জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেশের ৬৪ জেলায় স্বতন্ত্র পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগের খবর প্রকাশিত হয়েছে ২৪ এপ্রিল। শিক্ষা বিষয়ক দেশের একমাত্র প্রিন্ট জাতীয় পত্রিকা দৈনিক আমাদের বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যায়, এসব পরীক্ষা কেন্দ্রে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও বোর্ডের সব পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া পিএসসিসহ অন্যান্য সরকারি বেসরকারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপনের কারণ হিসেবে বলা হয়, পরীক্ষা চলাকালীন স্কুল-কলেজগুলোতে দীর্ঘসময় ক্লাস বন্ধ থাকে এবং শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটে। বাস্তবতা হলো, স্কুল-কলেজের টার্ম পরীক্ষা, সমাপনী পরীক্ষা ইত্যাদি মিলে দীর্ঘ বিরতি ঘটে নিয়মিত ক্লাসে। এর থেকে পরিত্রাণ আবশ্যক।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রাক্তন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ড. আ ন ম এহছানুল হক মিলন বলেন, ২০০১-২০০৬ সময়কালে নকল প্রতিরোধ আন্দোলন করতে গিয়ে প্রত্যেক জেলায় স্বতন্ত্র পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে এমন অবকাঠামো নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরকে দিয়ে সম্ভ্যবতা যাচাইও করা হয়েছিলো। কিন্তু তখন সেটা বাস্তবায়ন করা যায়নি অর্থাভাবে ও কিছু আমলার বিরোধিতায়।
তিনি তখন বলেছিলেন, শিক্ষার্থীদের ক্লাস বন্ধ করে বসিয়ে রেখে পরীক্ষা গ্রহণ সময়োপযোগী নয়। এমনিতেই বছরে বিভিন্ন সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। তার ওপর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার মত বড় পাবলিক পরীক্ষার জন্য পুরো প্রতিষ্ঠানই বন্ধ রাখতে হয়। এটা ছাত্র জীবনের বড় অপচয়, রাষ্ট্রেরও। এর থেকে পরিত্রাণ আবশ্যক। পরীক্ষা কেন্দ্র গুলোকে তিনি মাল্টিপারপাস হল হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। যাতে এখানে জেলা পর্যায়ের সকল পরীক্ষা, নিয়োগ পরীক্ষা, পিএসসির পরীক্ষা, সভা সেমিনার, ওয়ার্কশপ ইত্যাদি আয়োজন করা যেতে পারে। এর জন্য আলাদা জনবল নেওয়া যেতে পারে।
এ বিষয়ে জনাব এহছানুল হক মিলনের মতামত চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমি পরীক্ষা থেকে নকল দূর করার উপায় খুঁজতে গিয়ে আলাদা পরীক্ষা হলের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করি। এর ফলে স্কুলের নিয়মিত পাঠদানের সময় নষ্ট হবে না। তাছাড়া পরীক্ষা কেন্দ্র নেওয়ার জন্য যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, পরীক্ষা কেন্দ্র হওয়ার সুবাদে যে আলাদা সুযোগ তা বন্ধ হবে। তিনি বলেন, কয়েকটি কেন্দ্রে পরীক্ষা চললে তা মনিটরিং করাও কষ্টসাধ্য। কিন্তু একটা সুনির্দিষ্ট স্থাপনায় পরীক্ষা হলে ব্যবস্থাপনা অনেক সহজ হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন উদ্যোগ আমার স্বপ্নের বাস্তবায়ন করবে। তবে এটা শিক্ষাভবন থেকে করা হলে ভালো হতো। তিনি তৎকালীন নকল প্রতিরোধ আন্দোলনের সফলতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন বিএনপি সরকারের আমলেই যতটুকু হয়েছে, আওয়ামী লীগ পরীক্ষায় নকল ফিরিয়ে এনেছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া নকল প্রতিরোধে আমাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থায় আশার আলো দেখা গিয়েছিল। কিন্তু আজ পরীক্ষা কেন্দ্র নানা কৌশলে নকলের কারখানায় পরিনত হয়েছে, সরকার শিক্ষকদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না। পাঠ্যবই নিয়ে বাণিজ্য ছাড়া ছাত্রদের স্বার্থ দেখা হয়নি। এ ধরনের বড় স্থাপনা হুট করে নির্মাণ না করে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে আরও মতামত নেওয়ার উপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন।
আগামী শত বছরের চাহিদা পূর্ণ করতে পারে এমন আধুনিক আইসিটি নির্ভর ভবন নির্মাণ হোক এমন প্রত্যাশা তাঁর। তিনি বলেন, এটা জেলা পর্যায়ে ভূমিকম্প আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এখানে সিনেপ্লেক্স থাকতে পারে যাতে শিক্ষার্থীদের সামাজিক মূল্যবোধের উপর নির্মিত সিনেমা দেখানো যায়, শিক্ষণীয় ডকুমেন্টারি দেখানো যায়। এখানে অন্য সময়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যায়। এ ধরনের একটা স্থাপনা শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের মতে, পাবলিক পরীক্ষার কেন্দ্র থাকায় দেশজুড়ে হাজারো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাসের পর মাস বন্ধ থাকে। ফলে পড়াশোনা মারাত্মক ব্যাহত হয়। এই অবস্থা থেকে রক্ষা পেতেই মূলত স্বতন্ত্র পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপনের চিন্তা।
এছাড়া, কোথাও কোথাও পরীক্ষার কেন্দ্র নিয়ে বাণিজ্যও হয়। একটি কেন্দ্রে যেসব স্কুলের পরীক্ষা নেওয়া হয়, সেখানে স্কুলের সঙ্গে কেন্দ্রের পরিদর্শকদের, কেন্দ্রসচিবের গোপন সমঝোতা হয়। পরীক্ষার হলে পরিদর্শকরা শিক্ষার্থীদের উত্তর বলে দিতে সহায়তা করেন। এছাড়া সংশ্লিষ্ট স্কুলের শিক্ষকরা পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রবেশ করে তাদের শিক্ষার্থীদের উত্তর বলে দেন। উপজেলা পর্যায়ে পরীক্ষাকেন্দ্রে পরীক্ষা নেওয়া হলে এ অনৈতিক সুবিধা কমবে।
সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর থেকে এমন একটা প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র দৈনিক আমাদের বার্তাকে নিশ্চিত করেছেন।
মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম-সচিব বলেন, বিষয়টি ইতিবাচকভাবে দেখছে মন্ত্রণালয়। একটা সভাও হয়েছে ইতিবাচকভাবে। ৩৬৫ দিনের মধ্যে গড়পরতা হিসেবে ১৫০ দিনের মতো ক্লাস হয় মর্মে সভায় আলোচনা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের একজন অধ্যাপক বলেন, বেসরকারি নিয়োগ পরীক্ষার কেন্দ্র হিসেবে ভাড়া দিয়ে প্রচুর টাকা আয় করে সরকারি বড় বড় স্কুল ও কলেজ। আলাদা পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপন হলে তাদের আয় কমে যাবে তাই তারা স্বতন্ত্র পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপনের বিরোধিতা করে আসছেন।
গত ১০ এপ্রিল এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছে । এতে সবগুলো বোর্ডে পরীক্ষায় বসার কথা ১৯ লাখের বেশি পরীক্ষার্থীর। কেন্দ্র সংখ্যা দুই হাজার ২৯১টি। এই কেন্দ্র নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক নেতিবাচক ঘটনা ঘটেছে। নানা অপরাধে কোথাও কোথাও পুরো কেন্দ্রসচিবসহ সব শিক্ষক বহিষ্কার হয়েছেন। টাকার বিনিময়ে কেন্দ্র পাওয়া ও তার অপব্যবহারের অসংখ্য অভিযোগ।