দৈনিক শিক্ষাডটকম, জয়পুরহাট: ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার খোশবদন জি. ইউ আলিম মাদরাসা। এমপিওভুক্ত হওয়ার পর মাদরাসার অধ্যক্ষ নিয়োগ বাণিজ্য করে হাতিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। মাদরাসাটির আলিম শাখায় শুরু থেকে যারা কর্মরত ছিলেন, এমপিওভুক্ত হওয়ার পর তাদের একটি অংশকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এরপর পেছনের তারিখ দিয়ে কৌশলে কয়েকজন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছেন অধ্যক্ষ। নিয়োগ দিয়ে একেকজন শিক্ষকের কাছ থেকে ১৫ থেকে ১৭ লাখ টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে অধ্যক্ষ মো. একরামুল হকের বিরুদ্ধে।
যাদের অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, তারা হলেন অজিফা খান, মো. সোহেল রানা ও মো. আনোয়ার হোসেন। তাদের মধ্যে মানবিক বিভাগের (পৌরনীতি) প্রভাষক অজিফা খান মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ আটটি দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জুলাই ২ হাজার ৭১৬টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করেছিল সরকার। খোশবদন জি. ইউ আলিম মাদরাসা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) ঘেঁটে দেখা যায়, ক্ষেতলাল খোশবদন জি. ইউ আলিম মাদরাসার ব্যানবেইসে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের তথ্যে মো. সানোয়ার হোসেন, রুহুল আনোয়ার, আনোয়ার হোসেন ও দেলোয়ার হোসেনসহ চারজনকে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর প্রভাষক পদে নিয়োগ দেখানো হয়। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের তথ্যে একই তারিখে সোহেল রানা নামে আরও একজন শিক্ষককে নিয়োগ দেখানো হয়। তারপর ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এই পাঁচজন শিক্ষকের একই তথ্য পাওয়া যায়।
২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের তথ্যে হঠাৎই উদয় হন রাবেয়া খাতুন নামে আরেক শিক্ষক (সহকারী শিক্ষক, ইংরেজি পদে), যার নিয়োগ দেখানো হয়েছে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ অক্টোবর। জন্মতারিখ দেখানো হয় ১০ অক্টোবর, ১৯৮৬। ২০২১ সাল পর্যন্ত রাবেয়া খাতুনের তথ্যও একই থাকে। ২০২১ সালে এসে প্রভাষক আনোয়ার হোসেনকে ইংরেজি, সানোয়ার হোসেনকে বিজ্ঞান, মো. সোহেল রানাকে বিজ্ঞান, মো. দেলোয়ার হোসেনকে বিজ্ঞান এবং রুহুল আনোয়ারকে মানবিক বিভাগের সহকারী প্রভাষক পদে দেখানো হয়। ২০২২ সালে তথ্যে ব্যাপক রদবদল হয়। সেখানে দেখা যায়, মানবিক বিভাগের সহকারী প্রভাষক রুহুল আনোয়ার, বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সানোয়ার হোসেন ও ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক দেলোয়ার হোসেনের নিয়োগ দেখানো হয় ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ ডিসেম্বর। এ ছাড়া বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মো. সোহেল রানা ও ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক আনোয়ার হোসেনকে বাদ দিয়ে সেখানে আবু নাছের আকন্দ ও রাবেয়া খাতুনের নাম যুক্ত করা হয়েছে।
অবাক বিষয় হলো, ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক রাবেয়া খাতুনের নাম দুবার দেখানো হয়েছে। একটাতে দেখানো হয় সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি), জন্মতারিখ ১০ অক্টোবর, ১৯৮৬। আরেকটিতে দেখানো হয়েছে প্রভাষক (ইংরেজি), জন্মতারিখ ৯ অক্টোবর, ১৯৮৬।
২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের তথ্যে এসব শিক্ষকের যোগদানের তারিখ ২৬ ডিসেম্বর থেকে আবারও ২৭ ডিসেম্বর দেখানো হয়। আগের তথ্যে ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক দেখানো রাবেয়া খাতুনের নাম বাদ দিয়ে সেখানে মাহফুজুর রহমান নামের আরেকজনের নাম দেখানো হয়।
মো. মাহফুজুর রহমান আগে কর্মরত ছিলেন উপজেলার মিনিগাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের আগের নিয়োগ ও ১১-১২ নিবন্ধন ব্যাকডেটে তার যোগদানের সময় বয়স দেখানো হয়েছে। তিনি ২০১৭ সাল থেকে (৫ নভেম্বর) ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে সরকারি বেতন-ভাতা উত্তোলন করেছেন। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ নভেম্বর শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। ওই মামলায় এই শিক্ষককে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়। তিনি গত তিন মাস ধরে ক্ষেতলাল খোশবদন আলিম শাখায় ইংরেজি প্রভাষক হিসেবে ক্লাস নিচ্ছেন। অথচ মাদরাসা স্কুল-কলেজের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০২১ অনুযায়ী, চাকরিপ্রার্থীরা প্রতিষ্ঠান চাহিদামাফিক এনটিআরসির গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিয়োগ পেয়ে থাকেন।
মাদরাসার ইংরেজি প্রভাষক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ওই প্রতিষ্ঠানে বিনা বেতনে পরিশ্রম করেছি। এমপিও হওয়ার পর প্রিন্সিপাল আমার সঙ্গে অমানুষিক আচরণ করেন। এখন পর্যন্ত আমি কোনো রিজাইন লেটার দিইনি। ব্যানবেইসেও আমার নাম আছে। ২০২৩ সালে এনটিআরসির গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ওই বছরের ১ জানুয়ারি বগুড়ার একটি প্রতিষ্ঠানে আমার ইন্ডেক্স হয়েছে। আমার স্থলাভিষিক্ত ইংরেজি প্রভাষক পদে একমাত্র এনটিআরসি নিয়োগ দিতে পারে। প্রিন্সিপাল ব্যাকডেটেড কাউকে নিয়োগ দিয়ে থাকলে এটি তদন্ত করা উচিত।’
অজিফা খান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘১৩ বছর দুধের বাচ্চাকে নিয়ে চাকরি করেছি। আমাকে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। আমি মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। শেষ পর্যন্ত আমি আইনি লড়াই চালিয়ে যাব।’
ক্ষেতলাল খোশবদন জি. ইউ আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষ মো. একরামুল হকের বক্তব্য নেওয়ার জন্য একাধিকবার প্রতিষ্ঠানে গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনেও একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি বক্তব্য না দিয়ে দেখা করবেন বলে ফোন কেটে দেন।
অভিযোগের বিষয়ে মাদরাসার সভাপতি অ্যাডভোকেট এস এম মোরশেদ বলেন, ‘সভাপতির দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে কোনো শিক্ষক নিয়োগ হয়নি। আমি যতদূর জানি ২০২১-এর পরিপত্র অনুযায়ী এনটিআরসির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হয়ে থাকে। সাবেক সভাপতির মৃত্যুর পর কৌশলে ব্যাকডেটে এসব শিক্ষককে নিয়োগ দিয়েছেন বলে আমার কাছেও একটা অভিযোগ এসেছে। আর আমি নিয়োগসংক্রান্ত বিষয়ে কিছুই জানি না। অধ্যক্ষ একরামুল হক কীভাবে এসব করেছেন তিনি তার জবাব দেবেন। আমি এসবের মধ্যে নেই।’