রাজনীতি রাজার নীতি, নাকি নীতির রাজা তা নিয়ে একটি বিতর্ক প্রচলিত আছে। যদিও বাংলা ভাষার ব্যাকরণ একে ‘নীতির রাজা’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। রাজনীতি ব্যাপারটিকে মহিমান্বিত করার একটি প্রয়াস হতে পারে এটি। যে ‘Politics’ শব্দ থেকে এর উৎপত্তি সেখানে একে নগর বা রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি হিসেবে বর্ণনা করা হলেও আমাদের অঞ্চলে এটি ‘রাজা’ ধারণার সঙ্গে প্রযুক্ত হয়েছে।
যেহেতু গণতন্ত্রে জনগণই রাজনৈতিক ক্ষমতার উৎস তাই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন রাজনীতির অস্তিত্বের সংকটে ভোগা খুবই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের বড় দুই দলের জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতির ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। ক্ষমতার পালাবদলে একে অন্যকে প্রবলভাবে অস্বীকার করার ও মুছে ফেলার চেষ্টা বিলক্ষণই তাদের অস্তিত্বভীতির লক্ষণ। এই অস্তিত্বভীতি কাটাতেই পোষা হয় চামচা, দালাল, মোসাহেব, চাটুকারের বিভিন্ন স্পেশাল বাহিনী। আরো আছে সেকালের রক্ষীবাহিনী থেকে শুরু করে অধুনা পিস্তল, রামদা, চাপাতি, রড, চেইন, হাতুড়ি, স্ট্যাম্প ও হেলমেটবাহিনী।
তারা পরস্পর পরস্পরকে সমূলে উৎপাটন করতে চায়। যুগপৎভাবে এর পেছনে থাকে নিজেদের শিকড়-সংকট এবং সামনে থাকে কর্তৃত্ববাদী বাসনা। প্রতিপক্ষকে মুছে ফেলতে পারলেই নিজেদের ‘মহারাজাধিরাজ’ হিসেবে চিরপ্রতিষ্ঠিত করা যায়। তাই তারা করে এসেছে প্রতিপক্ষের বিরোধিতার, অস্বীকার করার এবং নামচিহ্ন গায়েব করে ফেলার রাজনীতি। আর চিরতরে অস্বীকার করার বা মুছে ফেলার রাজনৈতিক সংস্কৃতিই নতুন নতুন ফ্যাসিস্টের জন্ম দেয়।
দুই দলই নিজেদের মেয়াদে জনগণের দোহাই দিয়ে এগুলোই করার চেষ্টা করে গেছে। প্রতিটি দলেরই খুদকুঁড়ো দিয়ে পোষা একপাল অন্ধ-অনুসারী (পড়ুন চামচা) আছে। তাদের মগজ ধোলাই করা, তারা রাতদিন রোবটের মতো দল ও দলের নেতার নামে শ্লোগান-শোডাউন দিয়ে মাঠ গরম রাখে। আর সবগুলো দলই দেখাতে চেষ্টা করে জনগণ তাদের সঙ্গেই আছে। এ দেশে ‘জনগণ’ বলতে যে ঠিক কী বোঝায় সেটিও এক ধোঁয়াশা। রাষ্ট্রের জনসমষ্টির একটা বড় অংশ থাকে যারা সাধারণত ‘রাজনীতি-নিরপেক্ষ’, প্রচলিত রাজনীতি নিয়ে। তার কখনো মাথা ঘামান না এবং কোনো নির্ধারিত দলের ভোটব্যাংকও নন। কোনো একটি দলের কাছে এই দলপরিচয়হীন খেটে খাওয়া জনতা এবং বিরোধী পক্ষগুলোর ভোটারেরা ‘জনগণ’ হিসেবে বিবেচিত হন কি না সেটি কোটি টাকার প্রশ্ন।
দেশে পর্যায়ক্রমে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলই একাধিকবার ক্ষমতায় এসেছে, কিন্তু এই রাজনৈতিক অস্তিত্বভীতি তারা কখনো কাটাতে পারেনি। অস্তিত্বভীতি কাটাতে প্রবলভাবে তারা নিজেদের অস্তিত্বকে স্থাপন করার জন্য মরিয়া হয়ে যেমন উঠেছে, তেমনি বিরোধীপক্ষকে মুছে ফেলার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছে। নিজেদের অনুকূলে নামবদল, নতুন নামকরণ বা নামের স্থাপনা স্থাপন করে গেছে।
এই কাজটি অত্যন্ত ভয়াবহভাবে করেছে সদ্য বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। তারা রাষ্ট্রকে পরিবারায়নের লীলাভূমি করেছে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে করেছে পারিবারিক দিবস উদযাপনের রঙ্গমঞ্চ। রাজনৈতিক ও সরকারি ক্ষমতা প্রয়োগে রাষ্ট্রযন্ত্রকে বাধ্য করেছে নব্য স্তুতিবাদ কায়েমে। পথে পথে মোড়ে মোড়ে হাজার হাজার লাখো লাখো ম্যুরাল-ভাস্কর্য বসিয়ে দিয়েছে, ঠান্ডা মাথায় নষ্ট করেছে জনগণের কোটি কোটি টাকা।
বলাবাহুল্য এসবই হয়েছে নিজেদের চিরস্থায়ী করার মানসে। তারা ভুলে গেছে, জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেমন অস্তিত্বভীতি কাটানো যায় না, তেমনি জোরজবরদস্তি করে চিরস্থায়ী করা যায় না নিজেদের অস্তিত্ব। যার কারণে ৫ আগস্ট ২০২৪ বিকেল থেকে ঘণ্টা কয়েকের মধ্যে তাদের অস্তিত্ব রক্ষার সব প্রচেষ্টা ও অস্তিত্ববাহী যতো হিমালয় সদৃশ স্তম্ভ মুহূর্তেই ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। চারিদিকে ধ্বনিত হয়েছে সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমার সেই শ্লোগান ‘...দড়ি ধরে মার টান, রাজা হবে খানখান...’।
হাসিনা সরকার শেখ মুজিবের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধাকে ভাষ্কর্যের আদলে চিরস্থায়ীভাবে দাঁড় করাতে যেয়ে তার প্রতি মানুষের সহজাত ভালোবাসাকে মানুষের হৃদয় থেকে টেনে বের করে ফেলেছিলো। তারা ভুলে গিয়েছিলো, চিরস্থায়ী ভক্তি ও অস্তিত্ব মানুষের ভালোবাসায় মানুষের অন্তরেই থাকে। তাকে ভাস্কর্য রূপে বাইরে প্রতিষ্ঠা ও প্রদর্শন করতে গেলে মানুষের হৃদয় থেকে ভক্তি-অস্তিত্ব হারিয়ে যায়।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া অন্য কাউকে স্বীকার করা হয়নি, যেনো তার আগে-পরে আর কেউ নেই। আবার বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে প্রাণপণ করেছে শেখ মুজিবকে অস্বীকার করতে, তাকে আড়াল করে তার স্থলে জিয়াউর রহমানকে রিপ্লেসমেন্ট করতে। বাঙালি জাতীয়তাবাদের তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলার চেষ্টা হয় ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ প্রত্যয়টি। এরা মুছতে চায় মুজিবকে, তো ওরা জিয়াকে। তারা দেশটাকে নিজেদের ব্যক্তিগত কৃষিজমি মনে করে মুজিববাদ ও জিয়াবাদের আবাদ করে যেতে চায়।
মুছে ফেলা ও অস্বীকার করার এই খেলায় তারা গোটা জনগোষ্ঠীকে, জাতিকে বিভক্ত করে রেখেছে ‘জয় বাংলা’ ও ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ এর ঠেলাঠেলিতে। বিষয়টি এমন যে, মুজিবের লোক হতে হলে আপনার জিয়াকে ঘৃণা ও বাতিল করতে হবে, আর জিয়ার লোক হতে হলে ঘৃণা ও বাতিল করতে হবে মুজিবকে। পরস্পরের প্রতি এই ঘৃণা-বিদ্বেষ, এই গালাগালি ও বিষোদগারে জাতীয় সংসদের মহামূল্য সময়ও এরা নষ্ট করে। রাষ্ট্রের পাঠ্যপুস্তকে ও শিশুদের মগজেও সে প্রভাব পড়ে মেয়াদে মেয়াদে। চাপিয়ে দেয়া একদেশদর্শী ইতিহাসের চাপে দেশের জনতা মুখ থুবড়ে পড়ে বারবার! রাষ্ট্রের বিস্তর সম্পদ ও টাকা এই অ-কাজে অচপয় হয়।
বিভক্ত জাতি সামনে এগোতে পারে না, শুধু নিজেদের মধ্যে মারামারি বাধায়। প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বের বুকে আজ এগিয়ে যেতে হলে প্রয়োজন জাতিগত ঐক্য ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। কিন্তু তারা জাতির ঐক্য চায় না, জাতিকে বিভক্ত রেখে রাজনীতির বাণিজ্য চালিয়ে যেতে চায়। দুই দলেরই ঘোষণা অনুযায়ী ‘তারা জনগণের জন্য রাজনীতি করে’ এটি জনগণের সঙ্গে এক চরম ধাপ্পাবাজি। তাদের রাজনীতির উদ্দেশ্য কী তা তাদের নেতাদের ভোটে নির্বাচিত হওয়ার আগের ও পরের আর্থিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেই সহজে বোঝা যায়।
জনগণের ভাগ্য বদল ও দিন বদলের শ্লোগান দিয়ে ক্ষমতার মঞ্চে চড়েই তারা নাম বদলের খেলায় মত্ত হয়। অন্যের আয়ু কমাতে কিংবা নিজের লোককে দীর্ঘায়ু দিতে চলে নাম উৎপাটন ও পুনর্লিখন। তারা ভাবে না, ক্ষমতা কখনো এক হাতে চিরস্থায়ী নয়! পূর্ববর্তী সরকারের মেয়াদের সবকিছুই তারা বাদ দিয়ে আবার শুরু করে নতুন করে। মেয়াদের পর মেয়াদ এই নতুন করে যাত্রা করার পাকচক্রে পড়ে দেশ আর এগোতেই পারে না, এক স্থানেই ঘুরপাক খায়। এই অসুস্থ চক্রে চন্দ্রিমা উদ্যান হয়ে যায় জিয়া উদ্যান, আরেকদল এসে আবার জিয়া উদ্যানের নামফলক ভেঙে ফেলে। দেশের প্রধান বিমানবন্দরটির নামও পাল্টেছে দফায় দফায়।
রাজনৈতিক মাতলামিতে ইতিহাস ও সংস্কৃতি মুছে ফেলা একদিকে রাজনৈতিক বালখিল্যতা, অন্যদিকে এটি এক ধরনের দস্যুতা। ইতিহাসকে দলীয়করণ করতে গিয়ে এখানে জাতিকে বিভক্ত করা হয়েছে বারবার। মহান নেতারা তো বেঁচে থাকবেন দেশ ও জাতি গঠনে তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকায়। এতো নামকরণ করে কেনো তাদের বাঁচাতে হবে! নামকরণের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় পালাক্রমে কেউ বাবাকে, কেউ স্বামীকে ধরে এমন টানাহেঁচড়া শুরু করেন যে সম্মানের আবরণ ছিঁড়ে বাবা-স্বামীরা নগ্নদশায় পড়ে যান। বিরোধীপক্ষকে বৈরীপক্ষ হিসেবে দেখে নাম বদল ও অস্বীকারের এই নগ্ন উল্লাসে তাকে নির্মূল করার যে রাজনীতি ক্ষমতাসীন হয়ে এই দুই দল পালাক্রমে চর্চা করে এসেছে তা আসলে সার্বিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির করুণ দৈন্যদশা, হাস্যকর ছ্যাবলামো ও পরিশেষে রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রমাণ বহন করে।
বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক দিক হলো তা রাজনীতি-সচেতন নাগরিক তৈরি করেনি, তৈরি করেছে অন্ধ সমর্থক গোষ্ঠী। রাজনীতি এখানে দলীয় অনুসারীদের চোখে এমন এক চশমা লাগিয়ে দেয় যে তখন সমর্থনকৃত দলের অন্ধকার আর বিরোধী দলের আলো দেখা যায় না। কেউ বিএনপি করে তার মানে, সে কস্মিনকালেও বিএনপির কোনো দোষ আর আওয়ামী লীগের কোনো গুণ দেখতে পায় না। আবার কেউ যদি আওয়ামী লীগ করে তবে কিয়ামত পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কোনো মন্দ এবং বিএনপির কোনো ভালো তার চোখে পড়বে না। আমাদের অসুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির দুষ্টচক্র নাগরিকদের এখানে দেশপ্রেমিক বানাতে চেষ্টা করেনি বরং বানিয়েছে কেবল দলকানা, দলদাস ও নব্য ক্রীতদাস। এখানে মানুষের ইতিহাস গোলামির ইতিহাস, রাজনৈতিক শক্তিগুলো গোলাম বানিয়ে রেখেছে জনগণকে। এখানে রাজনৈতিক ভক্তিবাদ একই সঙ্গে অন্ধ ও হাস্যকর। নৌকা, ধানের শীষ, লাঙল, দাঁড়িপাল্লায় ভক্তি দেখাতে গিয়ে ন্যায়কে ন্যায় ও অন্যায়কে অন্যায় বলার ক্ষমতা এখানে লোপ পায়; সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার সৎসাহস হারায় মানুষ!
তবে জুলাই বিপ্লবে মানুষ জেগে উঠেছে। গোটা দেশ এখন তাকিয়ে আছে অন্তর্বর্তী সরকারের দিকে। অস্বীকার, বিষোদগার ও বিভক্তির অসুস্থ রাজনীতির অবসান চান সবাই। তবে কন্যার অপরাধের কারণে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভূমিকা অগ্রাহ্য বা অস্বীকার করার সুযোগ আছে কি? শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির জনক মনে করে কি না এই সরকার--সম্প্রতি এমন প্রশ্নের জবাবে সরকারের জনৈক উপদেষ্টা বলেছেন, ‘অবশ্যই না’। এতো জীবনসংহারী গণ-অভ্যুত্থানের পরে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জাতির জন আকাঙ্ক্ষা অনেক। তাদের কণ্ঠে রাজনৈতিক সরকারগুলোর মতো অস্বীকারের সুর কাম্য নয়। আমাদের মুক্তির স্বপ্ন বারবার ছিনতাই হয়েছে, আর যেনো না হয়।
লেখক: কবি ও সংস্কৃতিকর্মী