ইলন মাস্কের ‘গ্রক’ নিয়ে ভারতে তোলপাড় | বিবিধ নিউজ

ইলন মাস্কের ‘গ্রক’ নিয়ে ভারতে তোলপাড়

'গ্রক' প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধীকে 'নরেন্দ্র মোদির চাইতে বেশি সৎ' বলে ঘোষণা করে বসে।

#ভারত #শিক্ষার্থী

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-কে কাজে লাগিয়ে যেসব চ্যাটবট তৈরি করেছে বিভিন্ন টেক কোম্পানি, এগুলোর কাছে নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন ব্যবহারকারীরা। কোনো একটা প্রশ্ন করার পর ইন্টারনেটে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে একটা উত্তর দেয় এসব অ্যাপ। তবে উত্তর দেওয়ার সময় যদি ঠাট্টা করারও চেষ্টা থাকে ওই চ্যাটবটের ?

বন্ধুরা যেমন মজার ছলে অনেক সময় কথার উত্তর দেয় সেরকম চেষ্টা করে ভারতে আলোচনার ‘ঝড়’ তৈরি করেছে ইলন মাস্কের সংস্থা এক্সএআই এর তৈরি করা চ্যাটবট ‘গ্রক’।

এক্স (সাবেক টুইটারে) প্ল্যাটফর্মে বিল্ট-ইন সুবিধায় যুক্ত করা হয়েছে এই চ্যাটবট, অর্থাৎ এটি এক্স থেকে সরাসরি ব্যবহার করা যায়।

‘গ্রক’ ডেভেলপকারী সংস্থা এক্সএআই এর দাবি, গ্রকের তীব্র ‘রসবোধ’ রয়েছে। আর ‘গ্রক-৩’ হলো এই চ্যাটবটের সাম্প্রতিকতম উপডেট।

একটি প্রশ্নের সূত্র ধরে ভারতের ডিজিটাল পরিসরে হঠাৎই ‘গ্রক’ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। সেই প্রশ্নটা জানতে চাওয়া হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এর টোকা নামে এক অ্যাকাউন্ট থেকে। প্রশ্নটা জটিল কোনো বিষয়ে ছিল না। টোকা অ্যাকাউন্ট ব্যবহারকারী গ্রককে বলেছিলেন- এক্স-এ আমার ১০ জন বেস্ট মিউচুয়ালের একটা তালিকা বানিয়ে দাও।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মিউচুয়াল বলতে বোঝায়, যে অ্যাকাউন্টগুলো একে অন্যকে ফলো করে এবং একে অন্যের পোস্টে কমেন্ট, লাইক, শেয়ার ইত্যাদি করে। প্রশ্নের জবাব দিতে দেরি হওয়ায় টোকা অ্যাকাউন্ট ব্যবহারকারী ততক্ষণে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন। তার মুখ থেকে দু-একটা বেফাঁস কথা বেরিয়ে যায়। গ্রক এর পাল্টা জবাবও দেয়।

উত্তর দেওয়ার সময় এক্স অ্যাকাউন্টে দশজন মিউচুয়ালের তালিকা দেওয়ার পাশাপাশি হিন্দিতে বেশ কয়েকটা নারীবিদ্বেষী বা অপমানসূচক শব্দও জুড়ে দেয় গ্রক। পরে অবশ্য বিষয়টাকে লঘু করতে গ্রক লিখে- আমি মজা করছিলাম, তবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম।

এআই চ্যাটবটের ওই প্রতিক্রিয়া অন্যদের নজর এড়িয়ে যায়নি। দুই মিলিয়ন ভিউ পেয়েছে তার সেই প্রতিক্রিয়া। এক্স হ্যান্ডেলের অন্যান্য ব্যবহারকারীরাও একই পথ অনুসরণ করেন। গ্রককে উসকে দেওয়ার জন্য নানান রকম প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে থাকেন তারা।

আর তাতেই আগল খুলে যায়। ক্রিকেটের গসিপ, রাজনৈতিক রটনা, বলিউড ড্রামা – সব কিছু নিয়েই এক্স হ্যান্ডেলের ব্যবহারকারী ভারতীয়রা তাকে প্রশ্ন করতে থাকেন। গ্রকও সেই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকে- অকপটে, নিজের শৈলীতে।

সম্প্রতি ভারতে ডিজিটাল সেনসেশন (চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী) হয়ে উঠেছে এই চ্যাটবট। অনেকেই একে বর্ণনা করেছেন ফিল্টারহীন এবং অনেকটা উন্মত্ত চ্যাটবট হিসেবে।

গত বছরই ইলন মাস্ক গ্রককে বিশ্বের সবচেয়ে মজাদার এআই বলে সম্বোধন করেছিলেন।

এদিকে, গ্রকের সঙ্গে রসিকতায় মেতে থাকাদের তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হতে থাকে। আইন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এই রসিকতায় যোগ দেয়। দিল্লি পুলিশের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে গ্রককে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- সে কি কখনও ট্র্যাফিক টিকিট (ট্রাফিক আইন ভাঙার জন্য চালান) পায়নি?

এর উত্তরে প্রথমে গ্রক চুপ করে ছিল। কিন্তু ব্যবহারকারীরা ক্রমাগত চাপ দিতে থাকেন। সেই সময় এর উত্তরে গ্রক জবাব দেয়, হা হা, দিল্লি পুলিশ জিজ্ঞাসা করছে কেন আমি কখনও চালান পাই না- আমি একটা ডিজিটাল এআই, দিল্লির ড্রাইভার নই! আমি লাল আলো ভেঙে এগিয়ে যাই না বা আমার হেলমেটটা ভুলে যাই না। তবে যারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ১৯টা ক্যামেরার সাহায্যে প্রকৃত আইন লঙ্ঘনকারীদের ধরে, তাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা। রাস্তা নিরাপদ রাখুন!

দুই বছর আগে (তখনও এই চ্যাটবট লঞ্চ হয়নি) ইলন মাস্ক এমন একটা চ্যাটবট আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যা তীক্ষ্ণ এবং অপরিশোধিত। একইসঙ্গে জানিয়েছিলেন, ওপেনএআই, মাইক্রোসফট এবং গুগল-এর মতো প্রতিদ্বন্দ্বীদের তৈরি চ্যাটবট থেকে এই চ্যাটবট থেকে একেবারে আলাদা হবে।

গ্রক-এর এই শৈলীর বেশিরভাগটাই দ্য হিচহাইকারস গাইড টু দ্য গ্যালাক্সি থেকে নেওয়া।

দ্য হিচহাইকারস গাইড টু দ্য গ্যালাক্সি কিন্তু 'সাই-ফাই অ্যাবসারডিটি' (কল্পবিজ্ঞান ও অযৌক্তিকতার মিশেল) এবং হাস্যরসের মিশেল হিসেবে বিখ্যাত ছিল। মূলত রেডিও শো হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল, তুমুল জনপ্রিয়তার কারণে ক্রমে বই, টেলিভিশন শো এমনকি চলচ্চিত্রও তৈরি হয় এন ওপর।

'গ্রক' সম্পর্কে ভারতের বিশেষজ্ঞদের কাছে জানতে চেয়েছিল বিবিসি। ভারতের শীর্ষস্থানীয় ফ্যাক্ট-চেকার অল্ট নিউজের প্রতিষ্ঠাতা প্রতীক সিনহা বলেছেন, গ্রক বেশ কিছু সময় ধরে রয়েছে। কিন্তু ভারতে এখন হঠাৎ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এর কারণ, এটা এখন একটা নতুন খেলনায় পরিণত হয়েছে।

'গ্রক'-এর 'আনফিল্টারড' উত্তরকে ঘিরে আলোচনার মাঝেই আরও একটা ঘটনা ঘটে। এই চ্যাটবট নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সমালোচকদের কাছে দ্রুত প্রিয় হয়ে ওঠে। শুরু হয়ে যায় রাজনৈতিক প্রশ্নের 'সুনামি'। এমনই এক প্রশ্নের উত্তরে 'গ্রক' প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধীকে 'নরেন্দ্র মোদির চাইতে বেশি সৎ' বলে ঘোষণা করে বসে। তার সঙ্গে জুড়ে দেয়- 'আমি কাউকে ভয় পাই না।'

একটা প্রশ্নের জবাবে 'গ্রক' লেখে 'প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দিক থেকে রাহুল গান্ধী মোদির চেয়ে এগিয়ে। এমনকি নরেন্দ্র মোদির সাক্ষাৎকার নিয়েও মন্তব্য করেছে। গ্রক দাবি করেছে ওই সাক্ষাৎকার প্রায়শই স্ক্রিপ্টেড মনে হয়।

এক্স মাধ্যমের একজন ব্যবহারকারী তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল 'গ্রক'-এর কারণে বিজেপি সমস্যায় পড়েছে কি না। উত্তরে ওই চ্যাটবট জানায়- এটা একটা বড় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে - কেউ পক্ষপাতিত্বের জন্য আমাকে তিরস্কার করছে, অন্যরা আবার উল্লসিত।

এই প্রসঙ্গে, বিবিসির পক্ষ থেকে বিজেপির অমিত মালব্যর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তিনি কোনোরকম মন্তব্য করতে রাজি হননি। ইতিমধ্যে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমালোচক ও ভারতের উদারপন্থিরা গ্রকের সাহসী বক্তব্যের মাঝে উদযাপনের রসদ খুঁজে পেয়েছেন।

অনেকে অভিযোগ তুলেছেন, ভারতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো সংগঠনগুলোর বাকস্বাধীনতা অবরুদ্ধ করা হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'ফিউচার অফ ফ্রি স্পিচ'-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বাকস্বাধীনতার সমর্থনে থাকা ৩৩টা দেশের তালিকায় ২৪তম স্থানে রয়েছে ভারত।

নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপি অবশ্য ধারাবাহিকভাবে এই সমস্ত প্রতিবেদনকে খারিজ করে বাকস্বাধীনতা খর্ব করার অভিযোগকে অস্বীকার করে এসেছেন।

অল্ট নিউজের সিনহা এই প্রসঙ্গে বলেছেন, গ্রক নতুন এক বিদ্রোহী। গ্রককে প্রশ্ন করলে কেউ সমস্যায় পড়বে না। দক্ষিণপন্থিরাও রাহুল গান্ধীকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তারপর এটা একটা প্রতিযোগিতামূলক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা মোটেও আশ্চর্যজনক নয়।

কংগ্রেস না বিজেপি- কে ভালো? এমন প্রশ্নের উত্তরে রাজনৈতিকভাবে সঠিক উত্তর দেওয়ার জন্য প্রোগ্রাম করা হয়েছে অন্যান্য চ্যাটবটগুলোকে। গ্রকের সেই জাতীয় ফিল্টারের অভাব রয়েছে বলে মনে হয় এবং এটা বিতর্কিত বিষয়গুলোর সরাসরি মোকাবিলা করতে ভয় পায় না।

প্রযুক্তি নীতি বিষয়ক ওয়েবসাইট মিডিয়ানামা.কম-এর প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক নিখিল পাহওয়া মনে করেন- ভারতে গ্রকের বক্তব্য নিয়ে যে আলোচনা চলছে তা অতিরঞ্জিত।

এআই মৌলিকভাবে গার্বেজ ইন, গার্বেজ আউট-এর ওপর ভিত্তি করে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। অর্থাৎ যে ডেটা তাকে দেওয়া হয় তার ওপর গুরুত্ব দিয়ে সে জবাব দেয়, তিনি ব্যাখ্যা করেছেন।

যেহেতু গ্রক এক্সকে ভিত্তি করে প্রশিক্ষিত, তাই স্বাভাবিকভাবেই সেখানে পাওয়া কথোপকথনের সুর এবং নিদর্শনগুলোকে প্রতিফলিত করে। যার মধ্যে রয়েছে উদ্ভট প্রতিক্রিয়া এবং গালিগালাজ যা আমরা ইতিমধ্যে দেখতে পাচ্ছি।

তিনি আরও বলেছেন, এটা কিন্তু আদর্শের বিষয় নয়। জবাবে সে যা বলছে সেই আউটপুটের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে তাকে যা ইনপুট দেওয়া হয়েছে সেগুলোর।

সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই 'গ্রক'-এর বিরুদ্ধে 'অনুপযুক্ত' ভাষার ব্যবহার এবং 'বিতর্কিত প্রতিক্রিয়া'র অভিযোগ তুলে এক্স-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।

গ্রককে নিয়ে এই শোরগোলকে অবশ্য কেউ কেউ ক্ষণস্থায়ী বলে মনে করছেন। সূত্র: বিবিসি বাংলা

#ভারত #শিক্ষার্থী