দেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সামাজিক নিরাপত্তা চরম নিম্নগামী! শিশুসহ সমাজে কেউ নিরাপদ নয় আর নারীরা যেনো ডাবল নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। দেশের এই হাল কবে পরিবর্তন হবে সেই প্রশ্ন এখন সবার। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনী কখনই এ দেশের সাধারণ জনগণের জন্য ব্যবহৃত হয়নি, তারা ব্যবহৃত হয়েছে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য। নিরাপত্তা বাহিনী কখনই রাষ্ট্রের তথা জনগণের ছিলো না। পরিস্থিতি এখন যেনো এক দুর্বলতম অবস্থায় পৌঁছেছে। সমাজের সন্ত্রাসীরা যেনো আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এ থেকে মুক্তির উপায় কী।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী একটি বাসে ডাকাতি হয়। রাত আনুমানিক চারটার দিকে ঢাকা জেলার আশুলিয়া থানাধীন বাড়ইপাড়া এলাকার নন্দন পার্কের সমানে গাড়িটি টাঙ্গাইল অভিমুখ করে চালককে ভয় দেখিয়ে ডাকাতরা বলে দশ কিলোমিটারের মধ্যে গাড়িটি কোথাও থামালে তোকে জানে মেরে ফেলবো। পারে তারা যাত্রীদের সর্বস্ব লুটে নেয় আর গাড়িতে থাকা নারীদের চরমভাবে লাঞ্ছিত করে। লুন্ঠিত মালামালসহ দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে যায়।
পরবর্তীতে গাড়ির চালক গাড়ি নিয়ে চন্দ্রা মোড়ে আসলে যাত্রীরা জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করে ঘটনা পুলিশকে জানালে কালিয়াকৈর থানা টহল পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। এ সময় যাত্রীরা পুলিশকে ডাকাতির কথা বললে তারা মির্জাপুর থানায় গিয়ে অভিযোগ করতে বলেন। থানায় গিয়ে ডিউটি অফিসারকে মৌখিকভাবে জানান কয়েকজন যাত্রী।
এ হলো রাষ্ট্রের মান্ধাতার আমলের নিয়ম! ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বরত পুলিশ সমস্ত রাস্তায় জানিয়ে দেবে যাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সন্ত্রাসী ও ডাকাতদের ধরে ফেলা যায়। তা না, ভুক্তভোগীদের আমলাতন্ত্রিক জটিলতার মধ্যে ফেলে দিয়ে তাদেরই অভিযোগ জানাতে হবে থানায় গিয়ে, তাও সব থানায় জানালে হবে না। জানাতে হবে ঘটনা কোথায় ঘটেছে সেই অনুযায়ী থানার অবস্থান ঠিক করে সেখানে গিয়ে লিখিত অভিযোগ দিতে হবে। এতো সব করে করে ডাকাত বা সন্ত্রাসীরা নিরাপদে পালিয়ে যায়। রাষ্ট্রের এতো এতো বাহিনী, বড় বড় প্রশাসন বিভাগ কিন্তু সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় যেনো কোনো কিছুই নেই!
ডাকাতি ও যৌন নিপীড়নের ঘটনাটি গত সোমবার রাতে হলেও পুলিশ এ সংক্রান্ত মামলাটি নিয়েছে তিনিদিন পর অর্থাৎ শুক্রবার। ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন এবং ডাকতির এ রকম গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও মামলা নিতে বিলম্ব হলো কেনো? পুলিশ কি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ঘটনাটি আমলে নেয়নি?-এ রকম প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশের সময়ক্ষেপণ ও শৈথিল্য যে স্পষ্ট তা প্রমাণিত হয়েছে বড়াইগ্রাম থানার ওসিকে প্রত্যাহার করার সিদ্ধন্তের মাধ্যমে। বাসে ডাকাতি ও যৌন নিপীড়নের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই রংপুর মিঠাপুকুর উপজেলার শহীদ দিবসে শ্রদ্ধা জানাতে ফুল সংগ্রহ করতে যাওয়া এগার বছর বয়সী এক স্কুলছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আমাদের স্মরণে আছে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর রূপাকে হত্যা করা হয়েছিলো। সেই সময় দেশব্যাপী তীব্র প্রতিবাদ হলেও এর পরবর্তী সময়ে বাসে ধর্ষণ বন্ধ হয়নি। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে গাজীপুরে এক নারী শ্রমিককে চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে কুষ্টিয়ায় গণ-পরিবহনে একই ধরনের ঘটনার শিকার হন এক নারী। প্রতিটি ঘটনার পর আমরা একই প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই। প্রশাসন নড়েচড়ে বসে, পুলিশ কয়েকজন অপরাধীকে গ্রেফতার করে, মিডিয়া সরব হয়, কিছুদিন তীব্র আলোচনা চলে। কিন্তু অপরাধী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়না ফলে এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে।
২৩ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে ধর্ষণের প্রতিবাদে রংপুর টাউনহল গেটে রাস্তা অবরোধ করে জড়িতদের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। এতে নগরীর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কয়েকশ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। শিক্ষার্থীরা বলেন, দেশে এখন শিশুরাও নিরাপদ নয়। নারীরা রাস্তাঘাটে নিরাপদে বের হতে পরেন না। এ দেশের মানুষের রক্তে জুলাই আন্দোলন কেনো হয়েছে। পূর্বে এ ধরনের ঘটনা ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় হতো কিন্তু এখন কেনো? তারা শ্লোগান তোলেন ‘ধর্ষকের কালো হতা ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও, ধর্ষকের ফাঁসি চাই’। আমার বোন ধর্ষিত কেনো, ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই। পরে ধর্ষকের কুশপুতুলের ফাঁসি ও পুড়িয়ে দেয়া হয়। দেশে দিন দিন ধর্ষকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে অথচ প্রশাসন কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিচেছনা বলে মনে হচ্ছে না।
চলন্ত বাসে নারীদের নিরাপত্তা কতটা নড়বড়ে সেটি আঙ্গুল দিয়ে আবারও দেখিয়ে দিলো এই ঘটনা। পুলিশ সুপার বলছেন, ঘটনাটি ধর্ষণ নয়, বরং শ্লীলতাহানির পর্যায়ে ছিলো। নারীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে শরীরে হাত দেয়ার ঘটনাকে ‘সীমিত অপরাধ’ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। এর আগেও বুহুবার চলন্ত বাসে নারীদের ধর্ষণের ঘটনা জাতি প্রত্যক্ষ করেছে এবং প্রতিবারই রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া থেকে প্রতিরোধ ব্যবস্থার দুর্বলতা ফুটে উঠেছে। সাধারণ মানুষসহ নারীদের জন্য রাস্তাঘাট, বাস, ট্রেনসহ সবধরনের পরিবহন নিরাপদ হতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্র সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এই অপনিরাপদের বোঝা দেশের নাগরিকরা আর কতো বহন করবেন?
উচচতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরও এসব সামাজিক কাজে প্রয়োজনে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি প্রতিষ্ঠান প্রধান কিংবা কোন শিক্ষককে পছন্দ না হলেই প্রতিষ্ঠানে অরাজকতা সৃষ্টি করা আর রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিয়ে জনদুর্ভোগ তৈরি করা ছাড়া এ ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের দেখা যায় না। শুধু সরকারকে দায়ী করে দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়না। যার যার প্রতিষ্ঠানের আশেপাশে, নিজেদের বাড়িঘরের আশেপাশে প্রতিরোধ গড়ার জন্য এ ধরনের শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশকে সহায়তা করতে হবে। তাহলে সামাজিক সমর্থন শিক্ষার্থীদের প্রতি এমনিতেই উঠে আসবে। সমাজে বহু ধরনের অরাজকতা চলছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি এদিকে উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নজর নেই। তারা সামান্য কারণে চা খাওয়ার মতো তুচ্ছ ঘটনা কিংবা চেয়ার বসা নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড করে সমাজে আরো বিশৃঙ্খলা তৈরি করছে। এখানে অভিভাবকদেরকেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। এখন কোনো ধরনের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে কথা বলতে পারছেন না সমাজের এই অধপতনের কারণে।
আমরা চাই দূরপাল্লার সবধরনের পরিবহনে সিসিটিভি লাগানো বাধ্যতামূলক করা হোক। রাতের বেলা পুলিশের টহল কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। বাসমালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোকেও এ বিষয়ে কঠোর দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রতিটি চালক ও হেলপারের তথ্য পুলিশের ও শ্রমিক ও মালিক সংগঠনের ডাটাবেসে থাকতে হবে। রাতে দূরপাল্লার বাস ছাড়ার সময় প্রত্যেক যাত্রীকে চেক করতে হবে এবং পথে কোনো যাত্রীকে ওঠানো যাবে না। বিশেষ কারণে যদি ওঠানো হয় সেখানাকর যাত্রীদের পুরো পরিচয় আগে জানাতে হবে যদি বাসের মধ্যে কেউ ওঠাতে চান। তাদেরকে একমাত্র নির্ধারিত স্থান ছাড়া যেখানে সেখানে যাত্রী রাতে ওঠানোই যাবে না। তবে, বিশেষ জায়গা যেখানে পুলিশ ও আনসার টহল থাকবে তারা চেক করে ওঠাবেন। এগুলো করা বাধ্যতামুলক করতে হবে। এগুলো পুলিশের কাজ, বাসমালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের কাজ। এ ধরনের ব্যবস্থা তাদের আগে থেকেই নিতে হবে। তারা এসব কাজ কেনো করছেন না?
এসব অবস্থা নিয়ে ডাকাতরা গবেষণা করে বের করে কখন ও কীভাবে তাদের জন্য ডাকাতি করা সুবিধা হয় এবং সে অনুযায়ী দূরপাল্লার প্রায় সব ডাকাতিগুলোই সংঘটিত হচ্ছে। অথচ আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে আজ পর্যন্ত দেখলাম না, ডাকাতি হতে যাচ্ছে এ ধরনের কোনো গাড়ি থেকে সন্ত্রাসী বা ডাকাত ধরেছে। সিনেমার মতো ঘটনার পরে আসে পুলিশ। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে তাও হচ্ছে না। আমরা জানি পুলিশের মনোবল ভেঙে গেছে তাদেরকে অবৈধ কাজে ব্যবহার করার ফলে। কিন্তু আপনারা যদি জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করেন আপানাদের পাশে তখন সবাই থাকবে।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক