ঈদের আনন্দ ছোঁয় না যে ঘর | মতামত নিউজ

ঈদের আনন্দ ছোঁয় না যে ঘর

ঈদের আনন্দ ছোঁয় না যে ঘর

#উৎসব ভাতা #এমপিও #স্কুল #কলেজ #শিক্ষক

পৌনে দুই যুগের বেশি সময় ধরে সিকি উৎসব ভাতার বিড়ম্বনায় পীড়িত কয়েক লাখ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী। সিকি উৎসব ভাতা দেয়া আর না দেয়া আমার কাছে সমান বলেই মনে হয়। উৎসব ভাতা যেদিন একদম ছিলো না, সেদিন শিক্ষক-কর্মচারীদের দুঃখের মধ্যেও অন্যরকম এক শান্ত্বনা ছিলো। কোনো কিছু ‘সামান্য’র চেয়ে একেবারে ‘না’ থাকাই ভালো। ‘কানা মামার চেয়ে নাই মামা ভালো’র মতো। যদিও আমরা ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’ বলে শিখেছি। আমার কেনো জানি মনে হয় ‘সিকি বোনাস’ চালু করে ‘না থাকা’ বা ‘না পাওয়া’র যন্ত্রণাকে আরো কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। তার সঙ্গে আরেক বিড়ম্বনা সেই শুরু থেকে লেগে আছে। সেটি এই, সিকি উৎসব ভাতা কখনো সময়মতো শিক্ষক-কর্মচারীদের হাতে আসে না।

এই ‘অদ্ভুত’ (দুনিয়ার কোথাও এরকম খণ্ডিত উৎসব ভাতার কথা কারো কাছে শুনিনি) রকমের উৎসব ভাতাটি শিক্ষক-কর্মচারীরা কোনোদিন সময়মতো পেয়েছেন বলে আমার জানা নেই। বেশিরভাগ সময় সেটি হয় ইদের দুতিনদিন আগে, নয় তো ঈদের পরে হাতে পৌঁছায়। সেই অর্থে সেটি পাওয়া আর না পাওয়া সমান হয়ে যায়। বরং না পাওয়াটাই শ্রেয়। পাওয়ার বিড়ম্বনার চেয়ে না পাওয়ার দুঃখ ততো প্রকট নয়। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় এসেও দেখছি সেই একই অবস্থা। বেসরকারি শিক্ষকদের বেলায় সবই তথৈবচ। ‘যেই লাউ সেই কদু’।

ঘুরেফিরে বারবার এইসব কথা ইদানিং মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়। কপাল ফেরার কোনো লক্ষণ দেখি না। মুখের কথায় সকলেই শিক্ষকদের মাথায় তুলে রাখে। এমনকি কখনো সাত আসমানের ওপরে উঠিয়ে রাখে। কিন্তু, দেবার বেলায় সকলেই দুহাত গুটিয়ে নেয়। এই কাজে মনে হয় সকলেই এক ক্ষুরে মাথা কামানো।

ঈদের আনন্দ ছোঁয় না যে ঘর

ঈদের আনন্দ ছোঁয় না যে ঘর

আমার দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে অর্ধেক সময় ‘বোনাস বিহীন’ আর বাকি অর্ধেক সময় সিকি উৎসব ভাতা পেয়ে কাটিয়েছি। তাই না পাওয়ার ব্যথা আর পাওয়ার বিড়ম্বনা দুটোই হাড়ে হাড়ে টের পাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার আছে। ঈদের মাত্র দুতিনদিন আগে কিংবা ইদের পরে সিকি উৎসব ভাতা পেয়ে মনে হতো, ধুর ছাই, এ দিয়ে কী হবে? এটি না পেলেও চলতো। উৎসব ভাতা ঈদের পরে কিংবা ঈদের দুতিনদিন আগে কেনো? ঈদের কমপক্ষে পনের-বিশ দিন আগে দেয়া যায় না? সরকারিদের তো সেভাবেই দেয়া হয়। অগ্রিম এক মাসের বেতনও দেয়া হয়। বেসরকারিদের সঙ্গে এই বৈষম্য কেনো? আমলা-কামলারা এতে খুবই আনন্দ পায়, তাই না? শিক্ষকদের সঙ্গে বেয়াদবি আর বেতমিজি করতে খুব মজা লাগে বুঝি! বেসরকারি শিক্ষকদের এই অদ্ভুত রকমের উৎসব ভাতা বছরে দুইবার তাদের কাছে দারুণ পীড়ার কারণ হয়ে এসে হাজির হয়। অনেকের তখন মনে হয়, এ বোনাস না দিলেই হতো। এ বোনাস না পেলেই চলতো। এ প্রসঙ্গে একটি কবিতার দুটি চরণ খুব মনে পড়ে যায়,

‘দিতে যদি হয় দে মা প্রসন্ন সহাস,

কেন এ মাথার ঘাম পায়েতে বহাস?’

শিক্ষকরা অনেক দাবি করেছেন। রোজার দিনেও ঢাকার রাজপথে গিয়ে দাবি জানিয়েছেন। অনেক মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছেন। বিশ-পঁচিশদিন সেহরি এবং ইফতার খেয়ে না খেয়ে রাজধানীতে অবস্থান করেছেন। কোনো লাভ হয়নি। কে শুনে কার কথা? শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া যারা শোনার কথা, তারা এ সময় বধির হয়ে যায়।

বেসরকারি শিক্ষকদের যে উৎসব ভাতা দেয়া হয়, সেটি দিলে কী আর না দিলে কী? গাঁও-গেরামে একটি কথা প্রচলিত আছে, 'খেলেও দিন যায়, না খেলেও যায়।' দুঃখে-কষ্টে তো কোনোভাবে দিন চলে যাবেই। তাহলে বোনাসের নাম করে অদ্ভুত (!) সিকি উৎসব ভাতা এবং তা সময়মতো না দিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে এ কেমন আচরণ করা হয়, সেটি কুড়ি বছর পর আজও আমার মতো অনেকের বিবেচনায় আসে না। সিকি উৎসব ভাতা কয় টাকা হয়? এই টাকা দিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীরা কি-ই বা করতে পারেন? দুর্মূল্যের বাজারে ছেলেকে একটি ভালো শার্ট কিংবা প্যান্ট কিনে দেয়া মুশকিল হয়। মেয়ের জন্য এক সেট ভালো সেলোয়ার কামিজ কিনে দেয়া যায় না। বউয়ের জন্য একটি ভালো শাড়ি কিনে দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। বাবার জন্য একটি পাঞ্জাবি আর মায়ের জন্য একটি পছন্দমতো শাড়ি কিনে দেবার স্বপ্ন সব সময় স্বপ্নই থেকে যায়। পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে মুখ সব সময় ছোট হয়ে থাকে। ঈদের আনন্দ বলে এসব পরিবারে কোনো উচ্ছ্বাস থাকে না। কেবলই হীনমন্যতা। একজন শিক্ষকের যেখানে সমাজে মাথা উঁচু করে থাকার কথা, সেখানে পরিবারের লোকজনের কাছে ঈদে হীনমন্য হয়ে থাকতে হয়। বেসরকারি শিক্ষকদের ঈদে এক মাসের অগ্রীম বেতন দিলে কী সমস্যা হয়? অন্তত ইদটি স্বাচ্ছন্দ্যে উদযাপনের সুযোগ করে দিতে তো কোনো বাধা দেখি না।

একদিকে ঈদ সমাগত আর অন্যদিকে রোজার মাস চলছে। সংগত কারণে সাংসারিক ব্যয় অন্য যেকোনো মাসের চেয়ে অনেক বেশি হয়। এই সহজ হিসাবটি আমলা-কামলাদের মাথায় ঢোকে না। ইএফটি বিড়ম্বনায় এখনো অনেক শিক্ষক-কর্মচারী ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন পানরি বলে শুনেছি। এটি খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। ইএফটিতে যাদের বেতন দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, তাদের বিষয়টি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত ম্যানুয়েল পদ্ধতিতে বেতন দিতে অসুবিধা কোথায়? বেতন না পেয়ে এসব শিক্ষক-কর্মচারীর পরিবার রোজার মাসটি কীভাবে অতিক্রম করছেন, তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ বুঝার কথা নয়। সামনের ঈদটি তাদের কাছে আনন্দ উচ্ছ্বাসের পরিবর্তে বিরাট এক বেদনার স্মারক হয়ে আসছে। শিক্ষা প্রশাসনে যারা কাজ করে, তাদের ধিক্কার জানানোর ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। বিশেষ করে যারা বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নিয়ে কাজ করে, তাদের কেবলি অভিশাপ দিতে মন চায়। এদের জীবন অভিশপ্ত হোক। যারা ঈদে ও রমজানে শিক্ষকদের আনন্দকে মাটি করে দিতে তৎপর, এদের এই বদদোয়া দেয়া ছাড়া আমাদের মতো নগণ্য মানুষদের করার আর কী আছে? এদের কারণে শিক্ষকদের ঘরে ঈদের আনন্দটুকু পৌঁছাতে পারে না। বরাবর ঈদের আনন্দ এসব পরিবারে অধরা থেকে যায়। সিকি উৎসব ভাতাটির অবসান চাই। এই ঈদে তো আর সম্ভব নয়, আগামী ইদুল আজহা থেকে শতভাগ উৎসব ভাতার আনন্দ ঈদ আনন্দকে শতগুণ বাড়িয়ে তুলুক-সেই প্রত্যাশায় আজ এখানেই শেষ করছি।

লেখক : আবাসিক সম্পাদক, দৈনিক আমাদের বার্তা (লন্ডন)

শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল   SUBSCRIBE  করতে ক্লিক করুন।

#উৎসব ভাতা #এমপিও #স্কুল #কলেজ #শিক্ষক