তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে প্রায়ই ঢাকা কলেজ, আইডিয়াল কলেজ ও ঢাকা সিটি কলেজের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়াসহ নানা ধরনের সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আট মাসে এ তিন কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ১৩টি সংঘর্ষ ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় পুলিশ-শিক্ষার্থী-পথচারীসহ আহত হয়েছে অন্তত দুই শতাধিক ব্যক্তি। প্রতিটি সংঘর্ষে ৩-৫ ঘণ্টা হিসেবে সংঘর্ষগুলোয় অন্তত ৫০ ঘণ্টা বন্ধ ছিল মিরপুর রোডে যান চলাচল। এতে ভোগান্তিতে পড়ে পথযাত্রী ও রোগীরা; লোকসান গুনতে হয়েছে নিউমার্কেট ও আশপাশের ব্যবসায়ীদের।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ সেপ্টেম্বর ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজ ও ঢাকা কলেজের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ১৮ শিক্ষার্থী আহত হয়। প্রেমের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সূত্রপাত এ সংঘর্ষের শুরুতে আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকা কলেজের ভেতরে ঢুকে হামলা চালায়। পরবর্তী সময়ে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা আইডিয়াল কলেজে হামলা চালিয়ে প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড খুলে নিয়ে যায়। সেদিন দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের পর ১৫ সেপ্টেম্বর ফের আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকা কলেজের বাসে হামলা চালায়। বাসে ওঠাকে কেন্দ্র করে ১৯ নভেম্বর ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবার হাতাহাতি হয়। পরদিন ২০ নভেম্বর ঢাকা কলেজের বাস ভাঙচুরের খবর ছড়িয়ে পড়লে দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে অন্তত ৩৭ শিক্ষার্থী আহত হয়। পরে ঢাকা কলেজ একদিন ও সিটি কলেজ তিনদিন বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
চলতি বছরের প্রথম মাসেই দুবার সংঘর্ষে জড়ায় ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা।১৯ জানুয়ারি বাসে ওঠাকে কেন্দ্র করে ধাক্কাধাক্কি থেকে ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। এতে পাঁচ শিক্ষার্থী আহত হয় বলে জানা যায়। পরে ২৫ জানুয়ারি ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থীকে একা পেয়ে সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা মারধর করে কলেজে আটকে রেখেছে—এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজনা তৈরি হয়। এরপর ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দ্বিতীয় দফায় সংঘর্ষ বাধে। এ দফায় ১২ শিক্ষার্থী আহত হয় বলে জানা যায়।
ফেব্রুয়ারিতে চারবার সংঘর্ষে জড়ায় ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ ও ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা। ৫ ফেব্রুয়ারি স্লেজিংয়ের মতো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কথাকাটাকাটিতে জড়ায় ঢাকা সিটি কলেজ ও ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে তা পৌঁছায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ এবং ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ায়। পরে পুলিশ ও কলেজ প্রশাসনের হস্তক্ষেপে সেদিনের মতো ঘটনার ইতি ঘটে। এর জের ধরে ৯ ফেব্রুয়ারি ফের পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শতাধিক শিক্ষার্থী লাঠিসোঁটা নিয়ে ঢাকা সিটি কলেজের নামফলক থেকে ‘সিটি’ খুলে নিয়ে যান। পরে সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরাও পাল্টা ধাওয়া দিলে বাধে সংঘর্ষ। সেদিনের ঘটনায় দুই শিক্ষার্থী আহত হয় বলে জানা যায়। এরপর ফেব্রুয়ারি ২০ ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ঢাকা কলেজের একদল শিক্ষার্থীর সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর পূর্বপরিকল্পিত হামলার পর দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। এতে সতি শিক্ষার্থী আহত হয় বলে জানা যায়। এ সংঘর্ষের কারণ অনুসন্ধানের আগেই ২২ ফেব্রুয়ারি ফের সংঘর্ষে জড়ায় উভয় কলেজের শিক্ষার্থীরা। এতে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয় বলে জানা যায়।
চলতি মাসে এখন পর্যন্ত ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তিনটি সংঘর্ষ ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। ২১ এপ্রিল ধানমন্ডিতে ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থীকে মারধরের প্রতিক্রিয়ায় গতকালের সংঘর্ষ ঘটেছে বলে জানা যায়।
এর আগে ১৫ এপ্রিল সংঘর্ষে জড়ায় ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা। জানা যায়, সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকা কলেজের দুই শিক্ষার্থীকে মারধর করলে ঢাকা কলেজের একদল শিক্ষার্থী সায়েন্স ল্যাব এলাকায় যায়। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে একজন আহত হয়।
সর্বশেষ মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা কলেজ-সিটি কলেজের সংঘর্ষে শিক্ষার্থী-পুলিশসহ ৭০ জন আহত হয়েছে বলে জানা যায়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হলে ওই এলাকার সড়কে যান চলাচল প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা বন্ধ ছিল। পরে ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজ কর্তৃপক্ষ দুদিন করে বন্ধ ঘোষণা করে।
সিসিটিভি ফুটেজ দেখে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানায়, সায়েন্স ল্যাব ওভারব্রিজের কাছাকাছি কিছু সাধারণ পোশাক পরা ছেলে একজনকে ফেলে দেয়। এতে সে গুরুতর আহত হয়। তাকে বেল্ট দিয়ে মারধরও করা হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ঢাকা কলেজের দুই শতাধিক শিক্ষার্থী সিটি কলেজে ঢোকার চেষ্টা করে। অনেকে ভেতরে ঢুকেও পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের দুটি শেল ছুড়লে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরে উভয় কলেজের শিক্ষকদের হস্তক্ষেপে শিক্ষার্থীরা শান্ত হয়।
রমনা জোনের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা সবাই মনে করছি, এসব সংঘর্ষ নিছক কোনো একদিনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, নিয়মিত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর স্থায়ী সমাধান দরকার। আমরা চাই না এমন ঘটনায় কেউ প্রাণ হারাক বা মারাত্মক ক্ষতির শিকার হোক। আমরা চেষ্টা করছি কলেজগুলোকে একত্র করে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে।’
তুচ্ছ ঘটনা কিংবা বড় কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ এমন সংঘর্ষে ভোগান্তিতে পড়ে ওই এলাকার বাসিন্দা ও নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীরা। প্রতিটি সংঘর্ষে অন্তত ৩-৫ ঘণ্টা বন্ধ হয়ে যায় পার্শ্ববর্তী মিরপুর রোডে যান চলাচল।
মাহাদী হাসান নামে সায়েন্স ল্যাবের এক রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী বলেন, হঠাৎ করেই সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্ররা। দোকান বন্ধ করার সময়ও পাই না। একবার সংঘর্ষ শুরু হলে ওইদিনের বেচাকেনা শেষ। খাবার পচে যায়। ব্যবসায় লোকসান হয়। এছাড়া সংঘর্ষের ভয়ে কর্মীদের নিয়ে নিরাপত্তা শঙ্কায় দিন কাটাতে হয়।
রাস্তা বন্ধ হওয়ায় ভোগান্তিতে পড়ে পথচারী ও অফিসগামী যাত্রীরা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, পাশের গ্রিন রোড ও ধানমন্ডির বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও স্বজনদের দুর্ভোগে পড়তে হয়। গতকাল দুপুরে হঠাৎ স্ত্রীর অসুস্থতার খবর পান আমিনুল ইসলাম নামে এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। পরে তাকে ছুটে যেতে হয় রাজধানীর ল্যাব এইড হাসপাতালে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে রাস্তা বন্ধ হওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েন তিনি।
আমিনুল ইসলাম বলেন, অন্য একটি রাস্তা দিয়ে ঘুরে যেতে দেরি হয়ে যায়। অন্যদিকে বাচ্চা দুটোর স্কুল ছুটি হয়েছে। ওদের বাসায় নিতে হবে। সব মিলিয়ে বেকায়দায় পড়েছিলাম। আল্লাহ সহায় ততক্ষণে আমার স্ত্রীর সহকর্মীরা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করান। না হলে বিপদে পড়তে হতো।
সামগ্রিক শৃঙ্খলা রক্ষায় স্থায়ী সমাধানের পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা। কলেজগুলোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এসব সংঘর্ষের পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব বলে তারা জানান।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বলেন, কলেজ কর্তৃপক্ষকে কঠোর হতে হবে। সংঘর্ষে জড়িত শিক্ষার্থীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দু-একজনের শাস্তি হলে আর কেউ সাহস পাবে না। এর আগে কলেজ তিনটির অধ্যক্ষ ও সিনিয়র শিক্ষকদের এক টেবিলে বসতে হবে। এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনার জন্য শিক্ষকদের ইন্ধন রয়েছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে।
বারবার জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী এ সমস্যা সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে গতকাল রাতে ঢাকা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক পারভীন সুলতানা হায়দার বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর মাত্র দুটি সংঘর্ষ হয়েছে। এ বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারব না।
অন্য দুই কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার স্থায়ী সমাধানের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান তিনি।