সিনিয়র জেলা জজের মর্যাদায় আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) ছিলেন বিকাশ কুমার সাহা। এর আগে ছিলেন ঢাকা মহানগর মুখ্য হাকিম (সিএমএম)। এই এক বিকাশেই ধ্বংস হয়ে গেছে দেশের নিম্ন আদালত। গুরুত্বপূর্ণ এই দায়িত্বে থাকাকালে তিনি শেখ হাসিনার লাঠিয়ালের ভূমিকা পালন করেন।
জুডিশিয়াল গডফাদার হিসেবে পরিচিত বিকাশের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে। আইন মন্ত্রণালয় তার দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে জবাব চাইলে তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দেন।
ঢাকা বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট খোরশেদ আলম বলেন, সিএমএম থাকাকালে বিকাশ আদালতে মাফিয়াতন্ত্র চালু করেছিলেন। ঢাকা বারের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন, আদালত থেকে রাতে তিনি বাসায় যেতেন টাকার বস্তা নিয়ে। সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেছেন, বিকাশ কুমার সাহা ছিলেন শতভাগ জুডিশিয়াল ক্রিমিনাল।
আদালতপাড়ায় বিকাশ কুমার সাহার দৌরাত্ম্য নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে তার অপকর্মের বিস্তর অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে শেখ হাসিনা তার দুঃশাসনকে ১৫ বছরে টেনে নিতে যে কয়েকজন বিচারকের ওপর ভর করেছিলেন, বিকাশ ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। এ সময় তিনি আইন মন্ত্রণালয় ও ঢাকা মহানগর মুখ্য হাকিম (সিএমএম) পদে থেকে পুরো অধস্তন আদালতকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। আইন মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন কর্মকর্তারাও আমার দেশকে নানা তথ্য জানান।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, শেখ হাসিনার আনুকূল্য কাজে লাগিয়ে পুরো বিচার বিভাগে নিজস্ব বলয় তৈরির মাধ্যমে দুর্নীতি ও অনিয়মের ‘রামরাজত্ব’ কায়েম করেন বিকাশ কুমার।
নিয়োগ, বদলি ও জামিন বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল অর্থের মালিক হন বলেও তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে নিশ্চিত হয় আইন মন্ত্রণালয়। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুর্নীতি ও অনিয়মের ব্যাখ্যা চাওয়ায় চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে পালিয়ে গেছেন তিনি। দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি টিম তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্ত ও অনুসন্ধান করছে।
শেখ হাসিনার ১৫ বছরে বিরোধী দল-মত দমনে বিকাশ কুমার আদালতে ‘মাফিয়াতন্ত্র’ চালিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন ঢাকা আইনজীবী সমিতির সিনিয়র একাধিক সদস্য। আর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্যরা জানান, বিকাশ কুমার সাহা ছিলেন শতভাগ ‘জুডিশিয়াল ক্রিমিনাল’। বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দমনে বিচারিক ক্ষমতাকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করেছেন তিনি।
সিএমএম কোর্টে বিকাশ কুমারের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার সময় বিকাশ কুমার সাহা আইন মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সহকারী সচিবের পদে ছিলেন। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যক্রম শুরু হলে সরকার তাকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) পদে পদায়ন করে। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ নভেম্বর থেকে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ৫ আগস্ট পর্যন্ত অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ পদ মর্যাদায় ছিলেন তিনি।
ঢাকা আইনজীবী সমিতির একাধিক জ্যেষ্ঠ সদস্য জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রহসনের বিচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পুলিশ গ্রেফতার করে সিএমএম আদালতে সোপর্দ করত। আর বিকাশ তাদের রিমান্ডে পাঠিয়ে নির্যাতনের সুযোগ করে দিতেন। ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি দেলোয়ার হোসেনকে টানা ৪৫ দিনসহ মোট ৫৩ দিন রিমান্ডে পাঠিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করে সিএমএম আদালত। ওই সময় ডিবি পুলিশ তার হাত ও পায়ের নখ তুলে ফেলে এবং নির্যাতন করে কোমর ভেঙে দেয়।
সিএমএম আদালতে বিকাশের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন আরেক মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আসাদুজ্জামান নুর। ম্যাজিস্ট্রেট আসাদুজ্জামান নুর যুক্তরাষ্ট্রে শেখ হাসিনার ছেলে ও তার তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ এবং হত্যাচেষ্টার মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও প্রবীণ সাংবাদিক শফিক রেহমানকে সাত বছর করে কারাদণ্ড দিয়ে বিচারের ইতিহাসে আরেকটি খারাপ নজির স্থাপন করেন। ওই মামলায় শুনানি শেষে বিচারপ্রার্থী জয়ের প্রতি আনুগত্য দেখাতে এজলাস ছেড়ে তার পেছনে পেছনে দৌড়ে যান বিচারক আসাদুজ্জামান। রায় ঘোষণার পর মাহমুদুর রহমানের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নাল আবেদিন মেজবাহ এমন একটি ছবি সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরে অবিচারের বিবরণ দেন।
আইনজীবীরা জানান, ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের প্রার্থীবিহীন ভুয়া ভোটের পর বিএনপির নেতৃত্বে তীব্র অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিরোধী দলের শত শত নেতাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ আদালতে সোপর্দ করার পর সিএমএম বিকাশ কুমার ও তার সহযোগীরা তাদের রিমান্ডে পাঠিয়ে দিতেন।
বিরোধী নেতাকর্মীদের রিমান্ডে পাঠানোর পাশাপাশি জামিন বাণিজ্যের অভিযোগও রয়েছে বিকাশ কুমারের বিরুদ্ধে। সাধারণত যেসব গুরুতর ও চাঞ্চল্যকর মামলায় হাইকোর্টও জামিন দেয় না, টাকার বিনিময়ে ঢাকার সিএমএম বিকাশ কুমার সেসব মামলায়ও জামিন দিয়েছেন। এমন অসংখ্য নজির রয়েছে বলে দাবি করেছেন ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
নজরুল ইসলাম বলেন, রাতে বাসায় ফেরার পথে গাড়িতে করে বিকাশ কুমার বস্তায় করে টাকা যেতেন। এমন ঘটনা বহুদিন ঘটেছে। আদালতের আইনজীবীরা এটি সরাসরি দেখেছেন বলেও জানান ঢাকা বারের সাধারণ সম্পাদক।
বিকাশ কুমারের বস্তায় ভরে টাকা নেওয়ার বিষয়টি ঢাকার সিএমএম আদালতের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুখে মুখে রয়েছে। চাকরিবিধি ও নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে নিজের পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানান, এজলাসের পেছনে ‘বিকাশ বাবু’র খাসকামরায় কোটি টাকার লেনদেনও হয়েছে। বড় ও প্রতিষ্ঠিত শিল্প গ্রুপের মালিকরাও তার খাসকামরায় এসে জামিনের বিষয়ে কথা বলতেন। রাতে ফেরার সময় বাজারের বড় ব্যাগে করে কোনো কোনো দিন বস্তায় করে টাকা নিয়ে গাড়িতে তুলে দিতেন কোর্টের কর্মচারীরা। এ ঘটনাটি আদালতের সঙ্গে যুক্তরা জানেন বলেও দাবি ওই কর্মকর্তার।
আদালতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় আনিসুল হকের প্রতিদ্বন্দ্বী
২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টের প্রথম সপ্তাহে বিকাশ কুমারকে পদোন্নতি দিয়ে ঢাকার সিএমএম আদালত থেকে আইন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব করা হয়। পরবর্তী সময়ে তাকে সিনিয়র জেলা জজের মর্যাদায় মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন-১) করা হলে সারা দেশের অধস্তন আদালতগুলোর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেন তিনি। সচিবালয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের কার্যালয়ে বসে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের রিমান্ড ও জামিন দেওয়া, না দেওয়ার বিষয়টি তদারক করতেন। বিকাশ কুমারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য আদালতে অভিযোগ জানাতেন গ্রেপ্তার হওয়া নেতাকর্মীদের আইনজীবীরা।
আইনজীবীদের দাবি, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় সন্দেহজনকভাবে কেউ গ্রেফতার হলে আদালত তাদের জামিন মঞ্জুর করে। অথচ এসব মামলায়ও আদালত জামিন তো দূরের কথা, উল্টো রিমান্ডে পাঠিয়ে নির্যাতনের মুখে ঠেলে দেওয়া হতো।
আইনজীবীদের অভিযোগের ভিত্তিতে ওই সময়ে আদালতের তিনজন বিচারকের সঙ্গে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট মামলার সূত্র ধরে আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে কথা বলা হয়। জামিনযোগ্য ধারায় হওয়া মামলায় জামিন না দিয়ে উল্টো রিমান্ডে দেওয়ার কারণও জানতে চাওয়া হয় তাদের কাছে। বিচারকরা এজন্য পরিস্থিতি বিবেচনায় নেওয়াসহ ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা’র নির্দেশনার কথা জানান।
একজন বিচারক একটি টেলিফোনের কলরেকর্ডও শোনান, যেখানে যুবদলের একজন নেতাকে জামিনযোগ্য ধারায় হওয়া মামলায় হাইকোর্টের নির্দেশনা মেনে জামিন দেওয়ায় তিরস্কার ও ভর্ৎসনা করা হয়। তাকে ঢাকার আদালত থেকে শাস্তিমূলক বদলিরও হুমকি দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে জামিন দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের নির্দেশনার কথাও স্মরণ করিয়ে দিতে শোনা যায়। ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা বিকাশ কুমার সাহা কি না জবাবে ওই বিচারক বলেন, ‘আইন মন্ত্রণালয় থেকে সব ধরনের নির্দেশনা বিকাশ স্যারের পক্ষ থেকেই আসত।’
আইন মন্ত্রণালয় থেকে অবসরে যাওয়া একজন সচিব জানান, বিকাশ বাবুর সরাসরি সম্পর্ক ছিল শেখ হাসিনার সঙ্গে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নির্যাতনের জন্য শেখ হাসিনা তার ওপরই বেশি নির্ভর করতেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বহু নির্দেশনা বাস্তবায়ন হতো বিকাশ কুমারের হাত দিয়ে। এ নিয়ে মন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে বিকাশ কুমারের বিরোধও তৈরি হয় বলে জানান অবসরপ্রাপ্ত ওই সচিব। তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে বিকাশ কুমার একপর্যায়ে মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমে মন্ত্রী আনিসুল হকের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন।’
দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে চাকরি থেকে ইস্তফা
ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর নিজেকে গুটিয়ে নেন বিকাশ কুমার। অন্তর্বর্তী সরকার ১৩ আগস্ট তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে। পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে দুদক তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করে। গত ২ মার্চ শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে বিকাশ কুমার সাহাকে একটি শোকজ নোটিস দেয় মন্ত্রণালয়। এতে ঘুষ গ্রহণ ও মন্ত্রণালয়ের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে জবাব তলব করা হয়।
ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়মের বিষয়ে শোকজের জবাব না দিয়ে গত ১০ মার্চ বিকাশ কুমার চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। পদত্যাগপত্রে বিকাশ কুমার সাহা লেখেন, ‘আমি নিম্নস্বাক্ষরকারী ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ এপ্রিল সহকারী জজ পদে যোগদান করে নিয়মিত পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগে সংযুক্ত কর্মকর্তা (সিনিয়র জেলা জজ) হিসেবে কর্মরত আছি। বর্তমানে আমার চাকরিকাল ২৫ বছরের ঊর্ধ্বে। আমি ব্যক্তিগত কারণে সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর ধারা ৪৪ অনুযায়ী সরকারি চাকরি থেকে ঐচ্ছিক অবসর গ্রহণ করতে ইচ্ছুক।’
চাকরি থেকে ইস্তফা দিলেও তার দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে দুদক অনুসন্ধান ও তদন্ত অব্যাহত রাখতে হবে বলে জানিয়েছেন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।
ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে দুর্নীতি
আইন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, সারা দেশে জামিন ও খালাস বাণিজ্যের পাশাপাশি দেশের ৪১টি আদালতে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের জন্য বহুতল আদালত ভবন নির্মাণ প্রকল্পের প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন এই বিকাশ কুমার সাহা। দুই হাজার ২৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ ভবনগুলো নির্মাণের দায়িত্ব গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকলেও যাবতীয় কাজ তদারকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এ প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ ও ভবন নির্মাণে বিপুল পরিমাণ অর্থ লোপাট হয়েছে। এ লোপাটের পেছনেও বিকাশ কুমারের হাত ছিল। প্রকল্পে তার সম্পৃক্ততা ও দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে এখন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান করছে।
অস্ট্রেলিয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার ও সেখানে নিজের ও পরিবারের নামে বাড়ি করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে বিকাশ কুমারের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে তথ্য চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনে চিঠি দিয়েছে বলে জানিয়েছেন কমিশনের এক কর্মকর্তা।
দেশের বিভিন্ন আদালতে লোকবল নিয়োগের কথা বলে ঘুষ নিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে বিকাশ কুমারের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের একটি নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আইন ও বিচার বিভাগের ওএসডি কর্মকর্তা সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ বিকাশ কুমার সাহা যুগ্ম সচিব (প্রশাসন-১) হিসেবে কর্মরত থাকাকালে কক্সবাজার জেলা জজ আদালত, চট্টগ্রাম জেলা জজ আদালত ও জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থায় কর্মচারীদের শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে অর্থ গ্রহণ করেছেন। চাকরি দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ভুক্তভোগীরা ওই টাকা ফেরত চাইলে তিনি তার পদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়ার ভীতি প্রদর্শন করেন।
নথিতে আরো উল্লেখ রয়েছে, বিকাশ কুমার সাহার উক্তরূপ কার্যকলাপ অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত, অবিবেচনাপ্রসূত ও অবিচারকসুলভ মনোভাব। একজন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার জন্য অপ্রত্যাশিত ও দুর্নীতিমূলক কাজ হিসেবে গণ্য, যা বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা, ২০১৭-এর বিধি ২(চ) ও ২(ঠ) অনুযায়ী যথাক্রমে অসদাচরণ ও দুর্নীতিমূলক কার্যের পর্যায়ভুক্ত অপরাধ। সে কারণে ওই বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার উক্ত আচরণ ও দুর্নীতিমূলক কার্যের কারণে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালা, ২০১৭-এর ৩(২) বিধি অনুযায়ী আইন ও বিচার বিভাগের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ বিকাশ কুমার সাহার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের কপি প্রেরণ পূর্বক আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বর্ণিত অভিযোগের বিষয়ে তার লিখিত ব্যাখ্যা তলব করা হয়েছে। তবে নির্দিষ্ট সময় পার হলেও এ বিষয়ে বিকাশ কুমার সাহা কোনো জবাব দেননি।
বিকাশ কুমার সাহাকে বিচার বিভাগের মাফিয়া হিসেবে আখ্যায়িত করে কঠোর শাস্তি দাবি করেছেন ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট খোরশেদ আলম। তিনি বলেন, বিকাশ কুমার ঢাকার আদালতে মাফিয়াতন্ত্র চালু করেছিলেন। ঢাকার সিএমএম পদে থাকা অবস্থায় বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতা ও দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমদের বিনা কারণে দিনের পর দিন রিমান্ডে পাঠিয়ে নির্যাতনের মুখে ঠেলে দিতেন এ বিকাশ। এ ছাড়া বদলি বাণিজ্য ও জামিন বাণিজ্য ছিল তার অবৈধ আয়ের অন্যতম উৎস।
খোরশেদ আলম জানান, পুলিশ ব্যবসায়ীদের ধরে এনে সিএমএম আদালতে হাজির করত। আর বিকাশ কুমার রিমান্ডে পাঠিয়ে জামিনের দেনদরবার করত। পরে বিপুল পরিমাণ ঘুসের বিনিময়ে তাদের জামিনে ছেড়ে দিত। যতদিন তিনি ঢাকার আদালতে ছিলেন, ঢাকা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে আওয়ামীপন্থি আইনজীবীদের বিজয়ী করে দিতেন। এখানে নির্বাচনকে তিনি একটি প্রহসনে পরিণত করেছিলেন।
বিকাশ কুমার ও শেখ হাসিনার সম্পর্ক ছিল ওয়ান টু ওয়ান। এমনটিই দাবি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। সুপ্রিম কোর্টের এ সিনিয়র আইনজীবী বলেন, শেখ হাসিনা যদি মনে করতেন কাউকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসাতে হবে, সেটা বিকাশ কুমারকে বলতেন। তাদের সম্পর্কের মাঝখানে কোনো ভায়া ছিল না। বিকাশ কুমার ঢাকার সিএমএ আদালতে থাকা অবস্থায় বিএনপিসহ বিরোধী দল ও মতের নাগরিকদের ইচ্ছামতো রিমান্ডে পাঠাতেন। পুরস্কার হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে তাকে আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবের পদে বসানোর পর তিনি আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। শেখ হাসিনার ইচ্ছে পূরণে সারা দেশের বিচার বিভাগের অঘোষিত নিয়ন্ত্রক বনে যান বিকাশ। তিনি নিজেকে দেশের জুডিশিয়াল ক্রিমিনালে পরিণত করেছিলেন বলেও অভিযোগ ব্যারিস্টার খোকনের।
ব্যারিস্টার খোকন বলেন, তিনি মূলত দেশের নিম্ন আদালত ও আইন মন্ত্রণালয় সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। কাজে জামিন দেবে আর কাকে জামিন দেবে না এবং কাকে রিমান্ড দেবে, বিচারকদের এসব নির্দেশনা বিকাশ কুমার দিত। উপরে অনতিবিলম্বে তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে বলেও জানান সিনিয়র এ ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ।
মন্ত্রণালয়, আইনজীবী ও দুদকের অভিযোগের বিষয়ে বিকাশ কুমারের বক্তব্য নেওয়ার জন্য যোগাযোগ করা হয়। তার মুঠোফোনে বার্তা দিয়ে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। তার কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন, এমন কর্মচারী ও তার নিকটজনের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়। কেউ তার সন্ধান দিতে পারেননি। সূত্র: আমার দেশ