আমাদের দেশে যে দিবসগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে পালন করা হয়, তার মধ্যে অন্যতম হলো নারী দিবস। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রতিবছর মার্চ মাসের ৮ তারিখ বিশ্বজুড়ে উদযাপিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। লিঙ্গবৈষম্য দূর করে নারীর প্রতি সম্মান ও সমানাধিকারের বার্তা জানাতেই দিবসটি উদযাপিত হয়। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক এ বছরের দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিলো ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন নারী ও কন্যার উন্নয়ন’। শুধু যে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এই দিবসটি পালন করা হয় তা নয়। এই দিবসটি এতোটাই গুরুত্ব বহন করে যে, বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনও এটি পালন করে সাড়ম্বরে। যেমন, বার্লিন ভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ শাখা (টিআইবি) ‘নতুন বাংলাদেশ’: চাই নারীর সমঅধিকার ও মর্যাদা’- প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পালন করেছে এ বছরের নারী দিবস।
এতো চাকচিক্যের ভিড়ে নারী জাগরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলা রীতিমতো দুঃসাহসিক কাজ! পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে নারীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো এখন সমান্তরাল, সেটা ভাবতেই হবে। ভাবনা-চিন্তার ডামাডোলে তথ্য প্রযুক্তির অবদান একেবারেই অনস্বীকার্য। কিন্তু এই অনস্বীকার্য বিষয়ে এসে যদি কিছু স্বীকার করতে দ্বিধান্বিত হতে হয়, তাহলে সেই দায় কার? ‘ইন্টারন্যাশনাল গার্লস ইন আইসিটি ডে ২০২৫’ অর্থাৎ ‘আন্তর্জাতিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে মেয়েরা দিবস ২০২৫’। বাংলায় লিখে সার্চ করলে এক হতাশার চিত্র ভেসে ওঠে প্রযুক্তির উন্মুক্ত গহ্বরে। কারণ, প্রযুক্তি নির্ভর এই যুগে এই দিবসটির কোনো গুরুত্ব বাংলাদেশে নেই। এটি সরকারি, বেসরকারি কিংবা একেবারে সাধারণ পর্যায়ও পালন করা হয়নি। অন্তত গুগলের পর্যবেক্ষণ সেটিই দাবি রাখছে। যদি এই প্রশ্ন করা হয় এই দিবসটির কোন গুরুত্ব নেই কেন, সেটি কী খুব অন্যায় প্রশ্ন?
বাংলাদেশে পালন করা না হলেও আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন (আইটিইউ) বিশ্বব্যাপী এই দিবসটি যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে উদযাপন করে। ‘অন্তর্ভুক্ত ডিজিটাল রূপান্তরের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে মেয়েরা’ এই প্রতিপাদ্যের আলোকে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, ২৪ এপ্রিল ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের আন্তর্জাতিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি দিবস পালিত হবে।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে মেয়েরা দিবস প্রতিবছর এপ্রিল মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার পালিত হয়। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিত (এসটিইএম) ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ডিজিটাল সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়ার জন্য নারীদের অনুপ্রাণিত ও ক্ষমতায়িত করার জন্য আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন (আইটিইউ)-এর একটি বিশ্বব্যাপী উদ্যোগ। এই দিবসের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, লিঙ্গ ডিজিটাল বৈষম্য দূর করা এবং সকলের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে সমান প্রবেশাধিকার প্রচার করা। এ ছাড়াও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়সঙ্গত ডিজিটাল ভবিষ্যত গড়ে তোলার কাজে নারীদের অনুপ্রাণিত করা। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বিশ্বের ১৭১টি দেশে এই দিবসটি পালন হয়। আইটিইউ সংশ্লিষ্ট এক গবেষণায় দেখা গেছে, এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নারীদের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সম্পর্কিত ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ এখনও কম। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রযুক্তি গবেষণা, শিক্ষার পাশাপাশি নীতি নির্ধারণের সর্বোচ্চ স্তরে নারীরা প্রায় অনুপস্থিত। তারা পুরুষদের তুলনায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চাকরি ছেড়ে দেয়ার হারও বেশি। প্রতিটি শিল্পেই নেতৃত্বের ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য থাকলেও, ‘এসটিইএম’-এর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ব্যবধান দেখা যায়। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে নারীরা প্রায়শই ব্যবস্থাপক পদের পরিবর্তে জুনিয়র বা সহায়ক পদে নিজেদের খুঁজে পান, যেখানে অগ্রগতির সুযোগ খুব কম থাকে। তাদের নির্বাহী পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উদ্যোক্তা হওয়ার বা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতিনির্ধারকদের মধ্যে প্রতিনিধিত্ব করার সম্ভাবনাও কম। ‘এসটিইএম’-এ সাফল্য লাভের জন্য, মেয়ে এবং তরুণীদের নেতৃত্বের পদে থাকা নারীদের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে, অনুপ্রেরণা জাগিয়ে তুলতে হবে এবং তাদের অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টিকারী বাধা ভেঙে ফেলতে হবে। গার্লস ইন আইসিটি দিবসের মূল কাজ হচ্ছে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা, আরো ন্যায়সঙ্গত ভবিষ্যতের জন্য ক্ষমতায়ন এবং নেতৃত্ব বিকাশকে উৎসাহিত করা।
কেমব্রিজ কম্পিউটার ল্যাবরেটরির কম্পিউটার এবং তথ্য বিভাগের অধ্যাপক, ক্যারেন স্পার্ক জোন্স এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘প্রথমে মনে হয়েছিলো, কোডিং একটি খুব সংকীর্ণ দক্ষতার সেট বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে যে অল্প বয়সে কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং কোডিং দক্ষতা শেখার বিশাল সুবিধা রয়েছে। ডিজিটাল সাক্ষরতা শেখার বাইরে, যেসব শিশু কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং কোডিং শেখে তারা সমস্যা সমাধান, সৃজনশীলতা, গণিত, স্থানিক এবং যুক্তি দক্ষতা এবং আরও অনেক কিছুতে দক্ষতা অর্জন করে। এই দক্ষতাগুলো স্থানান্তরযোগ্য এবং জীবনচক্র জুড়ে উপকারী; পড়তে এবং লিখতে শেখা থেকে শুরু করে, পরীক্ষার ফলাফল উন্নত করা, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিতি এবং প্রযুক্তি শিল্পের ভেতরে এবং বাইরে অর্থপূর্ণ ক্যারিয়ার তৈরি করা। বিশ্ব যখন প্রযুক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন জীবন এবং কর্মক্ষেত্র উভয় ক্ষেত্রেই দক্ষতা অর্জনের জন্য সব শিশু এবং যুবক-যুবতীদের সঠিক দক্ষতা দিয়ে সজ্জিত করা গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে মেয়েদের প্রযুক্তি ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জনের সুযোগ নেই। আমাদের এমন ক্ষেত্রগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হবে যেগুলো সাধারণত পুরুষদের ক্ষেত্র, যেমন আইসিটি এবং ইঞ্জিনিয়ারিং-যেখানে এই অঞ্চলে কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি। প্রযুক্তি খাতে মেয়ে এবং মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধির ফলে লিঙ্গ-প্রতিক্রিয়াশীল প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের বিকাশ এবং এই ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণের জন্য আরও পথ উন্মুক্ত করার ক্ষেত্রেও বিশাল সুবিধা রয়েছে। আরো সুযোগ তৈরি করার জন্য, আমাদের ডিজিটাল লিঙ্গ বৈষম্যের বাধাও ভেঙে ফেলতে হবে যেখানে মেয়েদের ডিজিটাল ডিভাইসের মালিকানা, ইন্টারনেট বা প্রযুক্তিতে অ্যাক্সেসের সম্ভাবনা অনেক কম, এবং ফলস্বরূপ গুরুত্বপূর্ণ ডিজিটাল সাক্ষরতা দক্ষতা অর্জনের সুযোগ কম। আওয়ার অফ কোডের মতো প্রোগ্রামের মাধ্যমে, আমরা এই সীমানা ভেঙে এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য কোডিং এবং কম্পিউটার বিজ্ঞান দক্ষতা ভিত্তিক উদ্যোগে তরুণীদের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কাজ করতে পারি।
তিউনিসিয়ার এক চিকিৎসক মায়া ফাখফাখ 'পরবর্তী প্রজন্মের তরুণ ডিজিটাল উদ্ভাবকদের ক্ষমতায়ন করা' নিবন্ধে লিখেছেন, ‘আমি অন্যান্য অনুপ্রেরণামূলক ফেলো এবং দূরদর্শী নেতাদের সঙ্গে দেখা এবং সহযোগিতা উপভোগ করেছি যারা আমাদের সম্প্রদায়কে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহারে সমানভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমি এমন অনেক রোগীর মুখোমুখি হয়েছি যারা শেষ পর্যায়ের জরায়ু ক্যান্সারে ভুগছিলেন। এমন অনেক ধরনের ক্যানসার, আছে যা আমরা প্রযুক্তির সাহায্যে প্রতিরোধ করতে পারি। আমি একটি এআই-চালিত মোবাইল অ্যাপ সার্ভিস্ক্যানার চালু করার স্বপ্ন দেখি যা শুধু আমার নিজ মহাদেশ জুড়ে নয় বরং সারা পৃথিবীর অগণিত মানুষের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করতে পারে। সার্ভিস্ক্যানারটি নারীদের জরায়ুমুখ ক্যানসার স্ক্রিনিং বিশ্লেষণকে রূপান্তরিত করতে পারে। আমি প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে সত্যিই আগ্রহী, যা স্বাস্থ্যসেবায় বিপ্লব ঘটাতে এবং এটিকে আরো সহজলভ্য করে তুলতে পারে, বিশেষ করে দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য। তবে এই কাজে আমি তখনই সফল হবো যখন আমার চারপাশের নারীদের মধ্যে সচেতনতা মূলক প্রযুক্তির জ্ঞান থাকবে।
গত ২১ এপ্রিল চার দিনের সরকারি সফরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে গেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে তিনি ‘আর্থনা সামিট-২০২৫’ এ অংশগ্রহণ করবেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির আমন্ত্রণে এ সফরে যাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার। আজাদ মজুমদার আরও জানিয়েছেন, দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের চারজন জাতীয় নারী ক্রীড়াবিদ প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হিসেবে কাতারে যাচ্ছেন। এই চার ক্রীড়াবিদ হলেন—ফুটবলার আফিদা খন্দকার ও শাহেদা আখতার রিপা এবং ক্রিকেটার সুমাইয়া আখতার ও শারমিন সুলতানা। ‘আমাদের উত্তরাধিকার গড়ে তোলা: স্থায়িত্ব, উদ্ভাবন ও ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান’ প্রতিপাদ্যে দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠেয় ‘আর্থনা সামিট’ এ কাতারের উষ্ণ ও শুষ্ক আবহাওয়ায় টেকসই উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে দেশটির ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও অনন্য প্রতিবেশগত বৈচিত্র্যকে কাজে লাগানোর প্রতিশ্রুতি তুলে ধরা হবে। এই সামিট একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে যেখানে প্রথাগত জ্ঞান ও আধুনিক উদ্ভাবনের সমন্বয়ের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের নতুন দিক উন্মোচন এবং এক সমৃদ্ধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ গঠনের উপায় নিয়ে আলোচনা হবে। অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এক শিক্ষার্থী অনুস্কা ব্যানার্জী নারী দিবস উপলক্ষে ‘আমি নারী, আমি সব পারি’ শিরোনামের ফিচারে ফুটিয়ে তুলেছেন নারীর বিচরণ। নারীরা অদম্য। প্রযুক্তির চলমান এই যুগে নারীদের প্রয়োজন সহযোগিতা। প্রয়োজন সহমর্মিতা। সহযোগিতা আর সহমর্মিতার স্বচ্ছতা থাকলে কোনো বৈষম্য নারীদের আবদ্ধ করতে পারবে না। প্রতিটির মানুষ প্রযুক্তির সুফল ভোগ করবে এবং জীবনকে সেই ধারায় এগিয়ে নিয়ে যাবে, সেটাই আমাদের চাওয়া।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক