চাল আমাদের প্রধান খাদ্য। চালের দাম বাড়লে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে। একটি পরিবারের খাদ্য বাবদ ব্যয়ের সিংহভাগ চাল কেনার ক্ষেত্রে চলে যায়। চালের মূল্য বৃদ্ধির ফলে দরিদ্র মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে।
দুর্মূল্যের বাজারে চাল কিনতে গিয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের মাছ, মাংস, ডিম, দুধ অর্থাৎ আমিষজাতীয় খাবার কেনা অনেকটা কমিয়ে দিতে হয়। বাজারে চালের সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও চালের দাম বাড়ছে। অথচ যেকোনো গাণিতিক সূত্র অনুযায়ী দাম কমার কথা। বাজার ঘুরলে দেখা যাচ্ছে, রমজানে শাক-সবজি, মাছ-মাংসসহ বেশকিছু পণ্যের দাম ক্রেতাদের স্বস্তিতে রাখলেও চালের বাজারের চিত্র অন্যরকম। প্রশ্ন হচ্ছে, কেনো চালের মূল্যের এই ঊর্ধ্বগতি? পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, চালের বাজার অস্থিতিশীল করছে চারটি মিল কোম্পানি। রোজায় অতি মুনাফা করতে গিয়ে মিল পর্যায়ে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) মিনিকেট চালের দাম তারা ৫০০ টাকা বাড়িয়েছে। খুচরা বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। ফলে, এখন কেজিপ্রতি মিনিকেট চাল কিনতে ক্রেতাকে ব্যয় করতে হচ্ছে ৯০ টাকা। এ পরিস্থিতি অবশ্য দু-একদিনে হয়নি।
বস্তুত গত চার মাস ধরেই অস্থির ছিলো চালের বাজার। গত বছর ডিসেম্বরে মিলপর্যায়ে প্রতি বস্তা মিনিকেট চাল ৩৩০০ টাকায় বিক্রি হলেও জানুয়ারিতে বস্তায় বেড়েছে ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা। তবে ১৫ দিন আগে চালের দাম কিছুটা কম ছিলো। চালের বর্তমান মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে পাইকারি ব্যবসায়ীরা মূলত চারটি মিল কোম্পানিকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, আগামী বৈশাখে নতুন মিনিকেট চাল বাজারে ছাড়া হবে, এখন মিলগুলোয় মিনিকেট নেই। হাতেগোনা চারটি কোম্পানির কাছে রয়েছে চাল। তারাই এখন দাম বাড়িয়ে পাইকারি আড়তদারদের কাছে চাল ছাড়ছেন। এই মিলমালিক যে দাম ধার্য করছেন, তার বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকছে না। ব্যবসায়ীদের মতে, এই চারটি কোম্পানি চালের বাজারকে জিম্মি করে ফেলেছে।
চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয়। উৎপাদন ভালো হলেও বাংলাদেশের বাজারে অদৃশ্য সিন্ডিকেটের কারসাজিতে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে উৎপাদন ও সরবরাহ বেশি থাকলে পণ্যের দাম কমে—অর্থনীতির এ নিয়ম চালের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না। এমনকি মন্ত্রী পর্যায় থেকে প্রশাসনের দৌড়ঝাঁপেও চালের দাম কমে না। ফলে সিন্ডিকেট অযৌক্তিক মুনাফা করে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়। আবার চালের দাম বাড়ার ফলে অন্যান্য পণ্যের দামও বেড়ে যায়। তাই চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নেয়া উচিত। এ ছাড়া আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম বৃদ্ধির ঘটনা এবারই প্রথম ঘটেছে এমনটি নয়, গত বছরও এ সময়ে চালের দাম বেড়েছে। তখনো মিল মালিক ও ব্যবসায়ীদের দোষারোপ করা হয়েছে। এমনকি ২০২২ খ্রিষ্টাব্দেও চালের বাজার অস্থিতিশীল ছিলো। অথচ সে বছরও আমন ধানের ভালো ফলন হয়। আবার আমনের পর বোরো মৌসুমে ধান উৎপাদনের রেকর্ড হলেও বাজারে চালের দাম বেড়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে চালের বাজারে সিন্ডিকেশন নতুন কিছু নয়। প্রতি বছরই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার অস্থিতিশীল করে তোলা হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, যথাযথ সরকারি তদারকির অভাবে আড়তদাররা সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। এ ছাড়া বাজারে চালের দাম বৃদ্ধিতে বর্তমানে মিলার, আড়তদার, পাইকারদের পাশাপাশি মৌসুমি ব্যবসায়ী ও অনলাইন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত চাল মজুদের ভূমিকা রয়েছে। এক্ষেত্রে খুচরা বাজারের ব্যবসায়ীরা বেশি দামে পাইকারদের কাছ থেকে কেনার বিষয়টি তুলে ধরেন।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের সংকটের কারণে আমদানিতে সংকোচনমূলক নীতির ফলে চালের বাজারে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে বলে সরকারের নীতিনির্ধারকরা বলছেন। এ ছাড়া চালের দামের ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে চালের দাম বৃদ্ধির প্রভাবটিকেও কারণ হিসেবে দেখানো হচ্ছে। কারণ, বিশ্ববাজারে চালের দাম এখন এক যুগের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। এ দাম বৃদ্ধি নিয়ে বিশ্লেষকরা আগেই আভাস দিয়েছিলেন। তবে দেশের চালের বাজার দীর্ঘদিন উচ্চ মূল্যে স্থিতিশীল থাকার পর অস্থিতিশীল হওয়ার পেছনে মিল মালিকদের কারসাজিকেই দায়ী করা হচ্ছে। অতীতের ধারাবাহিকতায় দেখা যাচ্ছে, চালের বাজারে এ ধরনের সংকট নতুন নয়। দেশের খাদ্যনিরাপত্তার স্বার্থে এ রকম মাৎস্যন্যায় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এজন্য ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (টিসিবি) সক্রিয় করে খোলাবাজারে সীমিত আয়ের মানুষের কাছে নিয়মিত চাল বিক্রির উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য কমাতে সর্বোচ্চ পদক্ষেপের বিকল্প নেই। কারণ, দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থে চালের বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা দরকার। এক্ষেত্রে সরকারের বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা নিয়ে যে অভিযোগ রয়েছে, তা দূর করতে হবে। যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ যেনো না হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে সীমিত পরিমাণে হলেও চাল আমদানির সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত। এ ছাড়া আমন ধান উৎপাদনের প্রকৃত তথ্য যাচাই করার ক্ষেত্রে সমন্বয় সাধন করা জরুরি। তাহলে চাল উৎপাদন ও আমদানি নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া।
পত্রিকান্তরে জানা যায়, গত ছয় মাসে চালের দাম বেড়েছে তিন দফায়। রোজার মধ্যেও কিছু কিছু চালের দাম বেড়েছে দুই-তিন টাকা। এদিকে বাংলাদেশ রাইস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি কাউসার আজমের কাছ থেকে আশ্বাস মিলছে যে বোরো ধান এলেই দাম কমবে। এ তো ওই গল্পটির মতো-সামনের মাসে বেতন বাড়বে, কিন্তু সেই সামনের মাস আর আসে না! দাম কমার প্রতিশ্রুতি যেনো এমন এক মরীচিকা, যা ধরা দিতে দিতেই মিলিয়ে যায়। সরকার ওএমএস কার্যক্রমের মাধ্যমে খোলাবাজারে চাল বিক্রির চেষ্টা করছে, কিন্তু সেটা সীমিত পরিমাণে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজার তদারকি বাড়াতে হবে, ব্যবসায়ীদের মজুতের ওপর নজরদারি করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে ব্যবসায়ীরা তদারকির আগেই দাম বাড়িয়ে ফেলেন, ফলে সরকার যখন ব্যবস্থা নিতে যায়, ততক্ষণে জনগণের কপালে পড়ে নতুন চিন্তার ভাঁজ। বিশেষজ্ঞরা যে পরামর্শ দিয়েছেন, তা অনুসরণ করা গেলে চালের বাজারে ‘ম্যাজিক শো’ বন্ধ করা যেতে পারে। সেই শো এমন যেখানে ব্যবসায়ী, আমদানিকারক, সরকার-সবাই নিজেদের মতো করে শোডাউন করে চলছে আর সাধারণ মানুষ এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে খালি হাতে, হাততালি দেয়া ছাড়া তাদের যেন আর কোনো উপায় নেই! এ ক্ষেত্রে অন্তত সরকার একাই পারে মুশকিল আসান করে দিতে। সরকারের তরফ থেকে ওএমএসসহ অন্যান্য খাদ্য সহায়তার পরিমাণ বাড়ালে পণ্যবাজারে প্রভাবটা ইতিবাচক পড়বে। আরো বেশি মানুষ যদি সরকারের কাছ থেকে কম দামে চাল ও অন্যান্য পণ্য পেতে পারে, তাহলে মানুষ যেমন স্বস্তি পাবে, বাজারব্যবস্থাও কিছুটা শান্ত হয়ে আসতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালের বাজার স্থিতিশীল করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ দরকার। সরকার ধান সংগ্রহের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করে কৃষকের সঙ্গে সরাসরি চুক্তি করতে পারে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমানোর মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সরকারি খাদ্যগুদামের মজুত আরো উন্নত করা এবং দুর্নীতি ঠেকানো প্রয়োজন। মজুতদারির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদেশি চালের ওপর বেশি নির্ভরশীলতা বন্ধ করা এবং স্থানীয় উৎপাদন বাড়াতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা উচিত। এতে দেশের ভেতরেই সরবরাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারের অস্থিরতা কমানো সম্ভব। চালের বাজারে অনিয়ম ও মজুতদারির বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষকে আর কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষ এখন চাল কিনতে হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থা সরকারের জনপ্রিয়তার ক্ষতিও করছে। সুতরাং সরকারকে চালের বাজার যে কোনো উপায়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। যেসব মিলমালিক সিন্ডিকেট করে অধিক মুনাফা লাভের আশায় অযৌক্তিকভাবে চালের দাম বাড়িয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে নিতে হবে ব্যবস্থা। অবিলম্বে সরকারি-বেসরকারি তৎপরতায় চালের বাজারে স্বস্তি ফিরে আসবে, সেটাই কাম্য।।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক