ঢাকার একটি আদালত মৃত ব্যক্তিকে সাজা দিয়েছেন। পৃথক আরেকটি আদালত ঘটনার সময় থেকে যে ব্যক্তির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না এবং তিনি গুম হয়েছেন বলে বিভিন্ন সময় মানবাধিকার সংগঠন বিবৃতির প্রকাশ করেছে, তাকেও সাজা দিয়েছেন। তদন্ত সংস্থার ভাষ্যমতে আসামি পলাতক। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। অভিযোগ উঠেছে, মামলা চলাকালীন এক আসামি মারা গেছেন, বিচারিক আদালতকে জানানোও হয়েছে, এরপরও মৃত ব্যক্তিকে সাজা দেয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক সহিংসতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির অভিযোগে বিভিন্ন সময় মামলাগুলো করা হয়। সেই মামলাগুলোর রায় হয়েছে, যাদেরকে সাজা দেয়া হয়েছে, প্রত্যেকেই রাজনৈতিক সংগঠন বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মী।
রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা নতুন কোনো বিষয় নয়। এরশাদ সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন মামলার শিকার হন। বিএনপি ক্ষমতামলে রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের হিড়িক পড়ে গিয়েছিলো। আবার বিএনপি সরকার আমলে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা আসার পর রাজনৈতিক মামলা হিসেবে প্রত্যাহারের হিড়িক পড়ে যায়। রাষ্ট্রপক্ষের পিপি ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৪ ধারায় মামলাগুলো প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়ে থাকেন।
গুম, রাজনৈকিত সহিংসতা, হত্যা, হরতাল-অবরোধ নতুন কিছু নয়। সেই সময়ও গণমাধ্যম ছিলো এখনো আছে। সংখ্যায় বেড়েছে, সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের প্রসার ঘটেছে। বর্তমানে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সুস্থ ধারার মিডিয়ার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। সংবাদ বা খবরে তথ্য নির্ভরতা কমে গেছে এ কথা বলার সুযোগ নেই। তবে শিরোনামে চমকের ব্যবহার বাড়ছে। কৌঁসুলি সংবাদ এর ব্যবহার দিনকে দিন বাড়ছে। এই সংবাদগুলোতে সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়তই বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছেন। উদ্দেশ্যমুলক সংবাদ এর মাধ্যমে সুবিধা নিচ্ছেন এক শ্রেণির সুবিধাবাদী গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠী তেল-চিনি, আটা-ময়দা, আলু-পটলে নয় সব ক্ষেত্রেই অস্থিরতা তৈরি করে চলেছেন। তাদের কল্যাণে আমজনতা পাচ্ছেন নিত্যপণ্যের নতুন মুল্য।
যে কথা নিয়ে লেখার শুরু, সেখানে ফিরি। বলছিলাম গুমের শিকার হওয়া এবং মৃত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আদালত সাজা দিয়েছেন। এর দায়, এর ব্যর্থতার দায় শুধু আদালতের নয়। এর দায় অনেকেরই রয়েছে। তারা কারা তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি। সরাসরি বিচার বিভাগের প্রতি আঙুল তোলা হয়েছে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক সম্প্রতি বলেছেন, ১৭ কোটি মানুষের দেশে ১৭শ' বিচারক দিয়ে সুচারুভাবে বিচার কাজ পরিচালনা অসম্ভব। এটা সত্যি যে, বেশ কিছু মামলা দ্রুতগতিতে নিষ্পত্তি করে সাজা দেয়া হচ্ছে৷ অল্প সময়ে দ্রুতগতিতে অনেকগুলো মামলার নিষ্পত্তি করতে গিয়ে বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা ফুটে উঠছে। হঠাৎ করে এই মামলাগুলো বিচার করেও দ্রুত সাজা দেয়ায় জনমনে বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতার বিষয়ে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে৷ বিচার বিভাগের ওপর মানুষের যে আস্থা, এটা তার সহায়ক না৷ এটা সত্যি যে, এতোগুলো মামলা দ্রুত বিচার করার ফলে জনমনে কিছুটা সন্দেহ বা আশঙ্কার তৈরি হয়েছে এটা স্বীকার করতে হবে। তিনি প্রশ্নকর্তার প্রশ্নের রেশ ধরেই উত্তর শেষ করেছেন। অনেকটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় আসা সত্য-মিথ্যা প্রশ্নের উত্তরের মতো আর কী।
এবার রায়ের কথায় আসি। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে নাশকতার একটি মামলায় রাজধানীর নিউমার্কেট থানার মৃত বিএনপি নেতা মো. আবু তাহের দাইয়াকে সাজা দেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. আতাবউল্লাহ। পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়, অথচ চার বছর আগে নিউমার্কেট থানার ১৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক থাকাকালীন এই আসামি মারা গেছেন। অঙ্কের হিসেবে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে মারা গেছেন। প্রতিবেদনে সন তারিখের তথ্যটি কৌশলে এড়িয়ে গেছেন। আর এ কারণে আদালতকে প্রশ্ন বিদ্ধ করা সহজ হয়েছে। মামলাটি ২০১৫ খিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে নিউমার্কেট থানায় করা হয়৷ সেই মামলার এজাহার নামীয় সাত নম্বর আসামি ছিলেন আবু তাহের।
মামলার তদন্ত শেষে ওই বছরের ২১ জুলাই আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ৷ তার মানে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দেই তদন্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। তখনো আবু তাহের জীবিত ছিলেন। আইনজীবী ও তার পরিবারের ভাষ্যমতে, আবু তাহের মারা যান ২০১৯ কি ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে। এ মামলায় আবু তাহের জামিন নিয়েছিলেন কি না তা না আইনজীবী, না তার পরিবারের সদস্যরা বলেননি। জামিনে থাকলে আইনজীবীর দায়িত্ব মৃত আসামি সর্ম্পকে জানানো। আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত থানা পুলিশকে তদন্ত করে মৃত ব্যক্তি সর্ম্পকে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়ে থাকেন। এই প্রতিবেদন পাবার মামলার আসামির তালিকা থেকে মৃত ব্যক্তির নাম বাদ দিয়ে দেন আদালত। যতোক্ষণ পর্যন্ত পুলিশ মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে প্রতিবেদন দিচ্ছেন। ততোক্ষণ পর্যন্ত আদালতের নথিতে আসামি মৃত নন। বিষয়টি আমাদের সবারই জানা। তবে একজন বিচারক ও আইনজীবীর পেশাগত প্রয়োজনীয় রেকর্ড সর্ম্পকে যথাযথ জ্ঞান রাখা অপরিহার্য। আইনের ভাষ্যমতে যদি কোনো আসামি পলাতক থাকেন, তার অনুপস্থিতিতে বিচারের পদ্ধতি ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৩৯ খ (১) উপধারায় বর্ণিত রয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, পলাতক আসামি পরোয়ানা বিনা তামিল ফেরত পাবার পর ফৌজদারি কার্যবিধির ৮৭ ধারা মতে আসামিকে নির্দিষ্ট সময়ে জন্য হুলিয়া জারি করা হয়।
এরপর না হলে, ফৌজদারি কার্যবিধির ৮৮ ধারামতে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের জন্য ক্রোকি পরোয়ানা জারি করা হয়। ক্রোকি পরোয়ানা জারিতেও আসামি হাজির না হলে ৩৯৯ খ(১) উপধারায় আসামিকে হাজির হয়ে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার জন্য জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এরপর ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৯ খ(২) ধারায় বিচার আদালত বিচার শুরু করেন। আদালত একটি মামলার এজাহার বা আরজি, তদন্ত প্রতিবেদন ও পক্ষ বিপক্ষদের সাক্ষ্য প্রমাণের মাধ্যমে বিচার করে থাকেন। এখন এই মামলায় যদি কোনো নিখোঁজ বা মৃত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। তদন্ত সংস্থা তদন্ত শেষে নিখোঁজ বা মৃত ব্যক্তিকে আসামি করে প্রতিবেদন দেয়। তবে এই ভুলের দায় তদন্ত সংস্থার। আদালতের নয়। আবার আসামিপক্ষের আইনজীবী মৃত ব্যক্তির বিষয়ে লিখিত জানানোর পরও যদি থানা পুলিশ আদালতের নির্দেশের পরও মৃত ব্যক্তি বা আসামি সর্ম্পকে কোনো তদন্ত প্রতিবেদন না দেয়। তার দায় থানা পুলিশের। আদালতের নজরে থাকার পরও আইনে পুলিশ প্রতিবেদন ব্যতিত আদালতের মৃত ব্যক্তিকে হিসেবে বাদ দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি। মামলাগুলোর রায় প্রকাশের পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বা সরকারী কৌঁসুলির বক্তব্যে দৃঢ়তার অভাব ফুটে উঠেছে। রেকর্ড বা মামলার নথি সর্ম্পকে অজ্ঞতার জন্যও ততোটা বিভ্রাট ঘটেছে। যার সুযোগ কেউ না কেউ নেবেন এটাই স্বাভাবিক।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট