অটোপাস ও পার্টিশন গ্রাজুয়েট কাহিনী - দৈনিকশিক্ষা

অটোপাস ও পার্টিশন গ্রাজুয়েট কাহিনী

আহসান কবির, দৈনিক আমাদের বার্তা |
১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে বিরল সৌভাগ্যবান এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হয়েছিল। আমাদের বাসাতে বেড়াতে এসে উনি গর্ব করে বলেছিলেন-‘আমি ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে গ্রাজুয়েট পাস করেছি’। এই সৌভাগ্যবান মেহমান বাসা থেকে চলে যাবার পর আমার বাবা বলেছিলেন-‘ যারা ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে গ্রাজুয়েট পাস করেছিল তাদের বলা হতো ‘পার্টিশন গ্রাজুয়েট’! ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের দেশভাগের সময় যারা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি জমা দিয়েছিলেন দেশভাগের কারণে তাদের ‘অটোপাস’ করিয়ে দেয়া হয় এবং ডিগ্রির পরের ক্লাসে ভর্তি হতে তাদের কোন অসুবিধে হয় নি! কিন্তু মানুষ নাকি এদের ব্যঙ্গ করে বলতো-‘পার্টিশন গ্রাজুয়েট!’
 
একারণে ইদানিং বলা হচ্ছে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে যেমন রক্ষা করা কঠিন তেমনি নাকি অটোপাস করার চেয়ে এটা বয়ে বেড়ানো কঠিন হবে! কোটাবিরোধী আন্দোলনে জেল-জুলুম, আহত হয়েছেন হাজারো এইচএসসি পরীক্ষার্থী। চলমান এইচএসি পরীক্ষায় সাবজেক্ট ম্যাপিং করে ফল প্রকাশ বা  অটোপাস দাবিটি কিন্তু ২০২০ খ্রিষ্টাব্দেটার সঙ্গে তুলনীয় নয়। ২০২০ শুধু করোনার কারণেই নয় ‘অটোপাস’ এর বছর হিসেবেও স্মরণীয়। ওই সময়েই বলাবলি হচ্ছিলো জামাই বাজার, চাকরির বাজার, টিউশনির বাজার এমন কী শিক্ষকতার বাজারে অটোপাসকে নিন্দার চোখে দেখা হতে পারে। 
 
বাংলাদেশের রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলার অলিতে গলিতে ‘অটোরিকসা’ নিয়ে পুলিশ বা আমজনতা যতোই আপত্তি তুলুক সম্ভবতঃ সব ‘অটো’ খারাপ না। একদা বাংলাদেশের একজন ‘অটো ফিস্টার’ ছিলেন। জার্মান এই ভদ্রলোক বাংলাদেশের ফুটবল দলের কোচ ছিলেন। বাংলাদেশ তাকে বিনে পয়সায় পেয়েছিল! বিশ্বাস হচ্ছে না? সাংস্কৃতিক বিনিময় চুক্তির বলে ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অটো ফিস্টার ছিলেন বাংলাদেশের কোচ, তার বেতন কড়ি দিত জার্মানী! মিয়ানমারে চারজাতি ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনালে জিতেছিল বাংলাদেশ ফিস্টারের অধীনেই। তার দুর্ভাগ্যও ছিল অনেক। ১৯৯৭ এ সাফ গেমসে সোনা জিততে না পারার দুঃখে বাংলাদেশ তাকে ‘অটো বিদায়’ জানিয়ে দেয়। এরপর ফিস্টারের হাত ধরে ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের বিশ্বকাপে সৌদি আরব ও ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের ফুটবল বিশ্বকাপে টোগো বিশ্বকাপ খেলার ছাড়পত্র পেয়েছিল! বাংলাদেশ অবশ্য অটো ফিস্টারের এই ‘অটোটা’পায় নি। পেলে নির্ঘাত ফুটবল বিশ্বকাপ খেলতো। বয়সের কাছে অটো হার না মানা অটো ফিস্টার ৮০ বছর বয়সে দায়িত্ব নেন আফগানিস্তান টিমের। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে আফগানিস্তানের জর্ডানের সাথে তিন গোল খেয়ে পরে আবার তিন গোলই অটো শোধ করে দেয়!
 
অটো ফিস্টারের মতো সৌভাগ্যবান নন, উল্টো একেবারে দুঃখের বরপুত্র হচ্ছেন ‘অটো গোল’ খ্যাত আন্দ্রে এসকোবার। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বকাপ ফুটবলে অ্যামেরিকার বিপক্ষে খেলার সময়ে এসকোবারের পায়ে লেগে আত্মঘাতি গোল খেয়ে বসে কলাম্বিয়া এবং বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়ে! দেশে ফেরার পর ২ জুলাই রাতে একদল উশৃংখল সমর্থকের পাল্লায় পরেন এসকোবার। ফুটবল বাজিতে অনেক টাকা হেরে যাওয়া ক্যাস্ট্রো মুনোজ গুনে গুনে ছয়টা গুলি করেন এসকোবারকে। প্রতিবার উচ্চারণ করেন ‘গোল। অটো গোল’! থ্যাংকুউ ফর ‘অটো গোল’। আত্মঘাতি বা অটো গোলের কারণে নিহত হন এসেকোবার আর মুনোজের পয়তাল্লিশ বছর কারাদন্ড হলেও বয়স ও ব্যবহারের কারণে ১১ বছর পর ছাড়া পায় সে। তবে কলাম্বিয়ার ফুটবলার আন্দ্রে এসকোবারকে এখনও ভোলে নি মানুষ।
 
প্রথমেই উল্লেখ করেছিলাম সব অটো খারাপ না। সারা পৃথিবী বিখ্যাত এক অটোমেটিক রাইফেলের নাম একে-৪৭। রাশিয়ান অস্ত্র ডিজাইনার মিখাইল কালাশনিকভ এই রাইফেলের কারণে পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে আছেন। তার সুন্দর ভাস্কর্য উম্মোচিত হয়েছে রাশিয়ায়। কালাশনিকভ ট্যাংক থেকে গোলা নিক্ষেপের প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছিলেন। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বযুদ্ধে আহত হবার পর হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে তিনি প্রথম এর ডিজাইন করেন এবং সাত বছর পর ১৯৪৭ থেকে এটি পূর্নদমে ব্যবহৃত হতে থাকে! পৃথিবীর প্রায় ৮০টি দেশে এই রাইফেল ব্যবহৃত হয় এবং রাশিয়া ছাড়াও এখন ত্রিশটি দেশ এই রাইফেল উৎপাদন করে। ওসামা বিন লাদেন যে একে ৪৭টি ব্যবহার করতেন সেটি অ্যামেরিকার পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছিল রাশিয়ার বিরুদ্ধে গণযুদ্ধ করার জন্য। কালাশনিকভ এটি জেনে আনন্দ পেতেন যে পূর্ব তিমুর, জিম্বাবুয়ে, বুরকিনা ফাসো ও মোজাম্বিকের পতাকায় একে রাইফেলের ছবি আছে! দুঃখ পেতেন এই ভেবে যে সন্ত্রাসীরা এই রাইফেল ব্যবহার করে সাধারণ বা ভালো মানুষকে হত্যা করে!
 
অটো মোটর বাইক, অটো গাড়ির চেয়ে এদেশে আলোচিত এক গরীব যানবাহনের নাম ইজিবাইক বা অটো রিকশা!(যদিও সিএনজিকে ডাকা হচ্ছে এই নামে) অটো বা ইজিবাইক নিয়ে সিএনজি, বাস, মিনিবাস এমন কী রিকসাওয়ালাদেরও রাগ আছে। অনেকে এসব ‘অটো’কে রাস্তায় নামতে দিতে না রাজ। আছে ইঞ্জিনচালিত রিকসা। এই অটো বা ইঞ্জিনচালিত রিক্সা নিয়ে আন্দোলনও হয়েছে। একদল বলছে গতি ও বিবিধ কারণে এদের রাস্তায় নামতে দেয়া ঠিক না। এদের কারণে বাড়তি বিদ্যুৎ খরচ হয় কিন্তু সরকার রাজস্ব হারায়। আর বিপরীত মত হচ্ছে গরীবের জীবিকার ব্যাপরটা ভাবতে হবে। এসব ‘অটো’ পরিবেশবান্ধব! 
 
আসলে বার বার ১৯৪৭ বা ১৯৬২ ফিরে ফিরে আসে! দেশবিভাগের মতো ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে সারা পূর্ব পাকিস্তানে সেসময়কার শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলনে ফুঁসে উঠেছিল ছাত্ররা। সরকার চেয়েছিল ডিগ্রি পাসের সময়সীমা দুই বছর থেকে বাড়িয়ে তিনবছর করতে। ছাত্র আন্দোলনের মুখে সেটা দুইবছরই রাখা হয় কিন্তু যারা তৃতীয় বর্ষে উঠেছিলেন তাদের পরীক্ষা ছাড়াই অটোপাস করিয়ে দেয়া হয়! এই গ্রাজুয়েটদের তখন বলা হতো ‘অটোগ্রাজুয়েট’! অনেকেই এদের বলতেন-‘শরীফ গ্রাজুয়েট’!(তখন ‘শরীফ কমিশনের’ শিক্ষানীতি নিয়েই আন্দোলন হয়েছিল)
 
কেউ কেউ ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দকে এই ‘অটো’র তালিকায় রাখেন। বাস্তবে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে অটোপাস বলে কিছু ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের কারণে সীমিত নম্বরের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু নকল কী জিনিস সেটা দেখা গিয়েছিল সারাদেশে এবং প্রথম ও দ্বিতীয় বিভাগে পাসে হার ছিল ৯৭-৯৮ ভাগ! পরের বছরও একই অবস্থা ছিল! ছিল নকলের সীমাহীন স্বাধীনতা! পরের বছর ঘটলো সীমাহীন ঘটনা। নকল উঠে গেল যেন দেশ থেকে আর শতকরা ৯৪ ভাগ শিক্ষার্থী ফেল করে বসলো! 
 
লেখক: সাংবাদিক
পলাতক দীপু মনি পাকড়াও - dainik shiksha পলাতক দীপু মনি পাকড়াও পদোন্নতির দাবিতে শতশত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা শিক্ষা সচিবের কক্ষে - dainik shiksha পদোন্নতির দাবিতে শতশত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা শিক্ষা সচিবের কক্ষে এনসিটিবির চেয়ারম্যানের পদত্যাগ - dainik shiksha এনসিটিবির চেয়ারম্যানের পদত্যাগ শিক্ষা উপদেষ্টা অটোপাসের ঘোষণা দেবেন, আশ্বাস কন্ট্রোলারের - dainik shiksha শিক্ষা উপদেষ্টা অটোপাসের ঘোষণা দেবেন, আশ্বাস কন্ট্রোলারের জিডিপি প্রবৃদ্ধির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি: শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha জিডিপি প্রবৃদ্ধির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি: শিক্ষা উপদেষ্টা শিক্ষা ভবনের ইএমআইএস সার্ভার বন্ধ করলেন সেসিপের কর্মকর্তারা - dainik shiksha শিক্ষা ভবনের ইএমআইএস সার্ভার বন্ধ করলেন সেসিপের কর্মকর্তারা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কেন অবৈধ নয়, হাইকোর্টের রুল - dainik shiksha সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কেন অবৈধ নয়, হাইকোর্টের রুল সময় টিভির সম্প্রচার এক সপ্তাহ বন্ধের নির্দেশ - dainik shiksha সময় টিভির সম্প্রচার এক সপ্তাহ বন্ধের নির্দেশ এইচএসসিসহ কারিগরিতে ভর্তির সময় ফের বাড়লো - dainik shiksha এইচএসসিসহ কারিগরিতে ভর্তির সময় ফের বাড়লো নিরুদ্দেশ ৪০ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক - dainik shiksha নিরুদ্দেশ ৪০ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে অটোপাস ও পার্টিশন গ্রাজুয়েটের কাহিনী - dainik shiksha অটোপাস ও পার্টিশন গ্রাজুয়েটের কাহিনী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.007066011428833