লেখাটি নিজেকে ভর্ৎসনা করেই শুরু করতে চাই। এ কারণেই ভর্ৎসনাটি করছি যে, এগারো বছর আগে একটি ভয়ঙ্কর কাজ করা হয়েছে শিক্ষাখাতে, যেটি আমি জানতামই না! এই না জানার কারণে নিজেই নিজেকে ভর্ৎসনা করছি, নিন্দা করছি, লজ্জা দিচ্ছি। ভয়ঙ্কর কাজটি হচ্ছে শিক্ষাক্রম থেকে অর্থাৎ পাঠ্যবই থেকে কাজী কাদের নেওয়াজ রচিত শিক্ষাগুরুর মর্যাদা কবিতাটি বাদ দেয়া হয়েছে! আরো কিছু কবিতা বাদ দেয়া হয়েছে। কবি মদন মোহন তর্কালঙ্কারের আমার পণ তৎকালীন সময় আমাদেরকে যে শিক্ষা দিয়েছে তা এখনকার ছেলে মেয়েদের কোনো কবিতা দিচ্ছে? ‘আদেশ করেন যাহা মোর গুরু জনে/ আমি যেনো সেই কাজ করি ভালো মনে।’ আমি বোধ করি এটাই ছিলো প্রকৃত শিক্ষা। আর উত্তরাধুনিক যুগে শিক্ষার্থীদের আদেশ দিলে তা ভালো চোখে দেখা হয় না, শিক্ষকের সমালোচনা শুরু হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। অমানবিকতার ট্যাগ দেয়া হয় শিক্ষকদের ওপর।
একটি কথা চালু ছিলো আমাদের সময়কালে। শিক্ষক বা গুরুজন যে জায়গায় বেত্রাঘাত করবেন, মারবেন; সেই জায়গা জান্নাত বা স্বর্গে যাবে। আমরা তেমনই এক শিক্ষা পেয়ে বড় হয়েছি। আমাদের সময় বলতে এখানে সর্বশেষ নব্বই দশক কিংবা একবিংশ শতাব্দির একদম গোড়ার দিকের সময়ের কথা বুঝাতে চেয়েছি। তখন শিক্ষা পদ্ধতিতে আদবের শিক্ষা ছিলো, নীতি নৈতিকতার শিক্ষা ছিলো। বিদ্যা শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য অর্থ উপার্জন ছিলো না, আচার-আচরণ, ব্যবহার ভালো করার শিক্ষা ছিলো পাঠ আলোচনায়। সততা, মানবিকতা, চমৎকার শিশু শিক্ষা, দেশপ্রেম ছিলো প্রতিটি শ্রেণির অধিকাংশ অধ্যায়ে। শিক্ষার্থীরা এসব পড়তেন, অন্তরে ধারণ করতেন এবং শিক্ষক, অভিভাবক ও বড়দের সম্মান করতেন। ছোটদের স্নেহ করা শিখতেন স্কুল পর্যায় থেকে। পরিবার থেকে তখনকার উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েরা আদব-কায়দার শিক্ষা পেতেন। শিক্ষক যে পিতৃতুল্য, মান্যবর, পথপ্রদর্শক এবং একজন উপদেষ্টা এই শিক্ষাটা ছিলো পরিবারিক শিক্ষার একক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পিতার আগেও শিক্ষকের স্থান ছিলো। সিলেট অঞ্চলে গ্রামীণ একটি প্রবাদ চালু আছে। ‘মা-বাবায় জন্মান ভূত, আর শিক্ষকে বানায় পুত (পুত্র)’। এতে বুঝা যায়, বর্তমানের তুলনায় পূর্বের যেকোনো সময়ে শিক্ষকের মর্যাদা সমাজে খুব বেশি ছিলো। মাস্টার মশাইয়ের কদর ছিলো। অবশ্য এর একটা কারণও আছে। কারণটাকেই আমি এখানে বড় করে দেখতে চাই৷ পূর্বের আলোচনা থেকে যতটা বুঝা গেলো, বর্তমান সমাজে শিক্ষক বা শিক্ষকতা পেশার কোনো মর্যাদা নাই। যদি এর মানে এমনটা কেউ বুঝে থাকেন তাহলে তাকে অবশ্যই এই প্রবন্ধের শেষ পর্যন্ত আলোচনাটি পড়তে হবে এবং অবশ্যই পড়তে হবে। সমাজ, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং পারিবারিক শিক্ষার ঘাটতির অভাবে শিক্ষক বা শিক্ষকতা পেশার যতোটা না নাম বদনাম হয়েছে বা মান কমেছে ঠিক ততটা দায়ী হচ্ছেন ঘটনাক্রমে শিক্ষক বনে যাওয়া কতিপয় শিক্ষক। তাদের আচরণ, ব্যবসায়ীক মানসিকতা, মুখের ভাষার ব্যবহার ও নিজেকে সংযত রাখতে না পারার প্রবণতা থেকে অনেকাংশে এমনটা ঘটছে। ফলে এসব ঘটনার প্রভাব পড়ছে সব শিক্ষকের ওপর।
ঘটনাগুলো কী? কি ঘটছে? প্রশ্নগুলো অত্যন্ত ছোট। দু’টি সম্মিলিত শব্দ। কিন্তু এর উত্তর বিস্তর। ভাষায় বিস্তর না হলেও তাৎপর্য বা রেশ অনেক গভীরে। ইদানিং দেখছি প্রায় শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদেরকে মানতে চান না। পূর্বের মতো শিক্ষাগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি ও যথাযথ অনুজ্ঞা প্রকাশ করতে চান না। বিশেষ করে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের শাসনে আসতে চান না। যদিও এই শাসনটুকু তাদের জীবনের জন্য অতীব জরুরি তথাপি তারা তা মেনে নিতে চান না। ইতিবাচক এই শাসনটুকু কেনো মেনে নিতে চান না তার যথার্থ কারণও এখন পর্যন্ত পরিষ্কার হতে পারিনি। বিশেষ করে সম্প্রতি ছাত্র-জনতার চরম বিপ্লবের কারণে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে শাসন মানবেন তো দূরে থাক্ শিক্ষকদেরকেই মানতে চান না তারা। অল্প সংখ্যক শিক্ষার্থী আছেন যারা শিক্ষকদের সম্মান করেন, তাদের (শিক্ষকদের) কথা মেনে চলেন, শাসন করলে এটা শাসন (সংযত ও সংযমের শিক্ষা দিতে সহনীয় পর্যায়ে কঠোর আচরণ) হিসেবে গ্রহণ করেন। তবে এই সংখ্যাটি নিতান্ত সামান্য। উল্লেখ করতে গেলে সেটি হতে পারে দশ শতাংশ। এটি অনুমানের হিসাব। বেশি কম হতেই পারে। তবে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা যে কম তা নিশ্চিত করে বলতে পারি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আশা করি সম্মানিত পাঠক শ্রেণিও আমার সঙ্গে একমত হবেন।
ইদানিং শিক্ষকদের সঙ্গে যেটা ঘটছে তা একেবারেই কাম্য নয়। আমরা দেখছি, দুর্নীতি-দলকানা ইত্যাদি অভিযোগ এনে শিক্ষকদের অসম্মান করা হচ্ছে। অথচ এই শিক্ষকদের মর্যাদাগত অবস্থান সবার ওপরে। এতোদিন যেসব শিক্ষকদের কাছ থেকে তারা শিক্ষা নিয়েছে যেসব শিক্ষার্থীরাই তার পিতৃ-মাতৃতুল্য শিক্ষকের গায়ে হাত তুলছে! জোর করে পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করাচ্ছে! তার চেয়ারে বসে পড়ছে! চড় থাপ্পড় মারছে! এটা ভয়ঙ্কর অন্যায়। শিক্ষকের দোষ থাকতেই পারে। তাকে ক্ষমা করে দিন সেটা বলবো না। তার অথরিটি আছে। তার বিচার করার মতো কর্তৃপক্ষ আছে। তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট পন্থা অবলম্বন করে অভিযোগ দায়ের করা যেতে পারে। আদবের সঙ্গে তার সঙ্গে কথা বলে বলা যেতে পারে, স্যার কাল থেকে আপনি ক্লাসে আসবেন না, আমাদের সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ আছে। সেগুলোর সুষ্ঠু সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে স্কুলে আসার দরকার নাই। এভাবে এসব বলা যেতে পারে৷ আরো সুন্দর করে বলতে পারেন। কিন্তু এসব না করে রাস্তা অবরোধ করে, স্কুলের সামনে গিয়ে, শিক্ষকের রুমে গিয়ে জোর করে পদত্যাগ করিয়ে নিজের শিক্ষককে অপমান করে কতটা লাভ হচ্ছে বা হয়? আলটিমেটলি কি করতে যাচ্ছে আমাদের সোনামণিরা বলতে পারেন? এই প্রশ্ন তোলার পর কেউ কেউ হয় তো বলতে পারেন, দুর্নীতিবাজ শিক্ষকদের জন্য এতো মায়াকান্না কেনো করছি? এজন্যই করছি যে, তিনি পড়িয়েছেন। তাদের পড়িয়েছেন যারা আজ গালে গালে জুতা মারছে, আর যাকে মারছে তিনি তাদের শিক্ষক ছিলেন। বাদশা আলমগীর যে শিক্ষককে মাথার তাজ করেছিলেন সেই শিক্ষককে তারাই পায়ের জুতা বানাচ্ছে। যে শিক্ষক তাদের বুঝিয়েছেন আলো-আঁধারের পার্থক্য তার চামড়া তুলতে চাইছে! হয় তো তিনি দোষী। দোষ করেছেন তাই নিয়ম অনুযায়ী তার বিচার হবে৷ ন্যূনতম সম্মানটুকু তো শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি প্রত্যাশা করতেই পারেন? আইন হাতে তুলে নেয়া যাবে না। তাকে বয়কট করতে পারেন তবে জুতা মারা যাবে না। জোর করে দুই শব্দে পদত্যাগ করানো যাবে না। তার চেয়ারে বসা যাবে না। যেহেতু তিনি একজন শিক্ষক, তাই তার পেশাটিকে সম্মান করতে হবে। সেই সঙ্গে দোষী ব্যক্তিকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিচারের আওতায় আনতে হবে। সঠিক পন্থায় প্রতিবাদ করতে হবে। তবে, গুরুজনের সম্মানের জায়গাটি ঠিক রেখে।
শিক্ষকতা একটি মহৎ পেশা। এখানে সম্মানীর চেয়ে সম্মান বেশি। কেউ কেউ তো বলতে গেলে পেটে-ভাতে পড়ে থাকেন এই পেশায় শুধুমাত্র সম্মানের আশায়। আমি অনেক কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষককে চিনি যাদের সম্মানী মাত্র দুই হাজার টাকা। অনেক মাদরাসা শিক্ষককে চিনি যাদের বেতন বলতে গেলে নাই, মাসের পর মাস তিনি বিনা বেতনে পড়াচ্ছেন। সম্মানী নয়, শুধু মাত্র সম্মানের আশায়। কিন্তু সেই আশায়ও গুড়েবালি। একটি শনির দশায় আবদ্ধ হয়েছে মহান এই পেশাটি। যেসব শিক্ষকদের কারণে পেশাটি কলঙ্কিত হচ্ছে তারা পেশাটি ছেড়ে দিলে মহান এই পেশার মান থাকে। অপরদিকে, নীতিনৈতিকতার পদস্খলন না ঘটিয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদের কথা শোনতে হবে। কারণ আজকে যারা বড় বড় জ্ঞানী হয়েছেন, পৃথিবীকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাদেরকে যারা গড়ে তুলেছেন তারা হচ্ছেন মহান শিক্ষক। যাদের কারণে আজকে তুমি আমি কথা বলতে পারছি, প্রতিবাদ করার ভাষা শিখেছি তারাও শিক্ষক। তাই শিক্ষার্থী হিসেবে নিজের জায়গায় থেকে শিক্ষককে মর্যাদা দিতে হবে। শিক্ষকরা যদি মনে আনন্দ নিয়ে পড়ান তাহলে সেই শিক্ষাই হবে প্রকৃত শিক্ষা। পক্ষান্তরে, আমাদের শিক্ষকদেরকেও সব ধরণের কুকর্ম থেকে বেড়িয়ে এসে নিজেকে মর্যাদার আসনে আসীন করতে হবে। নিজের মান নিজেই বজায় রাখতে হবে। এই সময়ে এটাই এখন তার সবচেয়ে বড় কাজ। আজ ৫ অক্টোবর। মহান শিক্ষক দিবস। শিক্ষক দিবসে প্রত্যাশা এই- ‘আজ হতে চির উন্নত হোক শিক্ষাগুরুর শির’।
লেখক: শিক্ষক