হাদিসের আলোকে শিশুর ওপর পরিবেশের প্রভাব | মতামত নিউজ

হাদিসের আলোকে শিশুর ওপর পরিবেশের প্রভাব

ফিতরত বা স্বভাব-ধর্ম আসলে কী? মুফাসসিরগণ বিভিন্ন শব্দে এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। গভীর দৃষ্টিতে দেখলে সবার বক্তব্যের সারনির্যাস মোটামুটি এক। ফিতরত মানে হলো ইসলামের মূল আকীদা তথা তাওহিদ।

কিছু কিছু হাদিস আছে গভীর মর্মবাহী। অবয়বে হয়তো ছোট, কিন্তু ধারণ করে আস্ত একটি জীবনদর্শন। একটি অব্যর্থ সূত্র, যা ব্যাখ্যা করে আমাদের বহু কিছু। তেমনই একটি হাদিস পড়ুন:

নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রতিটি শিশু জন্ম নেয় তার ফিতরত বা স্বভাব-ধর্মের উপর। অতপর তার মা-বাবা তাকে ইহুদি বানায়, খ্রিস্টান বানায়, অগ্নিপূজারী বানায়। (সহিহ বুখারি শরিফ, হাদিস নং ১৩৮৫)

এই ফিতরত বা স্বভাব-ধর্ম আসলে কী? মুফাসসিরগণ বিভিন্ন শব্দে এর বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। গভীর দৃষ্টিতে দেখলে সবার বক্তব্যের সারনির্যাস মোটামুটি এক। ফিতরত মানে হলো ইসলামের মূল আকীদা তথা তাওহিদ।

জন্মের পর একটা শিশুকে যদি তার আপন পথে ছেড়ে দেওয়া হয়, তাহলে আল্লাহ প্রদত্ত সেই স্বভাবশক্তির বলেই নিজের সৃষ্টিকর্তা ও মাবুদ হিসেবে সে এক আল্লাহকে খুঁজে পাবে। আল্লাহ তায়ালা মানুষের চারপাশে যে বিস্ময়কর সৃষ্টিরাজি সাজিয়ে রেখেছেন, নিজের অস্তিত্ব গুনাবলির নিদর্শন হিসেবে, এসব কিছু তার তাওহিদের সেই শক্তিকে উদ্দীপ্ত করবে, তাকে নিয়ে যাবে আল্লাহর কাছে। নামাজ রোজা বা অন্যান্য বিধান না চিনলেও ইসলামের মূল যে প্রাণ তথা তাওহিদ, বিশ্বাস হিসেবে সে একেই গ্রহণ করবে। সে হয়ে উঠবে একত্ববাদী।

কারো মনে হতে পারে মা-বাবার প্রভাবে যদি মানুষ ইহুদি খ্রিস্টান হয়, তাহলে মুসলমানও তো একই কারণে হচ্ছে? তবে কি মানুষের এই মুসলিম হওয়াটা মৌলিক কিছু নয়? নিছক প্রতিক্রিয়া, অভ্যাস ও আপতিত কিছু? এ প্রশ্নটির সমাধানের জন্যই আমাদেরকে ফিতরতের বিষয়টি বুঝতে হবে।

পরিবেশের প্রতিক্রিয়া এবং ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা অভ্যস্থতার কারণে মুসলিম হলেও ইসলাম একজন মুসলমানের আত্মা ও স্বভাবের অংশ। মা-বাবা একে বাহির থেকে চাপিয়ে দেয় না, বরং ভেতর থেকে এটি স্ফুরিত হয়।

সে হিসেবে তাওহিদ হলো মানুষের স্বভাবের মৌলিক প্রবণতা। পৃথিবীর নতুন পুরনো সবগুলো সভ্যতায় ‘উপাস্যের ধারণা’ আছে। মানুষ সবসময় একজন সৃষ্টিকর্তা ও উপাস্যকে অনুভব করেছে। শিরক ঢুকেছে পরিবেশ ও পূর্ব সংস্কারের প্রভাবে। এবং যারা শিরকে লিপ্ত, তারাও মূল হিসেবে একজন স্রষ্টাকেই স্বীকৃতি দেয়। স্রষ্টার কাছে সমর্পণটা মানুষের স্বভাব। পরিবেশ একে বিকৃত না করলে তা অক্ষুণ্ন থাকে। এরপর ছোটবেলা থেকে যদি সে মা-বাবার শিক্ষাটা পায়, তাওহিদের পরিবেশে লালিত পালিত হয়, বিধানাবলিসহ ইসলামের শিক্ষাগুলো পেতে থাকে, তাহলে তার সে স্বভাবজাত শক্তিটিই বিকশিত হয়ে পরিপূর্ণতা পায়।

হাদিসখানা থেকে আমরা আরো একটি বিষয় বুঝতে পারি,। পরিবেশ মানুষকে প্রভাবিত করে। বিশেষত শিশুদের ক্ষেত্রে এটি সবচেয়ে বেশি পরিমাণে এবং সবচেয়ে গভীরভাবে সত্য। এমনিভাবে প্রতিক্রিয়া গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চয়ই শুধু ধর্ম বিষয়ে সীমিত নয়। আচার, আচরণ, চরিত্র, চিন্তা, পেশা, দক্ষতা, জ্ঞান, ভাষা, শারীরিক উপস্থাপন, অঙ্গ সঞ্চালন, আত্মিক গুনাবলি, প্রাত্যহিক জীবনযাপনগত অভ্যাস ইত্যাদি সকল কিছুতে বিস্তৃত। শিশুর জীবনে কেবল মা-বাবাই প্রভাব বিস্তারী নন। মৌলিক প্রভাব বিস্তারী হিসেবে হাদিসে তাদেরকে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্যথায় ফ্যামিলির অন্যান্য সদস্য, বন্ধুবান্ধব, স্কুল বা মাদরসার শিক্ষক, আত্মীয় স্বজন, এলাকার পরিস্থিতি, সমাজের অবকাঠামো সব কিছুই মন-মানস, চিন্তা ও চেতনায়, আচার ও দক্ষতায় ইতিবাচক বা নেতিবাচকভাবে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। করেও।

হাদিস থেকে বুঝা যাচ্ছে, মানুষের স্বভাবগত যে শক্তি, একে সমূলে উৎপাটিত করা না গেলেও দমিয়ে ফেলা যায়। এমনিভাবে তার চরিত্রে প্রবেশ করানো যায় স্বভাবশক্তির বাইরের বিষয়ও। সুতরাং, কোন শিশুর মাঝে যদি রাগের প্রবণতা থাকে, অশ্লীলতার ঝোঁক দেখা যায়, হিংসুটে মনোভাব পরিলক্ষিত হয় বা এমনতরো অন্য কোন খারাপ গুণ, সঠিক তারবিয়ত ও পরিচর্যার মাধ্যমে সেগুলোকে দমানো সম্ভব, সম্ভব তার চরিত্রের মধ্যে যুক্ত করা আরো আরো ভালো গুণ।

লেখক : আলেম ও প্রাবন্ধিক