কোটামুক্ত প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ ইতিবাচক | শিক্ষাবিদের কলাম নিউজ

কোটামুক্ত প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ ইতিবাচক

অর্থাৎ নারীদের চাকরির ব্যবস্থা করলাম কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার্থীরা কী শিখবেন, তাদের কী ধরনের শিক্ষক দরকার সেগুলো চিন্তায় আনলাম না।

প্রস্তাবিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা ২০২৫-এর খসড়ায় বলা হয়েছে, সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগে নারী, পোষ্য ও পুরুষ কোটা থাকছে না। আদালতের রায় অনুযায়ী, কোটা থাকবে মাত্র ৭ শতাংশ।

বাকি ৯৩ শতাংশ নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে। প্রাথমিক বিশেষ করে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন বহুদিনের। কোনোভাবেই যেনো এখানে মানের উন্নয়ন ঘটানো যাচ্ছে না। প্রাথমিক শিক্ষাকে উন্নততর ও যুগোপাযোগী করার জন্য অন্যান্য শর্তের সঙ্গে প্রধানত যে কাজটি করতে হয় সেটি হচ্ছে উপযুক্ত ও ডেডিকেটেড শিক্ষক নিয়োগ।

কিন্তু আমরা নারীদের চাকরি দেয়ার জন্য ৬০ শতাংশ নারী কোটা রাখলাম? তারা পড়াতে পারবেন কি না, তাদের সে যোগ্যতা আছে কি না, তারা পেশায় নিবেদিত কি না এসব যাচাই-বাছাই করার আর সুযোগ থাকলো না। নারী কোটা পূরণ করার জন্য যাকে তাকে প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলাম।

অর্থাৎ নারীদের চাকরির ব্যবস্থা করলাম কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার্থীরা কী শিখবেন, তাদের কী ধরনের শিক্ষক দরকার সেগুলো চিন্তায় আনলাম না। এভাবে আমাদের দেশে অনেক কিছুই করা হয় যার পেছনে শক্ত কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।

এ যেনো বেকার সমস্যা দূর করার একটি উপায় এবং সেটি ভবিষ্যৎ বংশধরদের ক্ষতির মুখে ফেলে। শিক্ষা বিভাগ এর সমাধানও দিতে পারছে না। এসব ক্ষেত্রে সব সময়ই দেখা যায় আদালত থেকে রায় নিয়ে আসতে হয়। প্রাথমিক শিক্ষার যখন বারোটা বেজে গেছে এখন আমরা আদালতের রায় নিয়ে সিদ্ধান্ত পাল্টানোর ব্যবস্থা করলাম।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেছেন, প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগ বিধিমালা সংশোধন হচ্ছে। সংশোধীত বিধিমালা অনুযায়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগে মহিলা কোটা বাদ যাবে, পোষ্য ও পুরুষ কোনো কোটাই থাকবে না।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, নিয়োগ বিধিমালা চূড়ান্ত হলে আগামী আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হতে পারে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে সহকারী শিক্ষকের নিয়োগযোগ্য শূন্যপদে ৮ হাজারের বেশি। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সময় পদসংখ্যা বাড়তে পারে।

প্রস্তাবিত বিধিমালায় উচ্চ আদালতের রায়ের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ৭ শতাংশ কোটাব্যবস্থা অনুসরণের প্রস্তাব করা হয়েছে। সর্বশেষ প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ বিধি ২০১৯-এ বলা হয়েছে, সরাসরি নিয়োগযোগ্য পদের ৬০ শতাংশ মহিলা প্রার্থী, ২০ শতাংশ পোষ্য প্রার্থী এবং অবশিষ্ট ২০ শতাংশ পুরুষ প্রার্থীদের দিয়ে পূরণ করা হবে।

অবশই ২০ শতাংশ স্নাতক বা সমমানের ডিগ্রিধারী প্রার্থীদের নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ব্যানবেইসের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৬৫ হাজার ৫৬৫টি। এসব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী রয়েছে ১ কোটি ৭১ লাখ ৬২ হাজার ৩৬৫ জন। শিক্ষক আছেন ৩ লাখ ৬২ হাজার ৭০৯ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ শিক্ষক ১ লাখ ২৭ হাজার ৩৯ জন এবং নারী শিক্ষক ২ লাখ ৩৫ হাজার ৬৭০ জন।

দিনে দিনে আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সরকারি বিনিয়োগ বহুগুণে বেড়েছে। সুন্দর সুন্দর ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, নতুন বেঞ্চ, ডিজিটাল যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছে, শিক্ষকদের নিয়মিত বিষয়ভিত্তিকে প্রশিক্ষণে পাঠানো হচ্ছে। ছেলেমেয়েদের আলাদা বাথরুমের ব্যবস্থা হয়েছে। আগের মতো সেই ভাঙা দালান বা ঘর নেই, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের কোনো নিয়ম-কানুন ছিলো না।

এখন অধিকাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এই সুবিধাগুলো পাচ্ছে। কিন্তু বর্তমানের এসব ইনফ্রাস্টাকচারাল সুবিধা এবং প্রশাসনিক সহায়তা ভালো ফল নিয়ে আসছে না। অধিকাংশ শিক্ষার্থীই শ্রেণি সমাপনের পর যেসব দক্ষতা অর্জন করার কথা তার ধারে কাছেও যেতে পারছেন না। আর তাই অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি না করিয়ে কিন্ডারগার্টেনে পাঠাচ্ছেন।

সরকারি প্রাথমিকে পড়ে শিক্ষার্থীরা গাণিতিক সংখ্যা চিনছেন না, সাধারণ যোগ-বিয়োগ করতে পারছেন না। আর ইংরেজির দক্ষতায় যে পরিমাণ পিছিয়ে আছে তা উল্লেখ করার মতো নয়। তবে, এগুলো দেখার বা নিয়মিত পরিমাপ করার ভালো ব্যবস্থা নেই। যদিও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ‘অ্যানুয়াল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট’ করার একটি উদ্যোগ নিয়ে, সেটি দুবছর পর পর হচ্ছে। এটি প্রতিবছর হওয়া উচিত এবং বেসরকারি কোনো সংস্থাকেও করতে দেয়া উচিত। তাহলে অনেকটাই সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে। শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়গুলোও অনেকটা সচেতন হবেন।

বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখার বিবেচনা রাখে। দেশব্যাপী একটি সমীক্ষা চালানো দরকার কেনো অধিকাংশ অভিভাবক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে তাদের সন্তানদের জন্য পছন্দ করেন না। তারা যেসব কারণে সন্তানদের সরকারি প্রাথমিকে পাঠাতে চাচ্ছেন না সেগুলোকে চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন।

এটি সত্য, সবাই সরকারি প্রাথমিকে পড়বে না, সব অভিভাবক তাদের সন্তানদের সরকারি প্রাথমিকে পাঠাবেন না। আবার শহর এলাকায় সরকারি প্রাথমিকের চাহিদা কম থাকবে। কারণ, এখানে সচ্চল অভিভাবক রয়েছেন। বেসরকারি পর্যায়ে ভালো ভালো প্রতিষ্ঠান আছে। এভাবে একটি ম্যাপিং করা প্রয়োজন।

বর্তমান প্রশিক্ষণ মডিউল এবং ফ্রেমওয়ার্ক পরীক্ষা করে নতুনভাবে পুনর্গঠিত করা প্রয়োজন। কারণ, প্রশিক্ষণ হচ্ছে প্রচুর কিন্তু তার কোনো ইমপ্যাক্ট শ্রেণিকক্ষের শিক্ষাদানে প্রদর্শিত হচ্ছে না। এর একটি কারণ হচ্ছে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ফলোআপ না করা কিংবা ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমন্টে না দেখা।

প্রশিক্ষণ অনেকটাই বাস্তবতা বিবর্জিত, একপেশে। যারা সুপারভাইজ করতে আসেন তারা প্রশিক্ষণের মডিউল সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা রাখেন না। ফলে শিক্ষকদের গাইড করতে বা প্রশিক্ষণ ফলপ্রসূ করতে কোনো ধরনের ভূমিকা তারা রাখতে পারছেন না। তাই, পিটিআই ও উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের ইনস্ট্রাক্টর এবং কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ ফলোআপ করার জন্য ক্ষমতা প্রদান করা প্রয়োজন। কারণ. তারা প্রশিক্ষণের বিষয়গুলো সম্পর্কে জানেন।

প্রশিক্ষণে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ ছাড়াও নীতি, একনিষ্ঠতা, পেশাগত মূল্যবোধ, সোশাল ও ইমোশনাল লার্নি এবং চাইল্ড সাইকোলজি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। বর্তমানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। এটিও কীভাবে প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অন্তর্ভুক্ত করা যায় সেটি ভেবে দেখা প্রয়োজন।

প্রতিটি শ্রেণির প্রতিটি বিষয়ে কী কী কম্পিটেন্সি অর্জন করতে হবে সেগুলোর বিশদ বিবরণ থাকতে হবে এবং বিষয়টি সবাইকে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, পরীক্ষক সবাইকে জানতে হবে। বছরে প্রতিটি বিষয়ে কী কী একজন শিক্ষার্থীকে অর্জন করতে হবে তা সবার কাছে স্পষ্ট থাকতে হবে।

প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে চিন্তাভাবনা করেন এমন অনেক ব্যক্তি এবং শিক্ষকরাও চাচ্ছেন, প্রাথমিক শিক্ষকদের শুধুমাত্র ক্লাসরুম টিচিং ছাড়া এর বাইরে কোনো কাজ করানো ঠিক নয়। এটি একদিকে যদিও পজিটিভ মনে হয় বিষয়টি আসলে তা নয়। কারণ, শিক্ষা ও শিক্ষাদান শুধু শ্রেণিকক্ষের বিষয় নয়। পুস্তকের জ্ঞান বাইরের জগতের বাস্তবতার সঙ্গে মিলাতে হয়। সেটি আমাদের কোনো ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই পালিত হয় না, ফলে শিক্ষা থেকে যায় বাস্তবতা বর্জিত।

যেমন, শহরের রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় কোন পাশ দিয়ে হাঁটতে হবে, কখন ও কীভাবে রাস্তা পার হতে হবে সেগুলো আমাদের পুস্তকে সেভাবে নেই, বাস্তবেও তো নেই। তাই, একজন শিক্ষার্থী ভালো ফল করেও বাস্তব এসব জ্ঞান থেকে দূরে অবস্থান করে, ফলে পুস্তকের জ্ঞান অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবে কাজে লাগে না। সাঁতার কাটতে জানা একটি বাস্তব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। একজন শিক্ষার্থী এ-প্লাস পেলেন একটি বিষয়ে, পুরো পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেলেন কিন্তু সাঁতার কাটতে জানেন না, সেটি তার সম্পূর্ন জ্ঞান নয়।

এখন সাঁতার কাটতে গিয়ে যদি বলি, এগুলো বইপুস্তকের কাজ নয়। এসব কাজে শিক্ষার্থী বা শিক্ষকদের জড়ানো ঠিক নয় সেটি কিন্তু প্রকৃত শিক্ষা নয়। আমাদের উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আধুনিককালে ব্যবসা প্রশাসনসহ অনেক বাস্তব বিষয় পড়ানো হয় কিন্তু বইয়ের মাধ্যমেই পড়ানো হয়। কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান বা কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে তাদের ইনটার্নশিপের ব্যবস্থা করা হয় না।

ফলে চাকরির বাজারে তাদের ঢুকতে যেমন অনেক বেগ পেতে তেমনি চাকরি পেলেও ভালো পারফরম্যান্স দেখাতে অনেক সময় নিতে হয়। তবে, ইদানিং কিছু ভালো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় শ্রেণিকক্ষের জ্ঞানের সঙ্গে বাস্তব জ্ঞানের অর্থাৎ বড় বড় কোম্পানিতে শিক্ষার্থীদের প্রাকটিক্যাল কাজ করার ব্যবস্থা করছে। সরকারি তেমন পদক্ষেপ এখনও শুরু হয়নি। একইভাবে, সরকারি প্রাথমিকও বেসরকারিগুলোর চেয়ে এসব ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে।

লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক