যুক্তরাজ্যের রাজপরিবারের রত্নভাণ্ডার সত্যিই এক বিস্ময়কর জগৎ। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ব্যবহৃত মুকুট ও রত্নগুলো এখন রাজা তৃতীয় চার্লসের অধিকারে। যা তাঁদের দীর্ঘ ঐতিহ্যের ধারক। রাজার অভিষেক অনুষ্ঠানে এই ঐশ্বর্যপূর্ণ রত্নগুলোর ঝলকানি বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এর আর্থিক মূল্য নিয়েও কৌতূহল আছে আপনার আমার মনে।
যেমনটি রত্ন ইতিহাসবিদ জোসি গুডবডি উল্লেখ করেছেন, এই রাজরত্নগুলোর সঠিক মূল্য নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব। এর কারণ হলো, বহু শতাব্দী ধরে এই রত্নগুলো রাজপরিবারের অংশ। সময়ের সাথে সাথে এদের আকার ও গঠনে পরিবর্তন এসেছে। কিছু নতুন রত্ন যোগ হয়েছে, আবার কিছু রত্নকে রূপান্তরিত করা হয়েছে। একটি রত্নের প্রকৃত মূল্য তখনই নির্ধারিত হয়, যখন বাজারে তার কোনো ক্রেতা থাকে অথবা কোনো বিমা কোম্পানি তার ক্ষতির বিপরীতে অর্থ দিতে রাজি হয়।
তবে একটি বিমা কোম্পানির প্রাথমিক অনুমান অনুযায়ী, ব্রিটিশ রাজমুকুট ও রত্নসম্ভারের ক্ষতিপূরণ মূল্য প্রায় ৫ বিলিয়ন পাউন্ড হতে পারে। এই বিশাল মূল্যের কারণে, যদি এই রত্নগুলোর বিমা করতে হয়, তাহলে বার্ষিক প্রিমিয়ামের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে প্রায় ১৮.৯ মিলিয়ন পাউন্ড। এমনকি শুধু রাজ্যাভিষেকের দিনের জন্য বিমা করতে গেলেও খরচ হবে প্রায় ৫১ হাজার ৭০০ পাউন্ড।
অ্যাডমিরাল ইন্স্যুরেন্সের হেড অব হাউসহোল্ড নোয়েল সামারফিল্ডের মতে, ক্রাউন জুয়েলসে ১০০টির বেশি বস্তু এবং ২৩ হাজারের বেশি রত্ন রয়েছে, যা সত্যিই 'অমূল্য'। রাজপরিবার কখনোই এগুলো বিক্রির কথা ভাবেন না, তাই এর কোনো আনুষ্ঠানিক আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়নি। তবে অনেক বিশেষজ্ঞের ধারণা, এর মূল্য ৩ থেকে ৫ বিলিয়ন পাউন্ড বা তারও বেশি হতে পারে।
১৯৬০ সালে ব্রিটিশ কূটনীতিক লর্ড এডওয়ার্ড টুইনিং তাঁর 'আ হিস্টরি অব দ্য ক্রাউন জুয়েলস অব ইউরোপ' বইতে এই রত্নগুচ্ছকে 'এত ভারী যে ধরে রাখা কঠিন' এবং 'মাথায় এটি পরা খুব বিরক্তিকর ও কষ্টকর' বলে উল্লেখ করেছিলেন। একইসাথে তিনি এর বিপুল আর্থিক মূল্যের কথাও বলেছিলেন, যা কেনা অসম্ভব।
রাজা তৃতীয় চার্লসের রাজ্যাভিষেকের দিনে দুটি প্রধান মুকুট জনসমক্ষে আসে। এর মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র ও আনুষ্ঠানিক হলো সেন্ট এডওয়ার্ড’স ক্রাউন। ১৬৬১ সালে রাজা দ্বিতীয় চার্লসের জন্য তৈরি এই সোনার মুকুটটির ওজন ২.০৭ কেজি। শুধু সোনার বাজারমূল্যেই এর দাম ১ লাখ ১৭ হাজার পাউন্ডের বেশি। এছাড়া এর কারিগরি, রত্ন এবং ঐতিহাসিক মূল্য তো রয়েছেই। অভিষেক শেষে রাজা যে ইম্পেরিয়াল স্টেট ক্রাউনটি পরেন, তাতে ২,৮৬৮টি হীরা, ১৭টি নীলকান্তমণি, ১১টি পান্না, ২৬৯টি মুক্তা এবং ৪টি রুবি খচিত রয়েছে।
অভিষেকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বস্তু ছিল রাজদণ্ড, যা রাজা দ্বিতীয় চার্লসের অভিষেক থেকে প্রতিটি রাজ্যাভিষেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ১.৩২ কেজি ওজনের সোনার তৈরি এই রাজদণ্ডের উপরে একটি ক্রুশ রয়েছে, যেখানে পান্না, রুবি, নীলকান্তমণি, হীরা ও মুক্তা বসানো।
অন্যদিকে, রানি কামিলা 'কুইন মেরিস ক্রাউন' পরেন, যা ১৯১১ সালে রাজা জর্জ পঞ্চমের রানি মেরির জন্য তৈরি হয়েছিল। ২ হাজার ২০০টি হীরাখচিত এই মুকুটে বিতর্কিত কোহিনুর হীরাটি ছিল না। এর পরিবর্তে এখানে কুইন এলিজাবেথ দ্বিতীয়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে কালিনান থ্রি, ফোর ও ফাইভ হীরা বসানো হয়েছে, যেগুলোর মোট ওজন ১৫৮ ক্যারেট এবং আনুমানিক মূল্য ৫ কোটি পাউন্ডের বেশি।
পরিশেষে বলা যায়, ব্রিটিশ রাজমুকুটের ও রাজরত্নগুলোর আর্থিক মূল্য নির্ধারণ করা অত্যন্ত কঠিন। এর ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রতীকী মূল্য এতটাই বেশি যে, একে কেবল অর্থের মাপকাঠিতে বিচার করা যায় না। যতদিন ব্রিটিশ রাজতন্ত্র বিদ্যমান থাকবে, ততদিন এই রত্নগুলো তাদের ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে অমূল্য হয়ে থাকবে। তবে ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, রাজতন্ত্রের পতনের পর অনেক রাজকীয় রত্নেরই নিলাম হয়েছে, যেমনটি টিফানির প্রতিষ্ঠাতা ফরাসি রাজমুকুটের ক্ষেত্রে করেছিলেন।