বেসরকারি শিক্ষক এক বৈষম্যের নাম | মতামত নিউজ

বেসরকারি শিক্ষক এক বৈষম্যের নাম

দূর্বিষহ জীবনের অবসান ঘটাতে নির্দিষ্ট সময়ের চার বছর আগে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছি। এখন অবসরকালীন আরেক দূর্বিষহ জীবন পেয়েছি। অবসর সুবিধার টাকা আজো হাতে পাওয়ার কোনো খবর জানা নেই। কোনোদিন পাবো, কে জানে? হাজার হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর সে এক অন্য রকম কঠিন যন্ত্রণা! জীবিত থাকতে অবসরের টাকা পাওয়া-না পাওয়ার দুশ্চিন্তা ধুঁকে ধুঁকে মেরে ফেলে। শিক্ষকতার জীবনকে ‘দুর্বিষহ বলার যৌক্তিকতা নিয়ে একটু আলোকপাত করি।

নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে শিক্ষকতা পেশায় আসি। সেদিন কোন অজানা উচ্ছ্বাস এই মহান পেশায় টেনে এনেছিলো, আজ সেটি মনে নেই। বন্ধুদের অনেকে সরকারি চাকরিতে গিয়েছে। কেউ প্রাইমারিতে। কেউ পুলিশে। কেউ উকিল হয়েছে। একসময় আইন কলেজে ভর্তি হয়ে পার্ট-১ শেষ করেছি। পার্ট-২ শেষ করা হয়নি। মন চায়নি। শিক্ষকতায় লেগে থেকেছি। অন্য কোথাও যেতে মন সায় দেয়নি।

তিন যুগ ধরে শিক্ষকতা পেশাকে ঐশী পেশা জ্ঞান করে নিজেকে উৎসর্গ করার প্রয়াস পেয়েছি। এই মহান পেশায় মানুষকে মানুষ হবার পথ দেখাবার সুযোগ ও সম্ভাবনা দু'টোই থাকে। জাতি গঠনে সম্পৃক্ত হবার অবারিত সুযোগ। এই সুবর্ণ সুযোগ হাত ছাড়া করা যায়? এ কারণে অবচেতন মনে শিক্ষকতাকে সাদরে তিনযুগ আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে রেখেছি। অন্যের ছেলেমেয়েকে নিজের সন্তান গণ্য করেছি। নিজের ছেলেমেয়েদের আলাদা করে ভাববার সময় মেলেনি। বুকে হাত রেখে বলতে পারি, শিক্ষকতা পেশায় অন্য এক উচ্ছ্বাস আর আনন্দে দীর্ঘসময় অতিবাহিত করেছি। সেই সুন্দরতম দূর্বিষহ জীবন এখন আর নেই।

দূর্বিষহ জীবনের অবসান ঘটাতে নির্দিষ্ট সময়ের চার বছর আগে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছি। এখন অবসরকালীন আরেক দূর্বিষহ জীবন পেয়েছি। অবসর সুবিধার টাকা আজো হাতে পাওয়ার কোনো খবর জানা নেই। কোনোদিন পাবো, কে জানে? হাজার হাজার শিক্ষক-কর্মচারীর সে এক অন্য রকম কঠিন যন্ত্রণা! জীবিত থাকতে অবসরের টাকা পাওয়া-না পাওয়ার দুশ্চিন্তা ধুঁকে ধুঁকে মেরে ফেলে। শিক্ষকতার জীবনকে ‘দুর্বিষহ বলার যৌক্তিকতা নিয়ে একটু আলোকপাত করি।

আমাদের দেশে শিক্ষকতার মহান পেশাটিকে কাগজে কলমে আর মুখে মুখে যেটুকু সম্মান দেখানো হয়, বাস্তবে এর ছিঁটেফোটো নেই। শিক্ষকতার শুরুতে এটি বুঝতে না পারলেও তিন যুগ সময় ধরে তিলে তিলে সেটি উপলব্ধি করেছি। কেনো জানি আমাদের দেশে শিক্ষকদের বৈষম্যের চার দেয়ালে বেঁধে রাখা হয়েছে। রাষ্ট্র কিংবা সমাজে শিক্ষক আজ সর্বত্র অসহায় ও অপাংক্তেয়। বিশেষ করে শিক্ষকদের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি বৈষম্য রেখা টেনে একটি অংশের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলার প্রয়াস দৃশ্যমান। যতো দিন যাচ্ছে শিক্ষকদের প্রতি সরকারি অবহেলা এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের বৈষম্যমুলক আচরণ ভয়ানকভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে। বেসরকারি শিক্ষক সম্প্রদায় আজ ঘরে বাইরে লাঞ্ছনা ও অপমানের শিকার। প্রিয়জন ও স্বজনের কাছে অবহেলার পাত্র বিশেষ। সাম্প্রতিক এই চিত্রটি ভয়াবহরূপে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। গত চার-পাঁচ মাসে কতোজন শিক্ষক লাঞ্ছনা ও অপমানের শিকার হয়েছেন, তার হিসেব কে রেখেছে?

কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলি। প্রথম যখন শিক্ষকতায় প্রবেশ করি, তখন তিন মাস পর একবার এমপিওতে বেতন আসতো। এর অর্থ দাঁড়ায়, তিন মাস পর একবার বেতন পাওয়া। আমরা সেটিকে বেনিফিট বলতাম। সরকারের তরফ থেকে অনুদান বলতো। বেতন, বেনিফিট কিংবা অনুদান যেটিই বলি না কেনো, সেটি একান্ত নগন্য ছিলো। তিন মাস পরে একসঙ্গে যে বেনিফিট পাওয়া যেতো, সেটি দিয়ে কোনোমতে এক-দেড় মাস চলা যেতো। অবশিষ্ট দেড়-দুমাস টানাপোড়েনে দিনাতিপাত করতে হতো। বেনিফিট হাতে পাওয়াটা খুব সহজ ছিলো না। শিক্ষক-কর্মচারীদের কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিলো না। প্রতিষ্ঠানের একটি অ্যাকাউন্টে বিল করে ব্যাংকে জমা দেয়া হতো। সেই টাকা তুলে এনে প্রতিষ্ঠান প্রধান সকলের মাঝে বণ্টন করে দিতেন। অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান স্টাফের কাছে সঠিকভাবে যথাসময়ে বেতনের টাকা পৌঁছে দিতেন না বলে শোনা যেতো। বেতন বিলে কমিটির সভাপতি বা সহ-সভাপতির স্বাক্ষর লাগতো। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তখনকার দিনে কমিটিতে সহ-সভাপতির একটি পদ ছিলো।

কোথাও কোথাও সভাপতি কিংবা সহ-সভাপতিকে স্বাক্ষর নেয়ার সময় নগদ নজরানা দিতে হতো বলে অনেকের মুখে শুনেছি। অবশ্য আমার শিক্ষকতা জীবনে এরকম দুঃসহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি। তবে অন্যদের কাছে এসব কষ্ট ও গ্লানির কথা শুনে মনে কষ্ট পেয়েছি। শিক্ষক-কর্মচারীদের ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চালুর পর বেনিফিট হাতে পাবার বিষয়ে দুর্গতির অবসান হয়েছে। সে সময় বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা, উৎসব ভাতা, ইনক্রিমেন্ট-এসব কিছুই ছিলো না। খুব সম্ভব কেবলমাত্র বেতন স্কেলের ৫০ শতাংশ বেনিফিট পাওয়া যেতো। এরপর আন্দোলন করে করে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা শতভাগ বেতনে উন্নীত হয়েছেন। নামমাত্র লজ্জাজনক বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা এবং সিকি আনা উৎসব ভাতার অধিকারি হয়েছেন। ইনক্রিমেন্ট পেয়েছেন। কসম করে বলি, আন্দোলন সংগ্রাম ব্যতিরেকে বেসরকারি শিক্ষকরা কোনোদিন একটি টাকাও পেয়েছেন বলে শুনিনি। তখন আন্দোলনগুলো বেশিরভাগ ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম সংগঠিত হতো। শিক্ষকদের এতো ভুঁইফোড় সমিতি ছিলো না। এখন একশর কাছাকাছি সংগঠন। যাই হোক, এখন কেউ আর বেতনকে বেনিফিট বলেন না। তবে সরকারের লোকজন বেতনকে ‘অনুদান’ বলতে এখনো স্বচ্ছন্দ্য বোধ করেন। শিক্ষকদের উপহাস ও অবজ্ঞা করার এটি তাদের হীনমন্যতা বৈ অন্য কিছু নয়।

আজ বেসরকারি শিক্ষকদের বাড়িভাড়ার নামে যে এক হাজার টাকা এবং চিকিৎসা ভাতার নামে যে পাঁচশ টাকা দেয়া হয়, তা শিক্ষকদের সঙ্গে তামাশা ও হঠকারিতা এবং শিক্ষকতার মতো মহান পেশার জন্য অপমানজনক একটি বিষয়। এক হাজার নয়, পাঁচ হাজার টাকায়ও একটি ঝুপড়ি ঘর ভাড়া পাওয়া ভার। আজকাল ঝাড়ফুঁক কিংবা তাবিজ কবচ যারা করে তাদের দিয়েও চিকিৎসা করাতে হাজার টাকা দেয়া লাগে। একটি তাবিজ অথবা এক শিশি তেল কিংবা এক বোতল পানি পড়াতে পাঁচশ টাকা হাদিয়া দেয়া লাগে। হাজার কিংবা পাঁচশ টাকা ছাই। এ দিয়ে কী হয়? উৎসব ভাতাটি আরো লজ্জাজনক এবং বাজারের সঙ্গে একেবারে যুতসই নয়। সিকি ভাগ উৎসব ভাতায় কয় টাকা হয়? এরচেয়ে এ ভাতাটি না দেয়াই ভালো ছিলো। এটি বন্ধ করে দিলেও কেউ তেমন কিছু বলবে না। এটি দেয়া আর না দেয়া একই কথা। এটি পারলে শতভাগ দিন। আসছে ঈদ থেকে শুরু করুন। বাড়িভাড়াটিও সরকারি নিয়মে চালু করুন। না হয় সেটিও বন্ধ করে দিন। সরকারের কিছু টাকা অন্তত সাশ্রয় হোক। শিক্ষকদেরও অপমান কিছুটা লাঘব হবে।

ইদানিং ইএফটিতে বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন দেয়া শুরু হয়েছে। এতে টাকা হাতে পাওয়ার বিড়ম্বনা অনেকটা কমে আসবে। কিন্তু, শুরু থেকে এখন পর্যন্ত অনেক শিক্ষক-কর্মচারী বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন এবং এখনো হচ্ছেন। দাঁড়ি, কমা, ডট-এসব তুচ্ছ কারণে ইএফটি চালু করতে বাধাটি কোথায়, সে আমার বোধগম্য হয়নি। শিক্ষকদের অযথা হয়রানির কুমতলব ছাড়া কিছু নয়। শিক্ষকদের সঙ্গে আমলাতান্ত্রিক মনোভাব প্রদর্শন নিঃসন্দেহে এক বিরাট বৈষম্য।

জাতীয়করণ প্রত্যাশী মহাজোট নামের একটি সংগঠন জাতীয়করণের দাবিতে ‘লং মার্চ টু যমুনা’ কর্মসুচি পালন করেছে। অনেক শিক্ষক-কর্মচারী কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। তারা মনে হয় লাগাতার কর্মসূচির দিকে এগুচ্ছেন। ফলটা কী হবে সে নিয়ে আমার সংশয় আছে। জাতীয়করণের প্রশ্নে শিক্ষকদের মধ্যে বৃহত্তর কোনো ঐক্য হয় না কেনো? শিক্ষকরা রাজনীতি, দলাদলি আর হীন স্বার্থ ভুলে একটি বারের জন্য ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্মে দাঁড়াতে পারেন না কেনো? সব সমিতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে কর্মসূচি পালন না করলে কাজের কাজ কিছু হবে বলে মনে হয় না। সর্ব সাম্প্রতিক শিক্ষকদের বেশ কয়েকটি আন্দোলন কর্মসূচি দেখেছি। পৃথক পৃথক কর্মসূচি পালন করার কারণে শূন্য হাতে তারা বাড়ি ফিরেছেন। শিক্ষকদের জন্য এটি একটি লজ্জাস্কর বিষয়। বিগত অর্ধশত বছরে বিভিন্ন মেয়াদে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক সরকার দেখেছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনও দেখেছি। এখন একটি অন্তর্বর্তী সরকার আমাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সমর্থিত এই বিশেষ ধরনের সরকারে বেশ কয়েকজন খ্যাতিমান শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ সরকারের উপদেষ্টা পদে আসীন আছেন। আমাদের প্রধান উপদেষ্টাও একজন বরেণ্য শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ। শিক্ষা উপদেষ্টা নিজে আরেকজন বর্ষিয়ান শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ। বেসরকারি শিক্ষকদের যাবতীয় বৈষম্য দূরীকরণে তারা কার্যকর কী ভুমিকা নেন, সেদিকে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।