শিক্ষা হলো আচরণের ইতিবাচক স্থায়ী পরিবর্তন যার উদ্দেশ্য হলো-শিক্ষার্থীর উত্তম চরিত্র গঠন ও সত্যের লালন। শুধু জ্ঞানের পরিপূর্ণতা নয়, জ্ঞানার্জনের পর তা কার্যকর ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগই হলো শিক্ষা। পাঠ্যবিষয়ের বাইরে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের আলোকে শিক্ষার্থীর আচরণ নিয়ন্ত্রণে শিক্ষকবৃন্দ ভূমিকা রাখতে পারেন। শিক্ষকের বিচক্ষণতায় সব কিছু ভুলিয়ে দিয়ে ভাবতে শেখায় নতুন কিছু, যা বাঞ্ছিত, মার্জিত ও ইতিবাচক। এটা পরিবার ও সমাজের দীর্ঘদিনের লালিত সংস্কারেও আঘাত হানতে পারে। দ্বিতীয় পিতা হিসেবে সন্তানকে উত্তমরূপে নিয়মকানুন, আদবকায়দা, শিষ্টাচার, বিনয়, নম্রতা, নিয়মানুবর্তিতা, দয়া, সহানুভূতি ইত্যাদি শিক্ষা দিয়ে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। একটি প্রদীপ থেকে যেমন কোটি কোটি প্রদীপ জ্বালানো যায়, ঠিক তেমনি একজন শিক্ষকের মাধ্যমে গোটা জাতিকে আলোকিত করা যায়। তিনি শিক্ষার্থীর দেহ-মনে যে আলো জ্বালিয়ে দেন, ক্রমে সে আলোয় উদ্ভাসিত হয় প্রতিটি পরিবার, জনপদসহ গোটা বিশ্ব। একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষকের আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী হিসেবে সামাজিক সচেতনতা, সংহতি এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় রাখার চেতনায় জাগ্রত হয়। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলে মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক, পরিবেশের সংকট দূর করে শোষণমুক্ত, নিরপেক্ষ ও আদর্শ সমাজ গঠন করতে পারেন একজন কৌশলী শিক্ষক। ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ, অর্থনৈতিক স্তর ইত্যাদির ভিত্তিতে নিরপেক্ষ এবং বৈষম্যহীন চিন্তায় বিকশিত করাতে পারলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমতা ও সহাবস্থানের চেতনা গড়ে উঠবে।
শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার মাধ্যমে একটি জাতির অবলুপ্তি ঘটতে পারে। নিষ্ঠুর বাস্তবতা হলো, আমরা সেদিকে দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষকের প্রতি রাষ্ট্র ও সমাজের অনাদর, অবহেলার ফলস্বরূপ আমরা একটি বিকলাঙ্গ এবং মানসিক বিকারগ্রস্ত জাতি পেতে যাচ্ছি। হারিয়ে যাচ্ছে মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক আচার, সহিষ্ণুতা ও শিষ্টাচার। উচ্ছৃঙ্খল শিক্ষার্থীকে বিদ্যমান বিধি-নিষেধ এবং আইন-শৃঙ্খলার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তারা চড়াও হচ্ছে পিতৃতুল্য শিক্ষকের ওপর। ক্ষেত্র বিশেষে বাধ্য হয়ে কখনো নৈতিক শাসন করতে গিয়ে চুন থেকে পান খসলেই অভিভাবকরা শিক্ষকমণ্ডলীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও হয়রানি করার প্রয়াস পাচ্ছে। এ সুযোগে প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি/গভর্নিং বডিতে ঘাঁপটি মেরে বসে থাকা অযোগ্য ও অসৎ শিক্ষকবিদ্বেষী ব্যক্তিরাও অভিভাবকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
এর সঙ্গে রাজনৈতিক বড় ভাই, গ্যাংস্টারদের হুমকি-ধমকি এবং পক্ষপাতমূলক হলুদ সাংবাদিকদের বিড়ম্বনা তো আছেই! রাজনীতিবীদ, সমাজ সংস্কারক, প্রশাসনের সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেন যে, শিক্ষকতা মহান পেশা, শিক্ষাই জাতীর মেরুদণ্ড বা শিক্ষকরাই সমাজ সংস্কার করে শিক্ষার্থীদের যথাযথ শিক্ষাদান করে দেশকে এগিয়ে নেবেন। কিন্তু রাষ্ট্র, রাজনীতিবিদ, প্রশাসন কি শিক্ষকদের যথাযথ মূল্যায়নে তৎপর ? শিক্ষকদের পেটে নেই ভাত, সংসার চালাতে হিমশিম খান। শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে সুন্দর সুন্দর নীতিবাক্য প্রদান করলেও রাষ্ট্র বা সমাজে তাদের যথাযথ মূল্যায়নের অভাব রয়েছে। সমাজ গঠনে অনেক সময় শিক্ষককে শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে কঠোরতা অবলম্বন করতে হতে পারে। সরকার, প্রশাসন ও রাজনীতিবিদদের বিপক্ষে কথা বলতে হতে পারে। সমাজ ব্যবস্থা এখন উগ্রতায় ভরা। শিক্ষককে কে দেবে যথাযথ নিরাপত্তা? বরং দেখা যায়, নানান বিধি-নিষেধের মাধ্যমে তাদের কন্ঠ রোধ করা হয়। শিক্ষককে কেউ সম্মান দিতে চায় না, নীতিবাক্য শোনালে শিক্ষকদের সেকেলে হিসেবে অবজ্ঞা ও অবমূল্যায়ন করা হয়। তাই একান্ত বাধ্য হয়েই আত্মসম্মান বাঁচাতে সৎ, যোগ্য, আদর্শবান এবং নীতিবান শিক্ষকরা নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন। একান্ত পেটের দায়ে তারা অসহায়ের মতো দিন পার করেন। এ অবস্থায় আত্মসম্মান ও মর্যাদাবোধসম্পন্ন শিক্ষিত এবং যোগ্য ব্যক্তিরা শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহ হারাচ্ছেন। ফলে, জাতি এগিয়ে যাচ্ছে অনিবার্য ধ্বংসের দিকে।রাজনীতিবিদ, প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নই শিক্ষককে মর্যাদার আসনে বসাতে পারে, তাহলে সমাজও নড়েচড়ে বসে তাদেরকে সম্মানিত ও মূল্যায়িত করবে। শিক্ষক তার হারানো মর্যাদা ফিরে পেলে উদার মানসিকতায় বিলিয়ে দিতে পারবে শিক্ষা ও নৈতিকতার আলো। তবেই আমরা পাবো শিক্ষিত, উদার, দুর্নীতিমুক্ত স্বচ্ছ সমাজ। শিক্ষক তার হৃদয়ের অমলিন আনন্দ, আত্মবিশ্বাস, বিষয়ভিত্তিক অর্জিত জ্ঞান, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, পেশাগত দক্ষতা, আকর্ষণীয় বাকশৈলীর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত, উৎসাহিত, উজ্জীবিত করে সাহস জুগিয়ে সম্মুখপানে এগিয়ে যাবার দীক্ষা দেবেন। অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার নিরন্তর চেষ্টা করবেন। তিনিই শিক্ষার্থীদের অনুকরণীয়-বরণীয় ও পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করবেন। শিক্ষক সমাজ ও সভ্যতার অভিভাবক।
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেছেন- ‘যে দেশে গুণের সমাদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না’। তারা সমাজ গঠনে এগিয়ে আসার সুযোগ না পেলে সমাজের ধ্বংস অনিবার্য। রাষ্ট্রকে শিক্ষক সমাজের পদদলিত মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তাহলেই শিক্ষা, নৈতিকতা এবং সমাজ গঠনে শিক্ষকবৃন্দ অনবদ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবেন। আর এটাই বিশ্ব শিক্ষক দিবসের সার্থকতা বহন করবে।
শিক্ষক তার হৃদয়ের অমলিন আনন্দ, আত্মবিশ্বাস, বিষয়ভিত্তিক অর্জিত জ্ঞান, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, পেশাগত দক্ষতা, আকর্ষণীয় বাকশৈলীর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত, উৎসাহিত ও উজ্জীবিত করে সাহস জুগিয়ে সম্মুখপানে এগিয়ে যাবার দীক্ষা দেবেন। অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবার নিরন্তর চেষ্টা করবেন। তিনি শিক্ষার্থীদের অনুকরণীয়-বরণীয় ও পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করবেন। অতএব, রাষ্ট্রকেই শিক্ষক সমাজের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তাহলে ঢাকঢোল পিটিয়ে বছরে একদিন শিক্ষক দিবস পালনের প্রশ্ন আসবে না বরং প্রতিদিনই হয়ে উঠবে ‘শিক্ষক দিবস’। মনে রাখতে হবে, শিক্ষকই সমাজ ও সভ্যতার অভিভাবক। তারা দেশ ও জাতীয় উন্নয়নের থিঙ্কট্যাংক হিসেবে অনবদ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম। একজন আদর্শবান শিক্ষকের পক্ষেই মানবিক ও নৈতিকতার বীজ বপন করা সম্ভব।
লেখক: প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি ফুলতলা মহিলা কলেজ, খুলনা