রাজনৈতিক অস্থিরতায় খাবি খাচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। দফায় দফায় হরতাল-অবরোধে প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কয়েক সপ্তাহ ধরেই এক প্রকার অচলাবস্থা দৃশ্যমান। স্কুল, মাদরাসা, কলেজ যার যার মতো শিক্ষাকার্যক্রম টেনে নেয়ার চেষ্টা করলেও তাতে বড় ফাঁক থেকে যাচ্ছে। বড় ধাক্কা লেগেছে ঢাকাসহ বড় চার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। সপ্তাহের ৫ দিনের নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত শিক্ষাব্যবস্থা সর্বোচ্চ ২ বা ৩ দিনের মধ্যে এসে ঠেকেছে। শিক্ষার সার্বিক চিত্র হয়ে পড়েছে বিবর্ণ। এমন বাস্তবতাতেও আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। তাই সরকারি ও এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের কর্মস্থলে উপস্থিত থাকতে হচ্ছে সপ্তাহের সাতদিনই। যদিও হরতাল-অবরোধের অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে তাদের অনেকেই জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন। আর বার্ষিক পরীক্ষা ও নতুন কারিকুলামের মূল্যায়ন সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন প্রতিষ্ঠান প্রধানরা।
জানা গেছে, গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয় তারপর থেকে এখন পর্যন্ত ২২ কর্মদিবসের মধ্যে ১৯ দিনই পড়েছে হরতাল বা অবরোধের খাঁড়ায়। বর্তমানে ষষ্ঠ দফায় অবরোধ চলছে বিএনপির। প্রথম কর্মসূচিটি ৭২ ঘণ্টার হলেও পরের প্রতিটি কর্মসূচি দেয়া হয়েছে ৪৮ ঘণ্টার। ফলে রবি-সোম ও বুধ-বৃহস্পতিবার দেশজুড়ে এক ধরনের অচলাবস্থা বিরাজ করছে। মাঝখানে মঙ্গলবার বিরতি থাকলেও যানজটে মুশকিল হচ্ছে চলাফেরা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে খবর নিয়ে জানা গেছে, আগের নির্ধারিত ছুটি শুক্র ও শনিবার এবং অবরোধের মাঝে ক্ষান্তি দেয়া মঙ্গল-এই ৩ দিনেই শিক্ষাকার্যক্রম যতটা সম্ভব টেনে নিয়ে যাচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। আবার অনেকেই অনলাইনে ক্লাস বা পরীক্ষা নেয়ার চেষ্টা করছে। অনলাইনে যুক্ত হচ্ছেন না অথবা হতে পারছেন না সব শিক্ষার্থী। ফলে বড় গলদ থেকে যাচ্ছে শিক্ষার মধ্যে।
অনুসন্ধান বলছে, ঢাকার নামকরা কলেজগুলোরও মধ্যে ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ এবং উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এন্ড কলেজ সাপ্তাহিক বন্ধের দিন শুক্র ও শনিবার বার্ষিক পরীক্ষা নিচ্ছে। অন্যদিকে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ আগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রবি ও সোমবারই পরীক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ক্লাস অব্যাহত রেখেছে নটরডেম কলেজসহ উচ্চ মাধ্যমিকের অনেক প্রতিষ্ঠান। এসব কলেজের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষরা গণমাধ্যমের কাছে আগামী ৩০ নভেম্বর মাউশি অধিদপ্তরের বেঁধে দেয়া সময়ে পরীক্ষা নেয়ার বাধ্যবাধকতার কথা বলেছেন। মাউশির পক্ষ থেকেও এ নির্দেশনা অব্যাহত রাখার কথা বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের বেশিরভাগ স্কুলে নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়ন ও বার্ষিক পরীক্ষা আয়োজনে তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি। শিক্ষার্থীরা স্বতস্ফূর্তভাবে মূল্যায়ন ও বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। অনেক স্কুলে মূল্যায়ন প্রক্রিয়া শেষের দিকে। এ পরিস্থিতিতে আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে মূল্যায়ন ও বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করার নির্দেশনা বহাল আছে। তবে রাজধানী ঢাকার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বলছে তাদের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তারাও শুক্র-শনিবার পরীক্ষা নিয়ে মূল্যায়ন ও বার্ষিক পরীক্ষা ৩০ নভেম্বরের মধ্যেই শেষ করতে পারবে বলে আশা করছি।
অবশ্য শিক্ষাবিদরা মনে করেন, এভাবে ফাঁকে ফাঁকে ক্লাস, অনলাইনে ক্লাস, অথবা এক ধরনের বাধ্য করে ক্লাস বা পরীক্ষায় নেয়ায়, আর যাই হোক মানসম্মত শিক্ষাটা হয় না। ফলে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কোপ পড়ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। হরতাল অবরোধের মধ্যে ক্লাস বা পরীক্ষা নেয়ার বিড়ম্বনা বা মানসিক চাপে পড়েছেন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে অভিভাবকরা বলছে, জোর করে ক্লাস বা পরীক্ষা নেয়া ও দেয়ার জন্য তারা তাদের সন্তান নিয়ে গভীর উদ্বেগের মধ্যে পড়েছেন। অবশ্য কারো কারো মতে, যেভাবেই হোক পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ায়ৎ মঙ্গলজনক। কারণ সামনে আরো কী সময় অপেক্ষা করছে-তা কেউ-ই জানেন না। দেশের রাজনৈতিক এই পরিস্থিতি ও কর্মসূচির প্রতিও তীব্র ক্ষোভ ঝাড়ছেন তারা।
স্কুল ও কলেজে এমন নানা বাস্তবতার মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কয়েকদফা তাদের সব পরীক্ষা অনিবার্যকারণে স্থগিত ঘোষণা করে। ৪৮ ঘণ্টার হরতালের কারণে গত ১৯ ও ২০ নভেম্বরের পরীক্ষা স্থগিত করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দফতরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। বলা হয়, স্থগিত এসব পরীক্ষার সংশোধিত তারিখ সংশ্লিষ্ট সবাইকে পরবর্তীতে জানানো হবে।
বিএনপি ও জামায়াতের ডাকা অবরোধের প্রভাব পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রমেও। টানা অবরোধের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগই বিভিন্ন বর্ষের পূর্ব নির্ধারিত পরীক্ষা স্থগিত করেছে। আবার অনেক বিভাগ ক্লাস চালু রাখার কথা জানালেও তা চলছে ঢিমেতালে। বাস্তবতা হচ্ছে, যেসব বিভাগে ক্লাস চলছে সেগুলোতেও উপস্থিতি স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কম। এর মধ্যে ছাত্রদল বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশকয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয়। ক্যাম্পাসে কয়েকদফা ককটেল বিস্ফোরনের ঘটনায় উত্তেজনা ছড়ায়। এ ঘটনার জন্য ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ একে অপরকে দায়ি করলেও সাধারণ শিক্ষার্থীরা হলে সময় কাটাচ্ছেন উদ্বেগে, আর তাদের অভিভাবক আছেন উৎকন্ঠায়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমে ক্লাস পরীক্ষা স্থগিত না করে আলাদাভাবে বিভাগগুলোকে সিদ্ধান্ত নিতে বলে। অবশ্য পরে অনেকগুলো বিভাগ বিভিন্ন বর্ষের চুড়ান্ত পরীক্ষা স্থগিত করে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অবরোধের মধ্যে ছাত্রদল কয়েকদফা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেয়। একই অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও। সেখানেও ছাত্রদল ক্লাস ও পরীক্ষা গ্রহণে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরির চেষ্টা করছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কখনো কখনো পরীক্ষা স্থগিত করলেও সেখানে ক্লাস নেয়ার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়।
এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে এখন অবধি যে ১৯ দিন হরতাল-অবরোধ ছিলো তাতে স্থগিত হওয়া পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষাপঞ্জিতে জট লাগবেই। বিভিন্ন বিভাগের বহু শিক্ষক সরাসরি শিক্ষক রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকায় পরীক্ষা গ্রহণের মতো সিদ্ধান্ত অনেকক্ষেত্রেই স্কুল-কলেজের মতো করে নেয়া সম্ভব হয় না। শিক্ষার্থীরাও এমন পরিস্থিতির মধ্যে পরীক্ষা না নিতে শিক্ষকদের অনুরোধ করে। ফলে জোর করে হলেও হরতাল বা অবরোধের অভিঘাত এড়ানো সম্ভব হয়ে ওঠে না।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।