বিদেশে উচ্চশিক্ষা: বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ | মতামত নিউজ

বিদেশে উচ্চশিক্ষা: বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ

উন্নতমানের শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ: বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, এবং ইউরোপের দেশগুলোতে অবস্থিত। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক কারিকুলাম, উন্নত গবেষণা সুবিধা এবং বিশ্বমানের শিক্ষকেরা পাঠদান করেন। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসা, ব্যবসা এবং সামাজিক বিজ্ঞানের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসব বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

#উচ্চশিক্ষা

বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেয়ার স্বপ্ন আজকের তরুণদের মধ্যে বেশ সাধারণ। উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা সুযোগ এবং ভালো ক্যারিয়ারের আশায় প্রতিবছর হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিদেশে পড়তে যান। কিন্তু বাস্তবে এই যাত্রা অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। শুধুমাত্র ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াই যথেষ্ট নয়, বরং পড়াশোনা, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, ভাষাগত সমস্যা, সাংস্কৃতিক পার্থক্য, চাকরির সুযোগ এবং অভিবাসন নীতির মতো অনেক বিষয়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। এই প্রবন্ধে আমরা বিদেশে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন, বাস্তবতা এবং সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো, যা আগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক হতে পারে।

বিদেশে উচ্চশিক্ষার প্রধান প্রধান কারণ হলো-১. উন্নতমানের শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ: বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, এবং ইউরোপের দেশগুলোতে অবস্থিত। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক কারিকুলাম, উন্নত গবেষণা সুবিধা এবং বিশ্বমানের শিক্ষকেরা পাঠদান করেন। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসা, ব্যবসা এবং সামাজিক বিজ্ঞানের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসব বিশ্ববিদ্যালয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

২. ক্যারিয়ার গঠনের সম্ভাবনা ও উচ্চ আয়: বিদেশি ডিগ্রিধারীরা বিশ্বব্যাপী চাকরির বাজারে বেশি প্রতিযোগিতামূলক হয়ে ওঠেন। আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো বিদেশি ডিগ্রিধারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে, কারণ তারা বৈচিত্র্যময় পরিবেশে কাজ করতে সক্ষম। এ ছাড়া, প্রযুক্তি ও ব্যবসা সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোতে বিদেশি ডিগ্রির ফলে বেতন তুলনামূলকভাবে বেশি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

৩. বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক গঠনের সুযোগ: বিদেশে পড়াশোনা করলে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দেশের ও সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। এটি ভবিষ্যৎ কর্মক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক তৈরি করতে সাহায্য করে, যা চাকরি ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে বড় সুবিধা এনে দিতে পারে।

৪. উন্নত জীবনযাত্রার মান ও নিরাপত্তা: উন্নত দেশগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা, বাসস্থান, নিরাপত্তা, এবং সামাজিক সুযোগ-সুবিধা অনেক ভালো। অনেক শিক্ষার্থী শুধু পড়াশোনার জন্যই নয়, বরং স্থায়ীভাবে উন্নত জীবনের আশায় এসব দেশে যান।

৫. স্থায়ী বসবাসের সুযোগ: কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, এবং নিউজিল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য স্থায়ী বসবাসের সুযোগ সহজলভ্য। যারা উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে কাজ করতে চান, তাদের জন্য এসব দেশ বিশেষ সুবিধা প্রদান করে।

৬. নতুন ভাষা শেখার ও ব্যক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ: বিদেশে পড়াশোনা করতে গেলে শিক্ষার্থীদের নতুন ভাষা শিখতে হয়, যা ভবিষ্যতে কর্মজীবনে উপকারী হতে পারে। এ ছাড়া, আত্মনির্ভরশীলতা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা, এবং সাংস্কৃতিক সহনশীলতা বৃদ্ধির সুযোগও থাকে।

৭. সংস্কৃতি ও অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্য: বিদেশে পড়তে গেলে বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয়, যা ব্যক্তিগত ও সামাজিক বিকাশে সহায়ক হয়।

বিদেশে উচ্চশিক্ষার বাস্তবতা

বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেয়া সহজ নয়। এর জন্য অনেক ধাপ অনুসরণ করতে হয়। এগুলো ১. বিশ্ববিদ্যালয় ও কোর্স নির্বাচন: সঠিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কোর্স নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত শিক্ষার্থীরা নিম্নলিখিত বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে নির্বাচন করেন: বিশ্বব্যাপী র‌্যাঙ্কিং, বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ ও স্কলারশিপ সুবিধা, গবেষণার সুযোগ, আবাসন ও জীবনযাত্রার ব্যয়, অভিবাসন নীতি ও চাকরির সুযোগ, ২. ভর্তির যোগ্যতা ও আবেদন প্রক্রিয়া: বিদেশে ভর্তি পেতে হলে সাধারণত নিম্নলিখিত শর্ত পূরণ করতে হয়। পূর্ববর্তী একাডেমিক রেজাল্ট, ইংরেজি ভাষার দক্ষতা পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয়তা গবেষণা প্রস্তাবনা ইত্যাদি।

৩. স্কলারশিপ ও অর্থায়ন: বিদেশে পড়ার খরচ অনেক বেশি। তবে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি স্কলারশিপ পাওয়া যায়, যেমন: চেভেনিং স্কলারশিপ (যুক্তরাজ্য), ফুলব্রাইট স্কলারশিপ (যুক্তরাষ্ট্র), এরাসমাস মুন্ডস স্কলারশিপ (ইউরোপীয় ইউনিয়ন), অস্ট্রেলিয়া অ্যাওয়ার্ডস স্কলারশিপ, ভ্যানিয়ার কানাডা গ্র্যাজুয়েট স্কলারশিপ, যারা স্কলারশিপ পান না, তাদের শিক্ষাঋণ, পার্ট-টাইম চাকরি, বা ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়।

৪. স্টুডেন্ট ভিসা প্রসেসিং: প্রতিটি দেশের স্টুডেন্ট ভিসার শর্ত আলাদা। সাধারণত ভিসার জন্য প্রয়োজন হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অফার লেটার, ব্যাংক স্টেটমেন্ট (আর্থিক প্রমাণ), স্বাস্থ্য বিমা, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, মেডিক্যাল পরীক্ষা, কিছু দেশে ভিসা পাওয়া সহজ হলেও, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার মতো দেশে ভিসা ইন্টারভিউ বেশ কঠিন হতে পারে।

বিদেশে উচ্চশিক্ষার চ্যালেঞ্জ হলো-১. উচ্চ খরচ ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ: বিদেশে পড়াশোনার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো উচ্চ টিউশন ফি ও জীবনযাত্রার ব্যয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোতে টিউশন ফি খুব বেশি, যা অনেক শিক্ষার্থীর জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে শিক্ষাবৃত্তি ও অর্থায়নের সুযোগ খোঁজা, পার্ট-টাইম চাকরি করা, ব্যয় সংকোচন ও সাশ্রয়ী জীবনযাপন।

২. ভাষাগত সমস্যা ও যোগাযোগের বাধা: যেসব শিক্ষার্থীর মাতৃভাষা ইংরেজি বা অধ্যয়নের ভাষা নয়, তাদের জন্য ভাষাগত বাধা বড় একটি সমস্যা। অনেক শিক্ষার্থী প্রথমদিকে লেকচার বুঝতে বা পরীক্ষায় ভালো করতে সমস্যায় পড়েন। এজন্য বিদেশ যাওয়ার আগে ভাষার ওপর দক্ষতা বৃদ্ধি। ইংরেজি বা স্থানীয় ভাষার কোর্স করা। স্থানীয়দের সঙ্গে বেশি যোগাযোগ করা।

৩. সাংস্কৃতিক পার্থক্য ও সামাজিক মানিয়ে নেয়া: নতুন দেশে এসে শিক্ষার্থীরা খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, সামাজিক আচরণ, এবং ধর্মীয় চর্চায় পার্থক্যের সম্মুখীন হন। এতে কিছু শিক্ষার্থী হতাশা বা সাংস্কৃতিক শকের শিকার হন। তাই স্থানীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা। বন্ধু তৈরি করা ও সামাজিকভাবে সক্রিয় থাকা।

৪. মানসিক চাপ ও একাকীত্ব: অনেক শিক্ষার্থী পরিবার ও পরিচিত পরিবেশ থেকে দূরে থাকার কারণে একাকীত্ব ও হতাশায় ভোগেন। নতুন পরিবেশে পড়াশোনা, চাকরি, এবং ব্যক্তিগত দায়িত্ব সামলানো মানসিক চাপে পরিণত হতে পারে। ফলে স্থানীয় কমিউনিটি ও সহপাঠীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা। মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে ব্যায়াম ও ইতিবাচক কার‌্যক্রমে অংশগ্রহণ করা। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং নেয়া।

৫. ভিসা ও অভিবাসন সংক্রান্ত জটিলতা: অনেক দেশে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভিসা ও অভিবাসন প্রক্রিয়া জটিল এবং ব্যয়বহুল। শিক্ষার্থী ভিসার সীমাবদ্ধতা থাকায় অনেকে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়েন। এজন্য যথাযথ নথিপত্র ও ভিসা সংক্রান্ত নিয়ম সম্পর্কে ভালোভাবে জানা। স্টুডেন্ট ভিসার নিয়ম মেনে চলা। দেশভেদে ভিসা সম্প্রসারণ বা স্থায়ী বসবাসের সুযোগ সম্পর্কে আগে থেকেই গবেষণা করা।

৬. চাকরি পাওয়ার প্রতিযোগিতা: অনেক দেশে স্থানীয় নাগরিকদের চাকরির ক্ষেত্রে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া হয়। ফলে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিযোগিতা কঠিন হয়ে পড়ে। তাই শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই দক্ষতা বাড়ানো। ইন্টার্নশিপ ও পার্ট-টাইম কাজ করা। ক্যারিয়ার পরামর্শদাতাদের সহযোগিতা নেয়া

৫. অভিবাসন আইন ও স্থায়ী বসবাসের জটিলতা: অনেক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা শেষে সেখানে স্থায়ী হতে চান, কিন্তু অভিবাসন নীতির কারণে সবাই সেটি করতে পারেন না। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন আইন কঠোর, যেখানে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় স্থায়ী হওয়ার সুযোগ বেশি।

বিদেশে উচ্চশিক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ

বাংলাদেশ সরকার বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে শিক্ষার্থীদের সহায়তা ও উৎসাহিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকার নিম্নলিখিত উদ্যোগগুলো গ্রহণ করে থাকে।

১. সরকারি বৃত্তি: সরকার মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বৃত্তির ব্যবস্থা করে, যা তাদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে সহায়তা করে। ২. শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও পরামর্শ সেবা: শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন শিক্ষার্থীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে তথ্য ও পরামর্শ প্রদান করে। ৩. বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক: সরকার বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে, যা শিক্ষার্থী বিনিময় ও যৌথ গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করে। বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীদের নিজ উদ্যোগেও প্রস্তুতি নেয়া গুরুত্বপূর্ণ।

সুতরাং, বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেয়া স্বপ্ন হলেও এটি বাস্তবায়ন করতে হলে যথাযথ পরিকল্পনা, অর্থনৈতিক প্রস্তুতি, ভাষাগত দক্ষতা, এবং মানসিক দৃঢ়তা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের উচিত আগে থেকেই গবেষণা করা, স্কলারশিপ খোঁজা, এবং সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে ধারণা রাখা। সঠিক সিদ্ধান্ত এবং প্রস্তুতির মাধ্যমে বিদেশে উচ্চশিক্ষার অভিজ্ঞতা জীবনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে পারে। তবে শুধুমাত্র বিদেশে পড়ার স্বপ্ন দেখা যথেষ্ট নয়, বাস্তব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার মানসিকতা গড়ে তোলাও জরুরি।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

#উচ্চশিক্ষা