আইন বিষয়ে যারা অধ্যয়ন করেন তাদের অধিকাংশেরই স্বপ্ন থাকে সহকারী জজ পদে কর্মজীবন শুরুর। এজন্য বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (বিজেএস) কমিশনের অধীনে তিনটি ধাপে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। প্রথমে প্রিলিমিনারি। তাতে উত্তীর্ণ হলে লিখিত। সে পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হলে ভাইভা। কেমন হয় সেই ভাইভা? সম্প্রতি ১৬তম বিজেএস ভাইভার মুখোমুখি হওয়া আবির সবুজ হোসেন নামে এক সফল প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করেছেন দৈনিক আমাদের বার্তার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি আসাদুল ইসলাম। সবুজ ১৬তম বিজেএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রথমবারেই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। তার অভিজ্ঞতা এখানে হুবহু তুলে ধরা হলো-
সবুজ হোসেন: স্যার, আসতে পারি?
-হ্যাঁ, সবুজ সাহেব। আসুন।
(চেয়ারের কাছাকাছি গিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে সালাম দিলাম। স্যার বসতে বললেন। বসলাম।)
আপনার বাসা কোথায়?
- ঢাকা জেলার দোহার থানায়
কোন বিশ্ববিদ্যালয়?
-স্যার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ডিন কে?
-বললাম।
(এরপর এসএসসি, এইচএসসি, এলএলবি ও এলএলএমের রেজাল্ট জিজ্ঞাসা করলেন। বললাম। মাস্টার্স তখন চলছে।)
আচ্ছা। আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে তো ঢাকা কোর্ট। কখনো গিয়েছেন? জেরা করতে দেখেছেন?
- স্যার, মাঝে মাঝে বড় ভাইদের সাথে যাওয়া হয়েছে।
আপনার বড় ভাই আইনজীবী?
- না স্যার। ডিপার্টমেন্টের সিনিয়রদের সাথে।
মনে করুন, একটা অপরাধ সংগঠিত হলো। পুলিশ গিয়ে আশেপাশের মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য নিবে। তাদের বক্তব্য লিখবে। কোন আইন অনুযায়ী করে এইটা?
- স্যার, আনন্যাচারাল ডেথ হলে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৪ ধারা অনুযায়ী।
না, না। মনে করুন একটা খুন হলো। স্পেসিফিক প্রভিশন বলবেন।
- স্যার, ১৬১ ধারা।
(এরপর সিআরপিসি, এভিডেন্স অ্যাক্ট মিলিয়ে বিশাল একটা ফ্যাক্ট বলেন। সিআরপিসি ১৬১, এভিডেন্স ১৪৫, ২৭ ও ৩২ টেনে উত্তর করি। এটা নিয়ে অনেকক্ষণ প্রশ্ন করেন।)
বলেন তো ‘Strict Liability’ কী?
- স্যরি স্যার। পড়েছিলাম কিন্তু স্পেসিফিক্যালি মনে পড়ছে না।
রাইল্যান্ড ভার্সেস ফ্লেচার মামলা পড়েন নি?
- স্যার, এটা টর্ট ল-তে ছিল। ফার্স্ট ইয়ারে পড়েছিলাম। বিস্তারিত মনে নেই।
আচ্ছা বলেন, কোর্ট কিভাবে ট্রান্সফার করা যায়?
- স্যার, মামলা? (হাসতে হাসতে... কোর্ট তুলে নিয়ে তো আর আপনি পরিবর্তন করতে পারবেন না।) স্যার, অন দ্য এপ্লিকেশন অব দ্য পার্টিজ (on the application of the পারতিএস) করা যায়; কোর্ট চাইলে Sue moto করতে পারে। ন্যায়বিচার ক্ষুন্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে সাধারণত কোর্ট পরিবর্তন করা হয়।
স্পেসিফিক প্রভিশন বলেন।
- স্যার, কোড অব সিভিল প্রিসিজিউর এর সেকশন ২৪।
আর ক্রিমিনালের ক্ষেত্রে?
- ৫২৫এ, ৫২৬, ৫২৬বি, ৫২৮ (সবগুলো সংক্ষেপে বললাম।)
(এরপর মামলা ট্রান্সফার নিয়ে কয়েকটি ফ্যাক্ট জিজ্ঞাসা করেন। সুন্দরভাবে গুছিয়ে উত্তর করেছি। বোর্ড সন্তুষ্ট বলে মনে হয়েছে।)
আপনার কয় ভাই বোন? আপনিই সবার বড়?
- বিস্তারিত বললাম।
তারা কে কি করেন?
- বিস্তারিত বললাম।
বাবা কি করতেন?
-বিস্তারিত বললাম।
জায়গা জমি, সম্পত্তি কতটুকু আছে?
- বললাম।
আপনি ঢাকায় থাকেন?
- জ্বী স্যার, পুরান ঢাকায় থাকি।
খরচ কিভাবে মেইনটেইন করেন?
- টিউশনির কথা বললাম।
কয়টা করান? কত টাকা আসে?
- বললাম।
ম্যানেজ হয়ে যায়? মেস করে থাকেন? বাসা ভাড়া কত? এক রুমে কয়জন থাকেন?
- বললাম।
ঘুম থেকে কয়টায় উঠেন?
- বললাম।
আপনি কি নিজেকে সৎ মনে করেন? কেন মনে করেন?
- জ্বী স্যার। আল্লাহর ভয়, ছোট বেলা থেকে মায়ের শিক্ষা। (এগুলো নিয়ে বললাম কিছুক্ষণ।)
আপনি তাহলে মায়ের শিক্ষা, হাশরের ময়দানের ভয়, জাহান্নামে আগুনে পোড়ার ভয়ে সৎ থাকেন। বিবেকের কারণে না?
-স্যার, বিবেকের ব্যাপারটা তো অবশ্যই আছে। দিন শেষে ঘুমাতে গেলে দিনের সকল কার্যক্রম রি-কল হতে থাকে।
তাহলে বললেন না যে?
- স্যার, অসাবধানতাবশত স্কিপ হয়ে গিয়েছিলো।
আপনার এলাকায় একটা জজ বাড়ি আছে। চিনেন?
- জ্বী স্যার। নবাবগঞ্জে। (কিছুক্ষণ এইটা নিয়ে আলোচনা হলো।)
ঐ জজের নাম বলেন।
- স্যরি স্যার।
আচ্ছা, আপনার এলাকায় একজন বিচারপতি ছিলেন। কিন্তু বাড়িতে জজ বাড়ি লেখা ছিল না। (নাম বলেছিলেন) উনার বাড়ি নদীতে ভেঙে নিয়ে গেছে। উনার গ্রামের নাম বলেন।
- আমার জানা নেই স্যার।
জজ বাড়ি ঠিকই চিনেন। বিচারপতির বাড়ি চিনেন না।
- স্যরি স্যার। ঐটা দর্শনার্থী স্থান, ছোটবেলায় গিয়েছিলাম তাই চিনি।
সবুজ সাহেব, মুক্তিযুদ্ধের সময় তো ভারত আমাদেরকে অনেক সহায়তা করেছিলো, তাই না? মুক্তিযুদ্ধের সময় কতজন বাঙালি ভারতে শরনার্থী হয়েছিলো?
- বললাম।
বলেন তো ঐসময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কে ছিলো?
- আমার জানা নেই স্যার।
যুদ্ধের সময় তাজউদ্দীন সাহেবেরা যেখানে থাকতেন ওই জায়গাটার নাম জানেন?
-জ্বী স্যার। ৮ নং থিয়েটার রোড। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সদরদপ্তর ছিল। (বিস্তারিত বললাম।)
ওই সময় ভারতে পাকিস্তানের হাই কমিশনার কে ছিলেন?
-স্যার, এইটা আমি জানতাম। কিন্তু এখন মনে করতে পারছি না।
বলেন; বললেই হয়ে যাবে। (পাশ থেকে- উনি কানাডায় মৃত্যুবরণ করেন।)
-স্যার, মনে করতে পারছি না।
হুসেন আলী নামে কাউকে চিনেন?
-স্যরি স্যার।
আপনার তো ইতিহাস সম্পর্কে জানার আগ্রহ কম।
- স্যার, জানার চেষ্টা করি।
মানব ইতিহাসে প্রথম মামলা কোনটি?
- স্যার, হাবিল-কাবিলের ঘটনাটা কি গ্রহণযোগ্য?
আপনি কি প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন করতে পারেন?
- স্যরি, স্যার। আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমি দুটি ঘটনা জানি। হাবিল-কাবিলের আর সুজানা কেইসের। দানিয়েলের কথাও উল্লেখ করলাম।
এগুলো না। অনেককেই জিজ্ঞাসা করেছি, কেউ উত্তর দিতে পারেনি। হাউস অব লর্ডসের একটি জাজমেন্টে আছে, আমিও একটা জাজমেন্টে এটি লিখেছি। গুগল সার্চ করলেই পাবেন।
- জি স্যার। এটা আমার জানা ছিল না।
আচ্ছা, আপনি আসুন। ভালো থাকবেন।
- আমার জন্য দোয়া করবেন স্যার। চেয়ার থেকে উঠে তখন মাত্র সাইডে দাঁড়িয়েছি।
আপনারা কী এখানের আলোচনা বাইরে প্রকাশ করেন? (পাশ থেকে তৃতীয় প্রশ্নকর্তা- ওদের ফেসবুক পেজ আছে। ওখানে পোস্ট করে।)
-স্যার, বন্ধু বা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় ভাই কেউ ভাইভা দিলে তাদের জিজ্ঞাসা করা হয় যে ভাইভা কেমন হলো!
তারা প্রশ্ন বলে?
-স্যার, মনে থাকলে দুই বা একটা বলে।
এবার বলেন তো আপনার ভাইভা কেমন হয়েছে?
-স্যার, আমি তো অনেকগুলো প্রশ্নের স্পেসিফিক উত্তর দিতে পারিনি। নিজের প্রতি আমার এক্সপেক্টেশন আরো বেশি ছিল। আমি সেটা পুরো করতে পারিনি। আরো ভালো হওয়া উচিত ছিল।
আচ্ছা। আসুন।
-আমার জন্য দোয়া করবেন স্যার।