ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হতে আবেদন করেছে ময়মনসিংহের ছোরতন নেছা নার্সিং কলেজ। তবে সরেজমিন গিয়ে আবেদনপত্রের তথ্যে গরমিল পায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শন কমিটি। এরপর ওই কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধেই ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ তোলে কলেজ কর্তৃপক্ষ। তবে এর কোনো প্রমাণ না থাকায় বিপাকে পড়ে ক্ষমা চান কলেজের চেয়ারম্যান ফজলুল হক। তারও আগে শিক্ষার্থী ভর্তি করে তাদের নিবন্ধনের আদেশ চেয়ে আদালতে রিট করেছিলেন তিনি। সেটিও টেকেনি। এত কিছুর পরও অযোগ্য এ কলেজকে অনুমোদন দিতে চলছে তোড়জোড়। তদবির করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন মহল। নতুন কমিটি দিয়ে করানো হয়েছে দ্বিতীয় দফা পরিদর্শন। ছোরতন নেছা কলেজকে অনুমোদন দিতে খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট নথি পর্যালোচনা ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির জন্য আবেদন করে ময়মনসিংহের ছোরতন নেছা নার্সিং কলেজ। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারির শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, অনুমোদনের আগে ওই কলেজে কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি করা যাবে না। যদিও নিয়ম না মেনে এর আগেই শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে আরও জানা যায়, চলতি বছরের ৯ জুন ওই কলেজ ফের পরিদর্শন করেছে পরিদর্শন কমিটি। তবে পরিদর্শনের আগে পূর্বের পরিদর্শন কমিটির অনেক সদস্যকে সরিয়ে নতুন সদস্য যোগ করা হয়েছে। এবারের পরিদর্শনেও সন্তুষ্ট নন পরিদর্শন কমিটির সদস্যরা। কলেজ অধিভুক্তির আবেদনের তথ্য ও সরেজমিন তথ্যের মধ্যে গরমিল পাওয়া গেছে। পরিদর্শনের সময় অন্য কলেজের শিক্ষকদের ভাড়া করে নিজেদের শিক্ষক বলে দাবি করা হয়েছে। মালপত্র ক্রয়, গ্রন্থাগারের বই কেনার ভাউচার দেখাতে পারেনি কলেজ কর্তৃপক্ষ। একাডেমিক ভবনের ভাড়া চুক্তির মূল কপিও পাওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিদর্শন কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ন করে কখনোই এ ধরনের মানহীন প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেওয়া উচিত নয়। দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য এবং সুনাম ক্ষুণ্ন হবে। ঊর্ধ্বতন মহলের চাপ থাকায় উপাচার্য সবসময় অধিভুক্তি দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। কোনো কলেজের অধিভুক্তি দিতে হলে উপাচার্য গঠিত পরিদর্শন কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে দেওয়া হয়।’
ঢাবির চিকিৎসা অনুষদের ডিন ডা. শাহরিয়ার নবী বলেন, ‘আমরা কদিন আগে পরিদর্শন করে আসছি। তবে প্রতিবেদন এখনো জমা দিইনি।’ দ্বিতীয়বার পরিদর্শনে পরিদর্শক কমিটি সন্তুষ্ট কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা এটি পরিদর্শন রিপোর্টে বলব। এখন বলতে চাই না।’ এদিকে ছোরতন নেছা নার্সিং কলেজের অনুমোদন নিশ্চিত করতে কোনো একটি পক্ষ আর্থিক সুবিধা নিয়েছে বলে ধারণা করছেন ঢাবি শিক্ষকরা। তাদের দাবি, সুবিধাভোগী ওই পক্ষটি পরিদর্শন কমিটির সদস্যদের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করছে।
তবে কলেজ পরিদর্শক মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের ওপরে এ বিষয়ে কোনো চাপ নেই। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আমরা কলেজটি পরিদর্শন করেছি। যথাসময়ে পরিদর্শন রিপোর্ট কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করব।’
ঢাবির এক শিক্ষক বলেন, যেহেতু কলেজ কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ করেছে, সেজন্য নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি করে আগে এই বিষয়টি ফায়সালা করা উচিত। তার আগে কলেজের অনুমোদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ যদি অবৈধ টাকা নেওয়ার সঙ্গে জড়িত থাকে, তাহলে তার বিচার হওয়া উচিত। আর যদি মিথ্যা হয়, তাহলে যারা এমন অভিযোগ এনেছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এদিকে ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান ছোরতন নেছা কলেজের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কলেজটিতে প্রতারণার শিকার হয়ে কিছু শিক্ষার্থী উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন; কিন্তু কলেজটি এখনো ঢাবির অধিভুক্ত না হওয়ায় তিনি সেই সুযোগ দেননি। প্রতারিত শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ঢাবিতে অধিভুক্তির প্রলোভন এবং বিএসসি ইন নার্সিংয়ে আগে ভর্তি হওয়া ব্যাচ দেখিয়ে তাদের ভর্তিতে প্রলুব্ধ করেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ; কিন্তু ভর্তির পর শিক্ষার্থীরা এই প্রতারণার প্রতিবাদ করলে তাদের ওপর চলে মানসিক নির্যাতন। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ওই কলেজটিতে ভর্তি হয়েছিল ১১ শিক্ষার্থী। ভর্তির সময় তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করা হয়। ওই ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ভাষ্য, ওই কলেজের চেয়ারম্যানের তিন স্ত্রীর মধ্যে দ্বিতীয় স্ত্রী কলেজের কম্পিউটার রুমে থাকেন। তিন রুমবিশিষ্ট কমনরুমে কলেজের চেয়ারম্যান, তৃতীয় স্ত্রী, স্ত্রীর ভাই ও কয়েকজন নারী শিক্ষার্থী থাকেন। এ ছাড়া ওই কলেজে কোনো শিক্ষক নেই। ওই কলেজের যারা নার্সিংয়ে ডিপ্লোমা করেন, তারাই বিএসসি ইন নার্সিং শিক্ষার্থীদের পড়ান। কলেজের দারোয়ানের দায়িত্ব থেকে শুরু করে অনেক কাজ শিক্ষার্থীদের দিয়ে করানো হয়। কিংশুক ধর নামে প্রতারণার শিকার এক শিক্ষার্থী বলেন, ভর্তি ও এক সেমিস্টার ফি বাবদ জনপ্রতি ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ; কিন্তু তারা এখন টাকা ফেরত দিচ্ছে না। এমনকি নার্সিং স্টুডেন্টদের রেজিস্ট্রেশনের সময় শেষ হয়ে গেলেও শিক্ষার্থীদের জানানো হয়নি। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে ভিন্ন জরিমানা দিয়ে কলেজের নামে রেজিস্ট্রেশন করে দেওয়া হবে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। তবে শিক্ষার্থীরা এতে রাজি হয়নি। পরে অন্য কলেজে চলে যেতে চাইলেও কাগজপত্র ফেরত দিতে অনীহা প্রকাশ করে। রেজিস্ট্রেশন শেষ হওয়ার দুই দিন আগে ছেলেদের কাগজপত্র ফেরত দিলেও মেয়েদের দিতে রাজি হয়নি। পরে মেয়েরা আন্দোলন শুরু করলে তাদেরও কাগজপত্র দেওয়া হয়।’ এদিকে এখন পর্যন্ত ঢাবির অধিভুক্ত না হলেও ছোরতন নেছা কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি থামেনি। চলতি বছরের ২৯ মে ও ১ জুন ওই কলেজের ফেসবুক পেজে বিএসসি ইন নার্সিং ও ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কোর্সে ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়।
পরিচয় গোপন করে এ প্রতিবেদক ফেসবুক পেজে ব্যবহার করা নম্বরে ফোন দিলে তোফায়েল নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমাদের কলেজ হয়েছে আরও দুই বছর আগে; কিন্তু ঢাবি অধিভুক্তি নিয়ে আমাদের একটু সমস্যা ছিল। এটি দু-চার দিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। পরে আমরা ভর্তি করতে পারব।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কলেজের চেয়ারম্যান মো. ফজলুল হক বলেন, ‘এটি আপনার কাছে যাওয়ার কথা নয়। বিষয়টি কোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। কাজেই এ ব্যাপারে কথা না বলাই ভালো। এর মধ্যে আপনার জড়ানোর দরকার নেই। একদম চেপে যান। আমি আইনজীবী মানুষ, আমি আইন বুঝি। এখানে অনেক ব্যাপার আছে, আপনি বুঝবেন না।’ এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কারও দ্বারা প্রভাবিত হবে না। যারা পরিদর্শনে যান, কারও দ্বারা তাদের প্রভাবিত হওয়ার সুযোগ নেই। তাদের চারিত্রিক দৃঢ়তা খুবই শক্ত। তাদের কেউ প্রভাবিত হওয়ার মতো নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি আন্তরিকভাবে কলেজটির পক্ষে চেষ্টা করেছিলাম। ওরা (কলেজ কর্তৃপক্ষ) প্রথমদিকে অসৎ পথ ধরেছিল। ওদের আমি বকাঝকা করেছি। পরে দ্বিতীবার পরিদর্শন করিয়েছি; কিন্তু পরেরবার তারা এসে বললেন, আগের চেয়ে এবার অবস্থা আরও ভয়াবহ।’ তিনি বলেন, ‘কলেজটিকে অনুমোদন দিতে পারলে আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম। আমি যদি এটির পক্ষে একজন মানুষকেও পেতাম, তাহলেও করে ফেলতাম; কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো একটি নির্দিষ্ট মানের নিচে নামবে না।’