দীর্ঘ ২১ বছর ধরে কলেজে যান আট শিক্ষক। ক্লাস নেন। কলেজের সব রকম নিয়মনীতি মেনে চলেন। প্রতিবছর শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিয়ে বেরও হয়ে যায়। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে বহু ছাত্র দেশের বড় বড় সেক্টরগুলোতে সম্মানের সঙ্গে চাকরি করছেন। কিন্তু হতভাগা ওই আট শিক্ষক আজও তাদের এমপিওভুক্ত করাতে পারেননি। পাননি এক টাকা বেতন-ভাতাও। কলেজের অধ্যক্ষ স্বয়ং তাদের সঙ্গে প্রতারণা করে জীবন ধ্বংস করে দিয়েছেন। নিয়োগের সময় ওই শিক্ষকদের থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষও নিয়েছেন অধ্যক্ষ। সেই ঘুষের টাকা নেয়ার সময় কলেজের প্যাডে লিখিত ডকুমেন্ট দিয়েছেন সেই অধ্যক্ষ। এত কিছু করার পরও কেন এমপিওভুক্তির জন্য মনোযোগ দেননি এ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। ভুক্তভোগী শিক্ষকরা এতদিন মুখ বুজে থাকলেও এখন অভিযোগ তুলেছেন জোরালোভাবে।
ঘটনা বগুড়া সদরের গোদারপাড়া এলাকায় অবস্থিত জাহিদুর রহমান মহিলা ডিগ্রি কলেজে। ওই কলেজের অধ্যক্ষ মাহাবুব আলম অজ্ঞাত কারণে ডিগ্রি পোস্টের শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির জন্য প্রচেষ্টা চালাননি। ফলে ২১ বছর ধরে ঝুলে রাখা আট শিক্ষক অনেকটা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন। তাদের অনেকেরই এখন অবসরে যাওয়ার সময় এসেছে। পরিবার, সমাজের কাছে তারা অবহেলার পাত্রতে পরিণত হয়েছেন। তাদের কষ্ট সমাধানে কোনোদিনই অধ্যক্ষ কর্ণপাত করেননি। লোক দেখানো এমপিও’র আবেদন করেছিলেন কয়েক দফা। ভুলভালভাবে আবেদন করায় একবারও আবেদন মঞ্জুর হয়নি। বিষয়টি নিয়ে ভুক্তভোগী শিক্ষকরা নিজেরা চেষ্টা করার জন্য আলাদা কমিটির অনুমোদন চাইলেও অধ্যক্ষ মাহাবুব কোনোভাবেই সাড়া দেননি। এখন শিক্ষকদের দাবি- হয়তো ডিগ্রি পর্যায়ে এমপি হলে বর্তমান অধ্যক্ষ তার পদ হারাতে পারেন। তার একাডেমিক সনদে কোনো পর্যায়ে ঘাপলা আছে সেটি যাচাই-বাছাইয়ে ধরা পড়লে পদ থাকবে না। এমন আশঙ্কা থেকেই হয়তো এমপিও হোক তিনি সেটি চাননি কখনো। নিজের ব্যক্তিগত চেয়ার ঠিক রাখার জন্য চোখের সামনে আটজন শিক্ষকের জীবন ধ্বংস করেছেন তিনি। শুধু তাই নায়, ওই অধ্যক্ষ কলেজে নানাভাবে আর্থিক দুর্নীতির সঙ্গেও জড়িত বলে জোরালো অভিযোগ করেছেন শিক্ষকরা। তার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই বগুড়া জেলা প্রশাসক, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে প্রশাসনিকভাবে তদন্ত চলমান রয়েছে। জাহিদুর রহমান মহিলা ডিগ্রি কলেজের ডিগ্রি পর্যায়ের নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক ইসমত আরা (ইতিহাস), জিনাত পারভীন (সমাজবিজ্ঞান), মিজানুর রহমান (ইংলিশ), ইবাদুর রহমান (বাংলা), সেলিনা আক্তার (মনোবিজ্ঞান), সেলিনা আক্তার (ইসলামের ইতিহাস)। আয়েশা সিদ্দিকা (অর্থনীতি) এবং রেজাউল করিম (ইসলাম শিক্ষা)। এই শিক্ষকদের সব নিয়ম মেনে ২০০৪ সালে নিয়োগ দেন অধ্যক্ষ মাহাবুব আলম। নিয়োগের সময় কৌশলে মোটা অঙ্কের টাকাও নিয়েছেন অধ্যক্ষ। দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের এমপিও করে দেয়ার প্রতিশ্রুতিও দেন অধ্যক্ষ। কিন্তু আজ কাল করতে করতে জীবন থেকে প্রায় ২১ বছর পার হলেও এমপিও মুখ দেখেননি উল্লেখিত শিক্ষকরা। দীর্ঘ সময় ধরে একটি কলেজকে প্রতিষ্ঠিত করার বিনিময়ে শেষ পর্যন্ত অধিকারটুকুও পেলো না তারা। কলেজ তহবিলে পর্যাপ্ত টাকা থাকলেও সেই তহবিল থেকেও কোনোদিন ওই শিক্ষকদের সম্মানি দেয়া হয়নি।
স্থানীয়ভাবে চেষ্টা করে অধ্যক্ষের অসহযোগিতার কারণে যখন এমপিও হলো না তখন কয়েকজন শিক্ষক আদালতের শরণাপন্ন হন। আদালত বিষয়টি দীর্ঘদিন যাচাই-বাছাই করে সরকারের ওপর ছেড়ে দেয়। রায়ে উল্লেখ করা হয় সরকার যদি ইচ্ছে করে তাদের বেতন-ভাতা দিতে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আদালতের সেই রায়ও কোনো দপ্তর ভ্রুক্ষেপ করেনি।
বিষয়গুলো নিয়ে অধ্যক্ষ মাহাবুব আলমের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, ডিগ্রির শিক্ষকদের এমপিও করার জন্য একাধিকবার আবেদন করেছি। কর্তৃপক্ষ প্রত্যেকবারই আবেদন বাতিল করে দিয়েছে। এখানে আমার কোনো কিছু করার ছিল না।
বগুড়া জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজা বলেন, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগগুলো তদন্ত হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে কোনো অন্যায়ের প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করা হবে। সেইসঙ্গে ডিগ্রি পর্যায়ের শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করার জন্য আমার পক্ষ থেকে অধ্যক্ষকে চাপ সৃষ্টি করবো।