গর্ভধারণের পর চিকিৎসক নিশাত আনাম বর্ণার কাছে পাঁচ-ছয় মাস চিকিৎসা নেন সৈয়দা তামান্না আখতার। চিকিৎসক তাঁকে জানিয়েছিলেন, তাঁর গর্ভে যমজ সন্তান। গত বৃহস্পতিবার তামান্নার প্রসবব্যথা শুরু হয়। চিকিৎসক নিশাতের অধীনেই তাঁকে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসক তাঁকে দ্রুত অস্ত্রোপচার কক্ষে (ওটি) নেন। সেখানে তাঁকে চেতনানাশক দিয়ে অচেতন করা হয়। ঘণ্টাখানেক পর তামান্নার পরিবারকে জানানো হয়, তাঁর পেটে কোনো সন্তানই ছিল না।
এ ঘটনা গত শুক্রবার ঘটেছে রাজশাহী নগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকার বেসরকারি রয়্যাল হাসপাতালে। তামান্না আখতার রাজশাহী নগরীর তালাইমারী এলাকার বাসিন্দা। তাঁর স্বামীর নাম মো. পিয়াস। তিনি প্রবাসী। এখন তামান্নার প্রশ্ন, তাঁর পেটের দুই যমজ সন্তান তাহলে গেল কোথায়?
এ বিষয়ে চিকিৎসক নিশাত গতকাল শনিবার বলেন, ‘ওটিতে রোগীকে পরীক্ষা করে আমার কাছে মনে হয়, তাঁর পেটে বাচ্চা নেই। পরে রোগীর স্বজনদের একটা আলট্রাসনোগ্রাম করিয়ে আনতে বলি এবং দেখি সত্যিই বাচ্চা নেই।’
চিকিৎসকের দাবি, ‘মেডিকেল টার্মে একটি বিষয় আছে, সেটা হলো
মেন্টাল প্রেগন্যান্সি। যদি রোগীর পেট ফুলে যায়, সাইকোলজিক্যালি সে প্রেগন্যান্ট ভাবতে শুরু করে। তার মনে হয়, বাচ্চা নড়ছে, সে প্রেগন্যান্ট। এই রোগীর ক্ষেত্রে এমন ঘটনাই ঘটেছে।’
পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার দুপুরে তামান্না আখতারের প্রসবব্যথা উঠলে রয়্যাল হাসপাতালে নেওয়া হয়। বেলা ৩টার দিকে তাঁকে ওটিতে নেওয়া হয়। সন্ধ্যায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, তামান্নার পেটে কোনো বাচ্চা নেই। তখন বাচ্চা চুরির অভিযোগ তুলে হাসপাতালটিতে হট্টগোল শুরু করেন তামান্নার স্বজনেরা। তখন হাসপাতালে যায় পুলিশ। এ সময় হাসপাতালের ওটিতে এক বোতল মদ পাওয়া যায়। তবে পুলিশ এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
তামান্নাকে অচেতন করার ইনজেকশন দিয়েছিলেন রয়্যাল হাসপাতালের অ্যানেসথেটিস্ট আলী চৌধুরী রিমন। তিনি বলেন, ‘রোগীর ভাইয়ের কাছে শুনেছেন তাঁর পেটে দুটি বাচ্চা ছিল। তাঁরও মনে হয়েছে, পেটে বাচ্চা আছে। তাই তিনি অচেতন করার ইনজেকশন দেন।’
তামান্না আখতার বলেন, ‘আমি ৯ মাস ১২ দিনের অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম। এর আগেও আমি ডাক্তার দেখিয়েছি। ডাক্তার জানান, আমার পেটে দুটি বাচ্চা। আলট্রাসনোগ্রামে দেখা গেছে একটি ছেলে, একটি মেয়ে। অজ্ঞান করার ইনজেকশন দেওয়ার পর আমাকে ওটিতে নেওয়া হয়। তখন আমি বুঝতে পারলাম আমার পুরো শরীর ঝাঁকি দিচ্ছে। মনে হলো বাচ্চা টেনে বের করা হচ্ছে। এরপর আমার আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমি জানতে পারলাম, আমার পেটে নাকি কোনো বাচ্চা ছিল না। এটা কিছুতেই হতে পারে না।’
তামান্নার শাশুড়ি তাহেরা বিশ্বাস বলেন, ‘তামান্নাকে ওটিতে নিয়ে যাওয়ার পর আমরা বাচ্চার জন্য নতুন কাপড়ও নিয়ে যাই। এর কিছুক্ষণ পরই তারা সেটি ফিরিয়ে দিয়ে যায়। আমাদের বলে রোগীর প্রেশার উঠেছে, ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। এখন ঘুমাচ্ছে। প্রেশার কমলে অপারেশন করা হবে। তার কিছুক্ষণ পরই আমার মেয়ে ওটিতে গিয়ে দেখে তামান্নার পেট নেমে গেছে। আগের মতো উঁচু নেই। বাচ্চা না থাকলে পেট কমল কীভাবে?’
তামান্না আখতারের দাবি, গর্ভধারণের পর থেকে প্রতি মাসেই আলট্রাসনোগ্রাম করা হয়েছে। সবশেষ ১৪ মে আলট্রাসনোগ্রাম করা হয়। তবে ভর্তির সময় সমস্ত কাগজ এবং ফিল্ম রয়্যাল হাসপাতালে জমা দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে অবশ্য স্পষ্টভাবে কোনো বক্তব্য দেননি চিকিৎসক নিশাত আনাম। তবে সন্তান চুরির অভিযোগ অস্বীকার করে এই চিকিৎসক বলছেন, ‘কোনো রোগীকে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার পর তাঁর স্বাভাবিক সন্তান প্রসব সম্ভব নয়। কারণ, তার কোনো অনুভূতি থাকে না। সে ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার করা হয়। আর সৈয়দা তামান্না আখতারের ক্ষেত্রে তা হয়নি।’
এ বিষয়ে তামান্নার দাবি, অচেতন করলেও প্রযুক্তির সাহায্যে তাঁর পেটের সন্তান বের করে নেওয়া হয়েছে। পেটে যে সন্তান নড়াচড়া করছিল, সেই ভিডিও করে তিনি প্রবাসে থাকা স্বামীকে দিয়েছেন। এই প্রমাণ তাঁর কাছে আছে।
বিষয়টি নিয়ে রয়্যাল হাসপাতালে দায়িত্বরত কেউ কথা বলতে রাজি হননি। হাসপাতালটির মালিকপক্ষের একজন ডা. ইকবাল বারী। তাঁর ব্যক্তিগত মোবাইলে ফোন করা হলে একজন নারী ফোনটি ধরেন। তিনি জানান, ইকবাল বারী রয়্যাল হাসপাতাল নিয়ে কোনো কথা বলবেন না। হাসপাতালে দায়িত্বরত ব্যক্তিদের সঙ্গেই কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
নগরীর রাজপাড়া থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) কাজল নন্দী বলেন, ‘একটি মৌখিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। আমরা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনাস্থল পরিদর্শনও করেছি। এখন তদন্ত চলছে। এই রোগী ডা. নিশাতের কাছে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রেগন্যান্সির চিকিৎসা নেন। তারপর আর চিকিৎসা নেননি। পরে আরেকটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চিকিৎসা নেন বলে জানিয়েছেন। এই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কিছুদিন আগে আলট্রাসনোগ্রাম করিয়েছেন। আমরা ওই রিপোর্টটা সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি।’