পতিত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘোষণা ছিল জেলায় জেলায় চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করার, হয়েছেও তাই। গত ১৫ বছরে অর্ধশতাধিক মেডিক্যাল কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এসব কলেজের বড় অংশই চালুর ৮ থেকে ১০ বছর হলেও এখনো স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়ে ওঠেনি।
এমন পরিস্থিতিতে জোড়াতালি দিয়ে চলা অন্তত ২৬টি সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ বন্ধ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ইতোমধ্যে অনেকগুলো সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রতিবেদনও তৈরি হচ্ছে। তবে সংস্কারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ভার থাকবে নির্বাচিত সরকারের ওপর।
এ সব মেডিক্যালের কোনো কোনো ক্যাম্পাসের জায়গাও ঠিক হয়নি। পাঠদানের জন্য নেই প্রয়োজনীয় শিক্ষক। ভাড়া হাসপাতালের কক্ষে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। এমনকি শ্রেণিকক্ষ ও গবেষণার সংকটও পাওয়া গেছে।
অথচ যেকোনো মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠায় অবকাঠামোর পাশাপাশি দক্ষ লোকবল ও আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যবস্থা থাকা বাধ্যতামূলক। এসব কিছু না থাকায় শিক্ষার ঘাটতি নিয়েই প্রতি বছর বের হচ্ছেন হাজার হাজার চিকিৎসক। যাদের বেশির ভাগই থেকে যাচ্ছেন অদক্ষ। এটি আগামী দিনে স্বাস্থ্যখাতের জন্য চরম হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একজন সচিব বলেন, বিগত পনেরো বছরে আওয়ামী লীগ সরকার তাদের রাজনৈতিক সংকটে মানুষের আস্থা অর্জনে কোনো ধরনের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা ছাড়াই জেলায় জেলায় মেডিক্যাল কলেজ গড়ে তোলে। অবকাঠামো ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের বড় অংশেই সুযোগ-সুবিধা নেই। এতে করে হাতেকলমে শিক্ষার ঘাটতি নিয়ে প্রতি বছর হাজার হাজার চিকিৎসক বের হচ্ছে।’
পনেরো বছরে ৫২ কলেজের অনুমোদন
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে গত বছরের ৫ আগস্ট পতনের আগ পর্যন্ত ১৫ বছরে ৫২টি মেডিক্যাল কলেজের অনুমোদন দিয়েছে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকার। এর মধ্যে ২০টি সরকারি আর ৩২টি বেসরকারি। আবার এক বছরেই (২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে) অনুমোদন পেয়েছে ১৬টি কলেজ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক দেশে ৫০ বছরেও এত মেডিক্যাল অনুমোদন পায়নি।
দায়সারাভাবে চলছে ব্যবহারিক শিক্ষা
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব মেডিক্যাল কলেজের অধিকাংশই হয়েছে তদবির আর রাজনৈতিক বিবেচনায়। ফলে দেখা হয়নি প্রয়োজনীয়তা। ছিল না প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা। ফলে এখনো এসব প্রতিষ্ঠানে সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা না হলেও থেমে নেই শিক্ষার্থী ভর্তি। এতে করে তৈরি হচ্ছে অদক্ষ চিকিৎসক।
মেডিক্যালের শিক্ষার্থীরা বলছেন, এমবিবিএসে ভর্তির পর প্রথম পর্বের দেড় বছরের মধ্যে অ্যানাটমি, ফিজিওলজি ও বায়োকেমিস্ট্রি পড়তে হয়। দ্বিতীয় পর্বে এক বছরে ফার্মাকোলজি ও ফরেনসিক মেডিসিন বিষয়ে। তৃতীয় পর্বে এক বছরের জন্য পড়তে হয় কমিউনিটি মেডিসিন, প্যাথলজি ও মাইক্রোবায়োলজি। চতুর্থ পর্বে ক্লিনিক্যাল বিষয় পড়তে হয়।
সেখানে গাইনি, মেডিসিন ও সার্জারি তিনটি প্রধান বিষয় রয়েছে। এসব বিষয় হাসপাতালে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ব্যবহারিকভাবে করতে হয়। কিন্তু নিজস্ব হাসপাতাল না থাকায় ব্যবহারিকে ঘাটতি নিয়েই শিক্ষাজীবন শেষ করতে হচ্ছে। দায়সারাভাবে ব্যবহারিক শিক্ষা চলছে সংশ্লিষ্ট জেলা হাসপাতালগুলোতে।
খোদ সরকারি ছয়টি হাসপাতালেও এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এই তালিকায় রয়েছে, রাঙ্গামাটি মেডিক্যাল কলেজ, হবিগঞ্জ মেডিক্যাল কলেজ, নওগাঁ মেডিক্যাল কলেজ, নেত্রকোনা মেডিক্যাল কলেজ, মাগুরা মেডিক্যাল কলেজ ও নীলফামারী মেডিক্যাল কলেজ।
আসন কমছে হাজারের বেশি
এদিকে মানহীন মেডিক্যাল কলেজ বন্ধের পাশাপাশি হাজারের বেশি আসন কমিয়ে আনার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন পরিচালক এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন বলেন, বিগত বছরগুলোতে অপরিকল্পিতভাবে শুধু সরকারি ২৩টি মেডিক্যাল কলেজই গড়ে তোলা হয়েছে। এর মধ্যে ছয়-সাতটির অবস্থা একেবারে খারাপ। আসন বাড়ানো হয়েছে হাজারের বেশি। বিষয়গুলো নিয়ে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে দুই দফা বৈঠক হয়েছে। এর মধ্যে আসন কমানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। চিন্তায় আছে মানহীন মেডিক্যাল কলেজ বন্ধের। আগামী বছর এগুলো বাস্তবায়ন হতে পারে।
মানসম্মত চিকিৎসাশিক্ষার মনোনয়নে যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে জানিয়ে অধ্যাপক নাজমুল হোসেন বলেন, যেসব মেডিক্যাল কলেজ একেবারে পুরোনো, সেগুলোর ব্যাপারেও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। ১০টি মেডিক্যাল কলেজের জন্য ১৯টি হাসপাতাল নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। ঢাকা মেডিক্যালের জন্য দুটি হাসপাতাল ও একটি একাডেমিক ভবন করার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে।
একই সঙ্গে বেসরকারি কলেজ বন্ধের ক্ষেত্রে আগামী বছর থেকে প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। সবকিছু এখন পর্যালোচনায় রয়েছে, তালিকা হচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আরেকটা সংকট হলো দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকদের পদোন্নতি হয়নি। সেটি না হলে শিক্ষক সংকট হবেই। এ বিষয়টিও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।