দেশের সব আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে দেখা গেছে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগকে। বর্তমান সময়ের জাতীয় রাজনীতিবিদদের মধ্যে অনেকের হাতেখড়ি হয়েছিল এ কলেজ থেকেই। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা কলেজ ইউনিটের কমিটি গঠনে বরাবরই পিছু হটেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। সাত বছর আগে হয়েছিল সর্বশেষ আহ্বায়ক কমিটি। আর দীর্ঘদিন কমিটি না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা যেমন রাজনীতিবিমুখ হচ্ছেন, তেমনি হতাশায় ভুগছেন কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
তাদের ভাষ্য, এভাবে চলতে থাকলে ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের অবস্থান হারাতে হবে। তৈরি হবে নেতাকর্মী সংকট। আর ছাত্রলীগ অস্তিত্ব হারালে সেখানে শুরু হবে স্বাধীনতাবিরোধীদের কার্যক্রম। কমিটি ছাড়া এমন ছন্নছাড়া পরিস্থিতিতে নতুন করে আর কোনো শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হবে না।
প্রায় সাত বছর হলো ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনটি কমিটি হয়। এর মধ্যে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি হয় এবং ২০১১ ও ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে একটি করে আহ্বায়ক কমিটি হয়। এই তিন কমিটির মধ্যে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের কমিটিটি ওই বছরের অক্টোবরে কমিটি গঠন করে নভেম্বরেই ভেঙে দেওয়া হয়। তখন দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে ফারুক নামের এক কলেজছাত্র নিহত হন। এর জেরে কেন্দ্র থেকে কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। পরের গঠন করা আহ্বায়ক কমিটিও বেশিদিন টিকেনি। পরে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে ১২৭ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। পরে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতেই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার কারণে আবারো কেন্দ্র থেকে এ কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় নেতারা। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাস থেকে আক্ষরিক অর্থে ঢাকা কলেজের কোনো কমিটি নেই।
দীর্ঘদিন কমিটি না থাকার ফলে নানা রকম অনিয়ম ও বিশৃঙ্খল ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। সর্বশেষ গত বছর বেশ কয়েকটি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে একটি হলো ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। দোকান কর্মচারী ও ছাত্রদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘটিত এই সংঘর্ষে দুই পক্ষেই বেশ কিছু লোক আহত হন এবং দুজন নিহত হন। একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে কলেজের দুই গ্রুপ ছাত্রের মধ্যে আরেকটি সংঘর্ষ হয়, এতে একাধিক ছাত্রকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। আবার এ বছরের মার্চ মাসে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতেও হতাহত হয় কয়েকজন। সারা বছর এরকম ছোট-বড় সংঘর্ষের ঘটনা লেগেই থাকে। কখনো সেটি নিজেদের মধ্যে কখনো বাইরের লোকজন বা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এসব সংঘর্ষ হয়। তাৎক্ষণিকভাবে শিক্ষকরা এসব মীমাংসা করলেও মাঝেমধ্যে ছাত্রনেতাদের ভূমিকার অনুপস্থিতি টের পাওয়া যায় প্রকটভাবে। অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা কলেজের কমিটি ভেঙে যাওয়ার অন্যতম কারণ অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষ। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের একাধিক গ্রুপের মধ্যে নানা কারণে মূলত সংঘর্ষ হয়।
দীর্ঘদিন ঢাকা কলেজের কমিটি না হওয়ায় অনেকেই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগের রাজনীতি ছেড়েছেন। কেউবা মনোকষ্টে রাজনীতিবিমুখ হয়ে চাকরি নিয়ে বিয়ে করে সংসারী হয়েছেন। এর বাইরেও শত শত কর্মী রয়েছেন যারা ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িয়ে দিন-রাত পরিশ্রম করে রাজপথে সরব আছেন কমিটির আশায়।
ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থেকে মনঃকষ্টে রাজনীতি ছেড়েছেন এমন সংখ্যাও কম নয়। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সহসম্পাদক জালাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘আমি প্রায় এক যুগ ঢাকা কলেজের রাজনীতি করেছি। কিন্তু কমিটি না হওয়ায় কোনো পদ পাইনি। কমিটি নির্ধারিত সময়ে না হওয়ার কারণে অনেক মেধাবী নেতৃত্ব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ফলে ঢাকা কলেজে ছাত্র রাজনীতিতে একটি সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।’ তিনি বলেন, নিয়মিত কমিটি না হওয়ার কারণে ভেঙে যাচ্ছে রাজনীতির চেইন অব কমান্ড। ফলে ক্যাম্পাসে কিছুদিন পর পর অরাজকতা এবং বিশৃঙ্খলা তৈরি হচ্ছে। আর নিয়মিত ছাত্রলীগের কমিটি না হওয়ায় ঢাকা কলেজ থেকে নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না। সামনে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দ্রুত কমিটি করার দাবি জানান এই সাবেক ছাত্রনেতা।
ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সর্বশেষ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাকিব হাসান সুইম বলেন, ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস ভৌগোলিকভাবে এমন একটা জায়গায় অবস্থিত, যার আশেপাশে অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে দেখা যায় অনেক সময় ক্রেতাদের সঙ্গে বিক্রেতারা খারাপ ব্যবহার করে। এগুলো নিয়ে আবার কোনো না কোনোভাবে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে যায়। ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের কমিটি না থাকায় তখন বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। তিনি বলেন, ‘ইতিহাস ঐতিহ্যসহ বাংলাদেশের সব স্বাধিকার আন্দোলনে ঢাকা কলেজ সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। আমাদের দুঃখের বিষয় কমিটি না দেওয়ার কারণে এই কলেজ থেকে দীর্ঘদিন নতুন কোনো নেতৃত্ব বের হচ্ছে না। আর দীর্ঘদিন রাজনীতি করেও কমিটি না হওয়ায় অনেককে কোনো রাজনীতিক পরিচয় ছাড়াই চলে যেতে হচ্ছে। তখন তারা চাকরির দিকেও যেতে পারে না বরং মানসিক হতাশায় ভোগেন। আমার জোর দাবি, দ্রুত সময়ের মধ্যে যোগ্যদের নিয়ে কমিটি করা। না হলে এখানে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে স্থায়ী শূন্যতা তৈরি হবে।
ছাত্রলীগের কেদ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগ একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট। যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু দীর্ঘদিন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি হয় না সে বিষয়টি আমরা অবগত আছি। কীভাবে দ্রুত সময়ের মধ্যে কমিটি দেওয়া যায় সেটা নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। অতি দ্রুত সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা হবে। সম্মলনের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে যোগ্যদের মাধ্যমে কমিটি করা হবে।