অর্থের সঙ্গে সুখের সম্পর্ক নেই | মতামত নিউজ

অর্থের সঙ্গে সুখের সম্পর্ক নেই

২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের প্রতিবেদন অনুসারে সুখী দেশের তালিকায় প্রথমেই রয়েছে ইউরোপের নর্ডিক দেশ ফিনল্যাণ্ড। দুই নম্বরে রয়েছে ফিনল্যান্ডের কাছের ইউরোপের আরেক দেশ ডেনমার্ক। তিন নম্বরে রয়েছে আরেক নর্ডিক দেশ আইসল্যান্ড। গত ১০ বছরে জাতিসংঘের সুখী দেশের তালিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইউরোপের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহ (ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন) প্রতিবছর তালিকায় প্রথম সারিতে থাকে।

#বিবিধ

সুখ। দুই অক্ষরের ছোট একটি শব্দ হলেও সমগ্র মানবজীবনে সুখের গুরুত্ব অপরিসীম। সুখের পেছনে ছুটছে সবাই! সুখী কে না হতে চায়। কিন্তু বাস্তবের সুখ লাভ করা অধিকাংশ মানুষের কাছে দুরূহ থেকে যায়! মনোবিদদের মতে, সুখ অনুভূত হয় দেহে আর শান্তি অনুভূত হয় মনে। মহাভারতের তত্ত্বকথা অনুসারে অন্তরের সন্তুষ্টিই প্রকৃত সুখ। মানসিকভাবে তৃপ্ত থাকতে পারলেই সুখের দেখা মিললেও মিলতে পারে। এবার সুখ বিষয়ক গবেষণায় নজর দেয়া যাক। জাতিসংঘ ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে বিশ্বের সুখী দেশের তালিকা প্রকাশ করে আসছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা ও জনমত জরিপ প্রতিষ্ঠান ‘গ্যালপ’ জাতিসংঘের হয়ে সুখী দেশের তালিকা প্রকাশ করে। বিভিন্ন দেশসমূহের কয়েক হাজার মানুষের দেয়া মতামতের ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়।

২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের প্রতিবেদন অনুসারে সুখী দেশের তালিকায় প্রথমেই রয়েছে ইউরোপের নর্ডিক দেশ ফিনল্যাণ্ড। দুই নম্বরে রয়েছে ফিনল্যান্ডের কাছের ইউরোপের আরেক দেশ ডেনমার্ক। তিন নম্বরে রয়েছে আরেক নর্ডিক দেশ আইসল্যান্ড। গত ১০ বছরে জাতিসংঘের সুখী দেশের তালিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইউরোপের স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহ (ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন) প্রতিবছর তালিকায় প্রথম সারিতে থাকে।

কেনো ইউরোপের এই দেশসমূহ বেশি সুখী? বিশ্বের মাথাপিছু আয়ের দিক দিয়ে কাতার বা অন্যান্য দেশ কেনো সুখী নয়? বিশ্বের ধনী দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া কেনো সুখী দেশের সেরা দশের মধ্যে স্থান পায় না? গবেষণার তথ্য অনুসারে, সুখী দেশের মানুষেরা প্রকৃতির কাছাকাছি থাকে। প্রকৃতির সান্নিধ্য লাভ তাদের জীবনে সুখী হতে বড় ভূমিকা পালন করেছে। ফিনল্যান্ডের হেলসিংকি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জেনিফার ডি পাওলার মতে, ফিনল্যান্ডের মানুষের সুখী হওয়ার প্রধান দুটি কারণ হলো প্রকৃতির সান্নিধ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মজীবন। উন্নত জীবনব্যবস্থা, নিরাপত্তা, বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবা ও উন্নত শিক্ষা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহের মানুষকে সুখী করতে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।

অনেকেই মনে করে থাকেন, যে ব্যক্তি যতো বেশি ধনী সে ততো বেশি সুখী। গবেষণার তথ্য বলছে ভিন্ন কথা। বিত্তের সঙ্গে সুখের সম্পর্ক খুব সামান্যই। সুখী মানুষের জীবনযাপন মূল্যায়নে বিভিন্ন অথনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনা করা হয়। ব্যক্তিগত সুস্থতার অনুভূতি, জিডিপি, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, সামাজিক নির্ভরশীলতা, উপার্জন, দুর্নীতির মাত্রা, পরস্পরের ওপর আস্থা ও উদারতার মতো সূচকগুলো বিবেচনায় নেয়া হয়। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহের সরকার নাগরিকদের কল্যাণকর জীবনগঠনে সর্বদা তৎপর থাকে। নাগরিকরা পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা ও বিশ্বাস পোষণ করে। তারা একে অপরের বিপদে পাশে থাকে এবং সর্বোপরি উন্নত সামাজিক জীবনে দায়বদ্ধ থাকে। সবচেয়ে সুখী দেশের মানুষেরা অন্য পাঁচ-দশটা মানুষের মতো সাধারণ জীবন কাটান। তবে তাদের জীবনযাপনের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা, আস্থা ও বিশ্বাসের প্রভাব ব্যাপক। তারা একটা সুস্থ ও আনন্দঘন সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে অবস্থান করেন। সুখী রাষ্ট্র বা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহের আরেকটি বড় উদাহরণ হলো, প্রত্যেক নাগরিকদের জন্য রয়েছে স্বাস্থ্যবিমা। কর্মসংস্থানহীন বেকারদের জন্য রয়েছে বেকার ভাতা। রয়েছে উন্নত শিক্ষার ব্যবস্থা। উন্নত শিক্ষার জন্য তাদের বাইরের দেশে গমন করা লাগে না বললেই চলে। সব নাগরিকদের কল্যাণে উচ্চ আয়কর দিতে এসব দেশের নাগরিকরা দ্বিধা করেন না।

অর্থ ও ক্ষমতা বলয়ের মধ্যে অবস্থান করলেই যে সুখ মিলবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। ‘গ্যালপে’র গবেষণা বলছে, একা সুখী থাকলেই সুখ মিলবে না। সুখ লুকিয়ে আছে সমাজের চারপাশের উপাদানের মধ্যেই। মানুষের মধ্যে মানুষের সম্পর্ক ছাড়া সুখ কখনো স্থায়ী হতে পারে না। সুখ খুঁজতে অনেকে প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটানোকে প্রাধান্য দেন। পরিবার-পরিবার নিয়ে বেরিয়ে পড়েন দূরে কোথাও। এভাবে বি স্থায়ী সুখের সন্ধান মিলে? প্রতিবছর দেশে দেশে ‘আন্তর্জাতিক সুখ দিবস’ পালন করা হয়। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১২৯তম। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো ১১৮ তম। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে অবস্থান ছিলো ৯৪ নম্বরে। গবেষণা বলছে, বাংলাদেশের মানুষের অসুখ দিন দিন বাড়ছে! লোভ ও মোহ সুখী জীবনযাপনের পথে বাধা হয়ে কাজ করে। ‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র (বিবিএস) জরিপ বলছে, বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ৩৫ জন মানুষ আত্মহত্যা করে। এদের মধ্যে শিক্ষার্থীরাও যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন বিত্তবানরা। মনস্তত্ববিদদের বিভিন্ন তথ্য বলছে, মানুষের মধ্যে একাকিত্ব ও আত্মহননের চিন্তা বাড়ছে। আধুনিক ও নগরজীবন ব্যবস্থা মানুষে মানুষে স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। সুখ ব্যক্তিগত অনুভূতির বিষয় হলেও তা পারিপার্শ্বিকতার ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। যে দেশের সরকার জনগণের অধিকার রক্ষায় সর্বদা সচেতন থাকে, নাগরিকরা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করে, নাগরিকদের মধ্যে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা বিদ্যমান এবং সামাজিক নিরাপত্তাবলয় ও বৈষম্যহীন পরিবেশে বসবাস করে সে দেশের মানুষ সুখী জীবনযাপন করবে-এটাই স্বাভাবিক।

#বিবিধ