ বিতর্ক ও সমাধানের পথ

কাজী বনফুল |

সম্প্রতি কোক স্টুডিও বাংলা থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘মা লো মা’ গানটি। প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই গানটির প্রকৃত স্বত্ব নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্কের ঝড়। কোক স্টুডিওতে গানটি পরিবেশনের সময় বাউল সাধক খালেক দেওয়ানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এই গান প্রকাশ এবং নাম উল্লেখ করার পর থেকেই  বাউল সাধক রশিদ উদ্দিনের অনুসারীরা দাবি করছে গানটি তার রচিত। এখন কথা হচ্ছে ‘মা লো মা’ গানটি আমি প্রয়াত খালেক দেয়ানের নিজের মুখের একটি ভার্সন শুনেছি সেখানে তিনি এই গানকে নিজের লেখা বলে উচ্চারণ করেছেন। 

রশিদ উদ্দিন সাহেবের লেখা গানটিও শুনেছি দুইটি গানের কথার মধ্যে সম্পূর্ণ মিল নেই দুটির মধ্যে কিছু ভিন্নতা দৃশ্যমান। এখনো আমাদের দেশে কয়েক প্রজন্মের মানুষ আছে, জ্ঞানী-গুণী, সাধক শ্রেণি থেকে শুরু করে অনেক প্রবীণ ও বিজ্ঞজনদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি যে রশিদ উদ্দিন সাহেব যে গানটি লিখেছেন এবং খালেক দেওয়ান সাহেব যে গানটি লিখেছেন দু'টি গানের কথার ভেতর বেশ ভিন্নতা রয়েছে। গানের ভেতর অনেক কথা ও ভাষার ভিন্নতা রয়েছে।

তারা বলছেন তৎকালীন সময়ে ‘মা লো মা ঝি লো ঝি’ বা ‘মাগো মা ঝিগো ঝি’ এগুলো প্রচলিত বাগধারা বা শ্লোকের মতো ছিলো। অনেকেই এই শ্লোককে ব্যবহার করে গান লিখতেন কবিতা লিখতেন। সেক্ষেত্রে ‘মা লো মা বা মাগো মা’ থাকলেই সে গান শুধুমাত্র একজনেরই এটা দাবি করার কোনো সুযোগ নেই। খালেক দেওয়ান সাহেবের নিজের প্রকাশিত যে গীতবিতান রয়েছে সেখানেও তার এই গানটি রয়েছে। তার সমসাময়িক অনেক প্রবীণ ব্যক্তি জানিয়েছেন গানটি তার নিজের লেখা এবং তিনি এটি অনেক বার অনেক স্থানে গেয়েছেন বলে ব্যক্ত করেছেন। আবার অনেক প্রাজ্ঞজন বলেছেন এই গানটির রশিদ উদ্দিনের রচিত একটি ভারসনও রয়েছে যেখানে ভাষাগত কিছু ভিন্নতা রয়েছে রশিদ উদ্দিনের গানটি মূলত ‘মাগো মা ঝিগো ঝি’ কিন্তু খুবই সাদৃশ্যপূর্ণ।

আবার অনেক গবেষক বলছেন যে সংগীতের ক্ষেত্রেও অনেক কাকতালীয়তা থাকে। সেক্ষেত্রে এখানেও হয়তো এই গান রচনার ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটেছে বা ঘটে থাকতে পারে। যেমন একজনের ভাবের সঙ্গে আরেকজনের ভাব মিলে যেতে পারে বা কারো গানের কথার সঙ্গে আরেকজনের কথাও মিলে যেতে পারে অলৌকিক ভাবেই। যেটা আমাদের সম্পূর্ণভাবে বিচার করার সুযোগ নেই। 

এবার মূল কথায় আসা যাক। গানটি নিয়ে যে দুজন রচয়িতা সম্পর্কে বিতর্ক হচ্ছে তারা দুজনই এখন প্রয়াত। তারা দুজনই ছিলেন বাউল সাধক। এখন তারা আর কেউ এই পৃথিবীতে বেঁচে নেই। তৎকালীন সময়ে এই সাধক ও সংগীত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গুরু ভিত্তিক চর্চার ব্যবস্থা ছিলো। সেখানে একে অপরের সঙ্গে দেখা হতো কথা হতো। বিভিন্ন অঞ্চলের গান ও সুর নিয়ে একে অপরের সঙ্গে বাক্য ও ভাব বিনিময় হতো। তৎকালীন সময়ে একজন সাধক বা বাউল আরেকজনের সঙ্গে মিলেমিশে গান রচনা করতেন। একজন আরেকজনের সঙ্গে আত্মিক মিলনে আবদ্ধ থাকতেন। তারা নিজেদের অভিন্ন সত্তা বলে মনে করতেন। রশিদ উদ্দিন সাহেব এবং খালেক দেওয়ান সাহেব দুজন সমসাময়িক ২০ বছরের ছোট বড়। তাদের ভেতর যে সম্পর্কের গভীরতা হৃদয়ের তলদেশকে স্পর্শ করেনি সেটা আমরা সেটা আমরা নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি না কিন্তু একটু অনুধাবন করতে পারি যেহেতু তারা দুজনই বাউল সাধক সেহেতু তাদের ভেতর একটি আত্মিক বন্ধন ছিলো এটা অনিবার্য হয়তো। তারা বেঁচে থাকলে হয়তো এই বিষয় নিয়ে কোন বিতর্কই হতো না কারণ তারা এই জাগতিক নাম ও নিজস্বতার অনেক ঊর্ধ্বের মানুষ। তাদের মধ্যে হয়তো ভিন্ন শরীরে অভিন্ন আত্মার যোগসূত্র ছিলো। যেহেতু তারা শ্রদ্ধেয় দুজনই প্রয়াত তাদের কারো সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই সেক্ষেত্রে এটা আমরা অনুমান করে নিতে পারি যে এক্ষেত্রেও কাকতালীয় ভাবে এমনটাই ঘটেছে হয়তো। খালেক দেওয়ান এবং রশিদ উদ্দিন সাহেব দুজনই আমাদের বাংলার সূফি জগতের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। যাদের কাছ থেকে আমরা অনেক অনেক মূল্যবান সংগীত ও জ্ঞানের আলোর সন্ধান পেয়েছি। তারা দুজনই আবহমান বাংলার আকাশে আলোর প্রদীপ স্বরূপ। 

কোনো বিষয় নিয়ে বিতর্ক করলে সারাদিনই করা যায়। কিন্তু বিতর্কের সমাধানের পথের সন্ধান বেশি জরুরি। কারণ, অযথা ও অযাচিত বিতর্কে সমাজ পিছিয়ে যায়। আমরা সংগীত ও সংস্কৃতিতে এমনিতেই দিনে দিনে পিছিয়ে যাচ্ছি। তার ভেতর যদি নিজেদের আত্মিক বন্ধনের জায়গায় এমন ফাটল বা বিচ্ছেদের সূত্রপাত হয় তাহলে আমরা ডুবে যাবো খুব দ্রুতই। 

আমি কোক স্টুডিওর গানটি শুনে দেখলাম কোক স্টুডিও খালেক দেওয়ানের ভারসনটিই করেছে। এখানে কণ্ঠ দিয়েছেন একজন আরিফ দেওয়ান এবং অন্যজন শরফুউদ্দিন দেওয়ান ওরফে সাগর দেওয়ান। গানটির সার্বিক কম্পোজ করেছেন প্রীতম হাসান। 

আমাদের এই প্রযুক্তির নতুনত্বের ভিরে ধীরে ধীরে আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত সকল বিষয় আঞ্চলিক বিষয়। আমাদের সেই আব্বাস উদ্দিন, বিজয় সরকার, জসিমউদ্দীন, খালেক দেওয়ান, রশিদ উদ্দিন, উকিল মুন্সি, যারা হচ্ছে বাংলার গানের ভুবনের প্রাণ ভ্রমর অথচ তাদের গান এখন আর কেউ শুনে না গায়ও না। কারো মুখে এখন আর এই সব গান শোনা যায় না। যখন কোনো বিষয়ের প্র্যাকটিস বন্ধ হয়ে যাবে তখন সে বিষয়টিও আমাদের থেকে ধীরে ধীরে বিলুপ্তির দিকে অগ্রসর হবে। তাই অবশ্যই আমাদের সবাইকে সম্মিলিত ভাবে কোক স্টুডিওর এই প্রচেষ্টার সঙ্গে সহমত সমেত মানসিক সহযোগিতা প্রদান করতে হবে যাতে গানগুলো আবার নতুন করে প্রাণ ফিরে পাওয়ার সুযোগ পায়।

এক্ষেত্রে কোক স্টুডিও এবং প্রীতম হাসান একটি অনন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তারা সম্মিলিত ভাবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী ও আঞ্চলিক গানগুলোকে নতুন করে মানুষের মুখে মুখে রটানোর ব্যবস্থা করেছে। আমাদের যে নতুন প্রজন্ম তারা মূলত আমাদের জারি, সারি, বিচ্ছেদ, ভাটিয়ালি, এসব গানের সঙ্গে খুব একটা পরিচিত নয়। আমাদের এই নতুন প্রজন্মকে ওইসব গান ও গানের রচয়িতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়াটাকে আমি সম্মানের সঙ্গে স্বাগত জানাই। এখন তরুণদের মুখে মুখে বেজে উঠছে ‘মা লো মা’ গানটি তারা গাইছে তারা বুঝতে পারছে তাদেরও এমন সংগীতের গুরুত্বপূর্ণ ভান্ডার রয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রীতম হাসান অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। ‘মা লো মা’ গানটির ভেতর সাগর দেওয়ান নামে প্রয়াত খালেক দেওয়ানের বর্তমান প্রজন্মের একজন কণ্ঠ দিয়েছেন। সাগর দেওয়ানের কণ্ঠ গানটিকে একটি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তার কণ্ঠে সুরের যে মনিহার খচিত হীরা বসানো রয়েছে সেটা ওই গানের ভেতর দিয়ে তার কণ্ঠের মুগ্ধতায় ছুঁয়ে গেছে ভক্তদের হৃদয়। সাগর দেওয়ানের কণ্ঠের নাগপাশে আবদ্ধ হয়েছে সব সংগীত অনুরাগীরা। কোক স্টুডিও এই যে একটি ধারার প্রচলন করেছে যে তারা নতুন ও প্রতিভাবান শিল্পীদের খুঁজে-খুঁজে বের করে তাদেরকে নিয়ে কাজ করা এটি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। এর আগেও আমরা ‘দেওরা’ গানে ইসমাইল উদ্দিনসহ আরো অনেক নিভৃত প্রতিভাকে নিয়ে কোক স্টুডিওকে কাজ করতে দেখেছি যা অবশ্যই কষ্টসাধ্য অনুসন্ধানের ফলেই সম্ভব হয়েছে। 

পৃথিবীতে আর যতো আনন্দ ও মুগ্ধতার বিষয় রয়েছে তার মধ্যে সংগীত সর্বশেষ্ঠ। সংগীত সম্পর্কে জার্মানি কবি ও দার্শনিক ফেডরিক নিৎসে বলেছেন ‘আমি যখন নিজেকে হারিয়ে ফেলি তখন আমি গুন গুন করে গান গাই। গানের মধ্যে ডুবে গিয়ে আমি আবার নিজেকে খুঁজে পাই’।

গান সম্পর্কে সাধক রামপ্রসাদ বলেছেন, ‘গান হচ্ছে এমন সুবাস যা আমাদের সব প্রাণকে এক অদৃশ্য সুঁতোয় বেঁধে রাখে। গান আমাদের সব প্রাণের অনুভূতির একত্রিত জাগরণ।’
সর্বপোরি আমাদের অঞ্চলে কোক স্টুডিও বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী সংগীত ও সংস্কৃতিকে নতুনভাবে টেনে তোলার জন্য যে আপ্রাণ চেষ্টায় ঘাম ঝরাচ্ছে তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। আমরা যে তর্কে জড়িয়ে পড়েছি এই তর্কের আসলে প্রকৃত ও নির্দিষ্ট কোনো সমাধান নেই। আমাদের দুই বাউল সাধক পরিবারের উভয়েরই উভয়ের প্রতি সহমর্মিতা সমেত বিষয়টি গ্রহণ করতে হবে। কারণ, কপিরাইট অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রশিদ উদ্দিনের ‘মাগো মা’ কিংবা খালেক দেওয়ানের ‘মালো মা’—কোনো গানই কপিরাইট অফিসে নিবন্ধন করা নেই। ফলে গানটির মূল স্রষ্টা কে, তা কপিরাইট অফিস সঠিকভাবে বলতে পারছে না। আবার লোকসংস্কৃতি–গবেষক সাইমন জাকারিয়া বলেন, ‘বাংলা লোকসংগীতের অনেক গান খুবই সমস্যাপূর্ণ। এসব নিয়ে আলাপ করতে গেলে এই নিয়ে অনেক বিতর্ক হবে। 

তাহলে এই যখন অবস্থা সেক্ষেত্রে আমাদের সহমর্মিতা সমেত বিষয়টিকে গ্রহণ ছাড়া এই বিতর্ক বা দ্বন্দ্বের কোনো সঠিক সমাধানের পথ নেই। এক্ষেত্রে দুপক্ষেরই উচিত বিষয়টিকে সহজভাবে গ্রহণ করে এই অযাচিত, অনির্দিষ্ট এবং সমাধানহীন তর্কের অবসান ঘটিয়ে বিষয়টিকে সহজভাবে গ্রহণ করে একে অপরের সহযোগী হিসেবে কাজ করা। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একত্রে সংগীতের এই পুনরুদ্ধারের কাজে সবাই মিলে একে অপরকে সহযোগিতা করে পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী গানের ভুবনকে উজ্জীবিত করবো বলে আশা করি।

লেখক: কলামিস্ট

 

শিক্ষার্থীদের রাজাকার শ্লোগান লজ্জার: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের রাজাকার শ্লোগান লজ্জার: প্রধানমন্ত্রী কৃষি গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha কৃষি গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা স্থগিত উপহার দিলেই এমপিওভুক্তি! - dainik shiksha উপহার দিলেই এমপিওভুক্তি! কোচিং বাণিজ্যে জড়িত পিএসসির আরো ৪ কর্মকর্তা-কর্মচারী - dainik shiksha কোচিং বাণিজ্যে জড়িত পিএসসির আরো ৪ কর্মকর্তা-কর্মচারী ঢাবির জরুরি বৈঠকে প্রভোস্ট কমিটির পাঁচ সিদ্ধান্ত - dainik shiksha ঢাবির জরুরি বৈঠকে প্রভোস্ট কমিটির পাঁচ সিদ্ধান্ত কোটার পক্ষে-বিপক্ষে আন্দোলনকারীদের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি আজ - dainik shiksha কোটার পক্ষে-বিপক্ষে আন্দোলনকারীদের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি আজ শিক্ষামন্ত্রী দেশে ফিরছেন আজ - dainik shiksha শিক্ষামন্ত্রী দেশে ফিরছেন আজ র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে - dainik shiksha র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা কলেজগুলোর নাম এক নজরে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028250217437744