জুলাই বিপ্লবের পরের ঘটনা। জাবি সরকার ও রাজনীতি বিভাগের প্রভাবশালী শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক মো. ইখতিয়ার উদ্দিন ভূঁইয়া ক্যাম্পাস থেকে উধাও হয়ে যান। জুলাই মাসে শিক্ষার্থীদের নানান হুমকি ও ছাত্রলীগের সঙ্গে হামলায় জড়িত থাকার কারণে প্রকাশ্যে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারেনি তিনি।
আশুলিয়া থানায় তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। মামলা নং ৬১/৯। ফলে দীর্ঘদিন তার কক্ষটি অব্যবহৃত পড়ে থাকায় কর্মচারীরা পরিষ্কার করতে ঢুকলে কক্ষ থেকে ব্যবহৃত ও অব্যবহৃত কয়েকটি কনডম পাওয়া যায়। ফলে নতুন করে নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তার অনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি সামনে আসে।
তার বিরুদ্ধে অপকর্ম ও নৈতিক স্খলনের অভিযোগ এনে তার কক্ষের দরজার উপর নেমপ্লেট তুলে ফেলে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। অভিযোগগুলোর বিষয়ে বিভাগের ৪৬ ব্যাচ থেকে ৫০ ব্যাচের ২৫ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।
এর আগে, শিক্ষার্থীর লেখা গবেষণা নিজের নামে চালিয়ে দেয়ার অভিযোগ ওঠে এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। গত ২৯শে আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও বিভাগীয় চেয়ারম্যান বরাবর অভিযোগপত্র জমা দেন ভুক্তভোগী ৪৭ ব্যাচের এক শিক্ষার্থী। তবে গত বছরের ১লা সেপ্টেম্বর তিনি শিক্ষা ছুটি নিয়ে বিদেশে গমন করেন। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীসহ অন্যরা।
ভুক্তভোগী সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেন, ‘২০২১ খ্রিষ্টাব্দে আমি ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলাম। ৩য় বর্ষের ৩০৯ নং কোর্সের (Course Title: Political Economy of Bangladesh) কোর্স শিক্ষক জনাব ইখতিয়ার উদ্দিন ভূঁইয়া আমার একটি অ্যাসাইনমেন্টের প্রশংসা করেন।
কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন তিনি ফোন দিয়ে রচনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালে প্রকাশ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ইতিমধ্যে আমি অন্য আরেকজন সুপারভাইজারের তত্ত্বাবধানে রচনাটি প্রকাশ করার জন্য কাজ শুরু করি। তাই তাকে জানাই, আমি অন্য একজন সুপারভাইজারের তত্ত্বাবধানে রচনাটি প্রকাশের কাজ করছি।
তিনি ওই সুপারভাইজারের কাছ থেকে রচনাটি নিয়ে এসে তার তত্ত্বাবধানে প্রকাশ করার জন্য বলেন। কাজেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওই সুপারভাইজারের থেকে রচনাটি নিয়ে ইখতিয়ার উদ্দিন ভূঁইয়ার তত্ত্বাবধানে প্রকাশ করতে সম্মত হই।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিছুদিন পর তিনি আমার রচনাটি কোনো রূপ পরিবর্তন ছাড়াই yBecoming an Asian Tiger: What Lesson Bangladesh Can Get From East Asian Miracle?- শিরোনামে -International Journal of Social Science and Human Research জার্নালে ২০২১ সালের মার্চ ইস্যুতে প্রকাশ করেন। তিনি আমার রচনাটি হুবহু প্রকাশ করার পরও আমাকে অবগত না করে তার নাম প্রথম লেখক হিসেবে দিয়েছেন এবং আমার নাম দ্বিতীয় লেখক হিসেবে সংযুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়াও তখন আমি ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী হওয়া সত্ত্বেও তিনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমার টাইটেলে মাস্টার্সের শিক্ষার্থী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীতে টাইটেল সংশোধন করার অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি তা সংশোধন করেননি। রচনাটি প্রাথমিক ড্রাফট হিসেবে থাকায় এবং পরে কোনো রূপ এডিট না করায় Plagiarism¯‘ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়াও আমার টাইটেলে ভুল থাকায় প্রকাশনাটি আমার ভবিষ্যৎ শিক্ষা এবং কর্মক্ষেত্রের জন্য হুমকিস্বরূপ বলে আমি তখন থেকেই আশঙ্কায় থাকি। এই ঘটনায় তখন আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি এবং এটি আমার শিক্ষা ও স্বাভাবিক জীবনযাপনকেও ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত করে।
এদিকে গত বছরের আগস্ট মাসের শেষে বিভাগের ছাত্র-শিক্ষক আলোচনা সভায় ইখতিয়ার উদ্দিন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে প্রশ্ন ফাঁস ও নম্বর ম্যানিপুলেশনসহ নানা অভিযোগ উত্থাপন করেন বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থী। ৪৭ ব্যাচের শিক্ষার্থী কে এম রেজওয়ান আহমেদ (রিজু) বলেন, ইখতিয়ার উদ্দিন ভূঁইয়া পরীক্ষার আগে তার প্রিয় শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন বলে দিতেন। কী কী প্রশ্ন আসবে তা সাজেশন আকারে হুবহু দিয়ে দিতেন। আমি নিজেও বন্ধুদের থেকে এমন প্রশ্ন পেয়েছি। হুবহু প্রশ্ন দেখে খুবই হতবাক হয়েছি।
প্রশ্নফাঁসকারী অনৈতিক শিক্ষকের বিভাগে থাকার অধিকার থাকতে পারে না। প্রশ্ন হাতে পাওয়া ৪৮ ব্যাচের আরেক শিক্ষার্থী জানান, স্যার প্রশ্ন সরাসরি দিতো না। তবে হলের ছাত্রলীগের ছেলেদের ৫/৬টি প্রশ্ন বলে দিতো। ওই ৫/৬টি প্রশ্নই চলে আসতো। আমি একবার পেয়েছি।
এদিকে জাবি বটতলার ‘রাঁধুনী হোটেল’ মালিকানা পরিবর্তনের সময় ২ লাখ টাকা লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। টাকা নেয়ার বিষয়টি হোটেলের এক কর্মচারী জানান। যার রেকর্ড প্রতিনিধির কাছে রয়েছে। এ ছাড়াও তিনি বটতলার খাবারের দোকানগুলোতে অভিযানের নামে জরিমানা করে আসতো। সেই জরিমানা নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফরহাদ হোসেনের মাধ্যমে দেনদরবার হতো। জরিমানা হলে দোকানমালিকরা ফরহাদের কাছে ছুটে যেতো।
এ ছাড়াও টাকার বিনিময়ে ফরহাদের আপন ছোট ভাইকে আ ফ ম কামালউদ্দিন হল সংলগ্ন মসজিদের ইমাম নিয়োগ দেন তৎকালীন প্রক্টর ও হল প্রভোস্ট আ স ম ফিরোজ উল হাসান। এই নিয়োগের সঙ্গে ওই শিক্ষকও জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদও জানিয়েছিল। সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক তারানা বেগম বলেন, ‘গবেষণায় চুরির অভিযোগটি পেয়েছি।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বরাবর অভিযোগটি ফরওয়ার্ড করেছি। একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে বলে শুনেছি।’ তদন্ত কমিটি সদস্যদের নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা একটি গোপনীয় বিষয়, নাম বলা যাবে না।, এদিকে জুলাই মাসে হামলার সঙ্গে জড়িত থাকায় এই শিক্ষকের নামে মামলা করেন ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সাজ্জাদুল ইসলাম (নকীব)। তিনি বলেন, আসামি শিক্ষকদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন লিয়াজোঁ করেছে। তা না হলে আসামি শিক্ষকরা কীভাবে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে পারে? ইখতিয়ার স্যার তো শিক্ষা ছুটি নিয়ে বিদেশে চলে গেছে। তাকে ছুটি দিয়েছে প্রশাসন।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অধ্যাপক মাফরুহী সাত্তারকে প্রধান করে চৌর্যবৃত্তি বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করলেও তদন্ত কমিটি এখন পর্যন্ত কার্যক্রম শুরু করেনি। তদন্ত কমিটির সদস্য অধ্যাপক মো. মুশফিক আনোয়ার বলেন, আমি তদন্ত কমিটির চিঠি পেয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত তদন্ত কমিটির কার্যক্রম শুরু হয়নি।
এ বিষয়ে সহযোগী অধ্যাপক ইখতিয়ার উদ্দিন ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি চুরির অভিযোগ মিথ্যা দাবি করেন। অন্য অভিযোগের
বিষয়ে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ মিথ্যা। আমি কোনো দোকানদার থেকে টাকা নেই নি। কাউকে প্রশ্ন দেই নি। আর রুমে কনডম পাওয়ার বিষয়টিও সত্য না। তবে এই শিক্ষকের কাছে বারবার জার্নাল টিমের কাছে পাঠানো মেইলটি ফরওয়ার্ড করতে বলা হলেও তিনি পাঠাননি। এ বিষয়ে মুঠোফোনে ভিসি’র সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি উত্তর দেননি।