শুধু নিবন্ধন করে ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষার্থীরা যেভাবে ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেলের পরীক্ষায় বসেন ঠিক সেভাবেই কওমি মাদরাসা শিক্ষার্থীদেরকেও বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে নিবন্ধন করিয়ে দাখিল ও আলিম পরীক্ষার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এর প্রধান লক্ষ্য কওমি শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের সুযোগ অবারিত করা। এমন পরিকল্পনা, পর্যবেক্ষণ, যুক্তি ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার খসড়া প্রস্তুত করেছে ডিআইএ নামে পরিচিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এই দপ্তরটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অনেকবছর এই সরকারি প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত ছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডিআইএর পরিচালক ও বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের অধ্যাপক মো. সাইফুল ইসলাম চলতি সপ্তাহে কওমি মাদরাসা শিক্ষার্থীদেরকে বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে নিবন্ধন করিয়ে দাখিল ও আলিম পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়ার প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই বিভাগের সচিবের বিবেচনার জন্য পাঠিয়েছেন। প্রস্তাবের মধ্যে সাধারণ ধারা ও কারিগরি শিক্ষাক্রম যুগোপযোগী করারও পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন কৌশল তুলে ধরা হয়েছে।
আরো পড়ুন : কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে
কওমি শিক্ষার্থীদের বিষয়ে প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো কওমি মাদরাসা যদি সংশ্লিষ্ট শিক্ষাবোর্ড [আলিয়া মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড] থেকে পরীক্ষার্থীদের জন্য পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি নিতে পারে তাহলে সংশ্লিষ্ট মাদরাসার যোগ্য ও ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরাও রেজিস্ট্রেশন ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণরা পরবর্তীতে যে কোনো কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বিবেচিত হবেন।
প্রস্তাবে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা বিশেষ করে কওমি শিক্ষাকে আধুনিক ও সময়োপযোগী কারিকুলামের সঙ্গে সমন্বয় না করা হলে অর্থাৎ মূলধারায় না আনলে একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী অদক্ষ থেকে যাবেন। ধর্মীয় শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে জাতীয় কারিকুলামের সঙ্গে সমন্বয় করে আধুনিক দক্ষতা, মূল্যবোধ, মানসিকতা তৈরি করার উপযোগী বিষয় সংযুক্ত করা হলে বৃহৎ এ জনশক্তি কর্মশক্তিতে যুক্ত হবে। জাতীয় উন্নয়নে তাদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে।
আরো পড়ুন : কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক
চলতি সপ্তাহে পাঠানো প্রস্তাব সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে ডিআইএর পরিচালক অধ্যাপক মো. সাইফুল ইসলাম দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত স্কুলিং না করেও শুধু নিবন্ধন করে ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষায় বসার সুযোগ পেলে আমাদের কওমি সন্তানদের কেনো একই উপায়ে মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের অধীনে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেবো না।
দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে জানা যায়, বর্তমানে কওমির নিয়মিত শিক্ষার্থীরা সাধারণ ধারার আলিয়া মাদরাসার নিয়মিত ছাত্র না হলে শুধু নিবন্ধন করে দাখিল ও আলিম পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন না। কেউ গোপনে নিবন্ধন করে ধরা পড়লে সংশ্লিষ্ট কওমি মাদরাসা থেকে বহিষ্কার করা হয়। এক্ষেত্রে নিবন্ধনকারীর প্রকৃত শিক্ষা পদ্ধতি থেকে স্খলন ঘটেছে বলে ধরে নেওয়া হয়।
বাংলাদেশের কওমি মাদরাসা ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা সম্পর্কিত কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে নেই। তবে, সিদ্দিকুর রহমান খান রচিত কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি ২০০৯ এর ৩ মার্চ ওয়াশিংটনে পাঠানো বার্তায় উল্লেখ করেছেন, কওমি মাদরাসার সংখ্যা ২৩ থেকে ৫৭ হাজার।
ওই গ্রন্থ থেকে আরো জানা যায়, আওয়ামী লীগের একজন দলীয় সংসদ সদস্যের করা প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদকে জানান, দেশে ১৯ হাজার ১৯৯ টি কওমি মাদরাসা রয়েছে। তবে, তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বলেননি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়াধীন ব্যানবেইসের তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে ১৩ হাজার ৯০২টি মাদরাসায় প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থী। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্যানবেইসের জরিপ অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান ৫ হাজার ২৫০টি।
এদিকে, কওমি মাদরাসা শিক্ষকদের সরকারি বেতন স্কেলের আওতায় আনার কাজ চলছে বলে সরকারের একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এজন্য ‘বাংলাদেশের কওমি মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়ন রূপকল্প ২০২৫-৩৫’ নামে একটি কর্মসূচির খসড়ায় হাত দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ। এই কর্মসূচির আওতায় বিদ্যমান ছয়টি বোর্ডকে এক করে একটি সরকারি বোর্ডের মাধ্যমে সনদ দেওয়া ও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে।
কওমি মাদরসাকে মূলধারায় আনতে বেশকিছু উদ্যোগের কথাও বলা হয়েছে রূপকল্পে। এরমধ্যে সব কওমি মাদরাসার হালনাগাদ তথ্যসহ ডাটাবেজ প্রণয়ন; প্রতিষ্ঠানের জমি, অবকাঠামো, শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীর তথ্য বিষয়ে সরেজমিন পরিদর্শনপূর্বক ডাটাবেজ প্রণয়ন; প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক-কর্মচারী এবং ছাত্র-ছাত্রী বিষয়ে পৃথক-পৃথক তথ্যপঞ্জি প্রণয়ন এবং হালনাগাদকরণ; প্রাতিষ্ঠানিক কোড, ইআইআইএন নম্বর ইত্যাদি প্রদান।
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, কওমি মাদরাসার উন্নয়ন রূপকল্প নামে একটি কর্মসূচি নিয়ে আমরা কাজ চলছে। দশ বছর মেয়াদি এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের কাজটি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় অনুমোদন পেলে এ ব্যাপারে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে খসড়া চূড়ান্ত করা হবে বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, কওমি মাদরাসার জন্য চারটি গ্রেড বা শ্রেণি নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
গ্রেড-১: বর্তমানে ৫০০ এর অধিক ছাত্র-ছাত্রী বিদ্যমান এবং গত ২৫ বছর বা তার বেশি পূর্বে স্থাপিত হয়ে ধারাবাহিকভাবে চলমান কওমি মাদরাসা।
গ্রেড-২: বর্তমানে ৩০০ এর অধিক ছাত্র-ছাত্রী বিদ্যমান এবং ১৫ বছর বা তার বেশি পূর্বে স্থাপিত হয়ে ধারাবাহিকভাবে চলমান কওমি মাদরাসা।
গ্রেড-৩: বর্তমানে ১০০ এর অধিক ছাত্র-ছাত্রী বিদ্যমান এবং পাঁচ বছর বা তার বেশি আগে স্থাপিত হয়ে ধারাবাহিকভাবে চলমান কওমি মাদরাসা।
গ্রেড-৪: অন্যান্য সকল মাদরাসা বা নতুন চলমান কওমি মাদরাসা।
কওমি মাদরাসাগুলোর জন্য সরকারিভাবে গ্রেডভিত্তিক মাসিক সম্মানী চালুকরণের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। গ্রেড-১ ভুক্ত কওমি মাদরাসার প্রতিষ্ঠান প্রধানের জন্য প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা এবং অন্যান্য শিক্ষক চারজন ও কর্মচারী একজনের জন্য প্রতি মাসে জনপ্রতি সাত হাজার টাকা সম্মানীর প্রস্তাব করা হয়েছে।
গ্রেড-২ ভুক্ত কওমি মাদরাসার প্রতিষ্ঠান প্রধানের জন্য প্রতি মাসে আট হাজার টাকা এবং অন্যান্য শিক্ষক চারজন ও কর্মচারী একজনের জন্য প্রতি মাসে জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা সম্মানীর প্রস্তাব করা হয়েছে।
গ্রেড-৩ ভুক্ত কওমি মাদরাসার প্রতিষ্ঠান প্রধানের জন্য প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা এবং অন্যান্য শিক্ষক চারজন ও কর্মচারী একজনের জন্য প্রতি মাসে জনপ্রতি তিন হাজার টাকা সম্মানীর প্রস্তাব করা হয়েছে।
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।